সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অর্পিতা বোস (অন্তিম পর্ব)

বৃত্ত
– কী হলো! আমি আসলে…
কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সাত্যকী বলে,
— টেনশন কোরো না। অর্জুনবাবু থানা থেকে ফোন করেছিলেন। আমাকে ডেকেছিলেন। আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব ভাবলাম তাই।
এক অজানা আশঙ্কায় সাত্যকীর হাতটা চেপে জল ভরা চোখে উৎকন্ঠায় জানতে চায়,
— বাবা ঠিক আছে তো?
সাত্যকী মুখে ভরসার হাসি এঁকে বলেন,
– সব ঠিক আছে।
গাড়ি স্টার্ট দেয়।
অর্জুন মন্ডল, ওসি। কঠিন কঠোর মন। চাকরি জীবনে কত মানুষের চোখের জল দেখেছে। কখনও কুম্ভিরাশ্রু কখনও হৃদয় নিংড়ানো কান্না। কোনও চোখের জলেই অর্জুন মন্ডলের মন এতটুকু নরম হয় নি। আর আজ এক অদ্ভুত ঘটনা। যে মেয়েটার চরম সর্বনাশ দেখে মনে অদ্ভুত পৈশাচিক আনন্দ হয়েছিল, আজ কেন জানেনা চোখটা ঝাপসা হচ্ছে ওসি অর্জুন মন্ডলের।
সামনের চেয়ারে বসে ডাক্তার সাত্যকীও পিছনে চেয়ে দেখছেন এক অদ্ভুত দৃশ্য। একটু দূরে একটা চেয়ারে বসা অনিমেষ বাবুকে জড়িয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছে রূপসা।
অর্জুন দেখছে শুধুমাত্র সাত্যকী নয় থানার সবারই চোখ অনিমেষ স্যার আর রূপসার দিকে। অর্জুন জানে সে নিজে এতটা উদ্যোগ না নিলে হয়তো নিখোঁজ মানুষের ফাইলের স্তুপেই হারিয়ে যেতেন স্যার। শুধুমাত্র স্যার নয় অনিমেষ স্যার তার কাছে দ্রোণাচার্য। এই অনিমেষ স্যার ছিলেন বলেই অর্জুনের লেখাপড়া হয়েছে। আর আজ পর্যন্ত অর্জুনের জীবনবৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন অনিমেষ স্যারই। তাই নিজেই ছড়িয়ে দিয়েছিল স্যারের ছবি সব পরিচিত মহলে। হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ থেকে শুরু করে পুলিশ ইনফর্মারদের কাছেও। সেইসাথে জানিয়েছিল যে অনিমেষ স্যারের খোঁজ এনে দিতে হবেই। গতকাল বিকেলে কালনার এক রেলস্টেশনে স্যারকে দেখে ফোন করেছিল স্কুল গ্রুপের এক বন্ধু। স্যারেরই প্রাক্তন ছাত্র। স্যার চিনতে পারেননি কিন্তু সেই বন্ধু স্যারকে চেনে অর্জুনের পাঠানো ছবি দেখে। তারপর খবর পেয়ে অর্জুন নিজে গিয়েছিল স্যারকে আনতে। এখানে এসে কোয়ার্টারে নিয়ে নিজের হাতে স্যারকে স্নান করিয়ে খাইয়ে দেয়। মনে পড়ছিল নিজের ছোটবেলার কথা। আলাদা করে কৌটোয় স্যার রুটি তরকারি দিয়ে দিতেন ফেরার পথে। বড়ই স্নেহ করেছেন স্যার।
বিনিময়ে অর্জুন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। স্যারের খাওয়া হলে অর্জুন ডাক্তার সাত্যকীকে ফোন করেছিল। অনেকরাত হয়ে যাওয়ার কারণে ভোরে থানায় আসতে বলে ওদের। কিন্তু অর্জুন জেগেছিল বাকি রাতটুকু। স্যার যদি আবার হারিয়ে যান এই আতঙ্কে ঘুমোতে পারেনি। ভোরের আলো ফুটতেই ফোন এসেছিল ডাক্তার সাত্যকীর। একজন ভালো মানুষ ডাক্তার সাত্যকী। রূপসার প্রতি সাত্যকীর দুর্বলতা বুঝে নিয়েছিল অর্জুনের পোড়খাওয়া দৃষ্টি। তবে গতকাল আরও একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ডাক্তার সাত্যকী রূপসার রেপ কেসটার ভিক্টিম রাহুলের ছবি পাঠায়। জানায় রাহুল এখন একটা দুর্ঘটনায় স্মৃতিশক্তি হারিয়ে রিহ্যাবেই ভর্তি। অবাক হয়ে গিয়েছিল অর্জুন। তারপর ভেবেছিল অপরাধ করলে কখনও না কখনও অপরাধের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। যেভাবেই হোক অপরাধের শাস্তি পেতেই হয় অপরাধীকে। রাহুলের স্মৃতিশক্তি ফিরলে অর্জুন নিজে উদ্যোগ নেবে রূপসার কেসটা আবার উচ্চ আদালতে বিচারের জন্য। অর্জুন জানে সঠিক বিচারব্যবস্থায় হয়তো নিজের ভাবমূর্তিতেও কালি লাগতে পারে। কিন্তু আজ আর সিদ্ধান্ত বদলাবে না। আবার তাকায় স্যারের দিকে। রূপসা কেঁদে চলেছে বাবাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে। কাঁদুক মন হালকা হোক রূপসার। রূপসার জীবন স্রোত বদলে যাওয়ার পিছনে অর্জুনও দায়ী। তাই আজ মনটা ভালো লাগছে সামনের দৃশ্য দেখে।
যদিও অনিমেষ স্যার চিনতে পারছেন না সন্তানকে। মাথায় হাত রেখে বলে চলেছেন,
— কেঁদোনা মেয়ে। আমারও একটা মেয়ে আছে। খুব ছোট্ট । সেও খুব কাঁদত। মেয়েটাকে ওরা…
আর কিছু বলতে পারছেন না অনিমেষ স্যার। অর্জুন মনে মনে ভাবে সেই নারকীয় ঘটনা যেন আর স্যারের মনে না পড়ে। কখনও বিস্মৃতিও বোধহয় জীবনে দরকার হয়।
বুকের ভেতর একটা কষ্ট হলেও আজ অনেকটা হালকা লাগছে। আজ স্যার না জানলেও অর্জুন সঠিক গুরুদক্ষিণা দিতে সক্ষম হলো।