• Uncategorized
  • 0

মুক্তগদ্য – মানসী কবিরাজ

বিদ্যাসাগর২০০/বিশেষ সংখ্যা

আমি দিনময়ী বলছি

মানননীয় ঈশ্বরবাবু,

আমি আপনার বিবাহিতা স্ত্রী দিনময়ী বলছি । আপনি নিজে থেকে তো কখনো খোঁজ করেননি ।  অপেক্ষার প্রান্তসীমা পেরিয়ে এতদিন পর  তাই আমাকেই আজ বলতে হচ্ছে নিজের কথা । খুব ইচ্ছা করে   আপনাকে চিঠি লিখি একটা  ।  কিন্তু নিরক্ষর দিনময়ীর যে সে উপায় নেই ,তাই লজ্জার টুঁটি টিপে ধরে সাত চড়েও রা কাড়ত না যে মেয়ে সেই মেয়ের মুখেই এখন খই ফুটছে । জানি হয়তো লজ্জার নারীর ভূষণ   এসব বলবেন । বলতেই পারেন। হাজার হোক পুরুষ মানুষ তো । তাঁর উপর আপনি বীরসিংহের সিংহ শিশু । আপনার কী  সাধারণ এক গৃহবধূর কথায়  সময় নষ্ট করার মতো সময় আছে !তবুও কত যে কথাদের জমিয়ে রেখেছিলাম । ভেবেছিলাম সেসব কথাদের চিঠি লিখে পাঠিয়ে দেব আপনার ঠিকানায় আর আপনি যখন সেই  চিঠি খুলে পড়বেন আমার মনে হবে যেন আমাকেই পরতে পরতে  খুলে  পড়ছেন আপনি ।
ঈশ্বরবাবু , আপনি বর্ণপরিচয় লিখলেন । দেশ জুড়ে কত নাম আপনার ,  বিশ্বাস করুন সেসব শুনে  গর্বে বুক ভরে ওঠে আমার, ভাবি এই লোকটিই  আমার স্বামী ! এত ভাগ্যবতী আমি ! আহা  ঘর ঘরে মেয়েদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে আপনার বর্ণপরিচয়.. বই তো নয় যেন নতুন উঠোনে পা ফেলবার এক অপার বিস্ময় ।
তখন বুঝিনি আপনার এই দিনময়ীর কিন্তু কোনো বর্ণেই আর পরিচিতি ঘটবে না কখনো । সে থেকে যাবে অন্ধকারেই যেমন সে আগেও ছিল । চিলেকোঠা চুঁইয়ে নামা রোদটুকু যে আমার নয় সেটা বুঝতে অনেকটা বয়স গেল পেরিয়ে , চুলে ধরল পাক ,চামড়া জুড়ে উপেক্ষার কাটাকুটি রেখা।
অথচ  কতই বা বয়স ছিল আমার , যখন বিয়ে হয়ে আসলাম আপনাদের এই বাড়িতে! হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন, এবাড়ি কখনোই আমার হয়নি । নইলে একটা দশ বছরের বালিকার কথা আপনি শুনতে পেলেন না ?! নাকি শুনতে চাইলেনই না? পাছে আপনার সমাজ সংস্কারের পথে আমি বাধা হয়ে পড়ি ! তাহলে বিবাহে কেন সম্মতি দিয়েছিলেন বলুন তো ! কোথায় ছিল তখন আপনার সেই বীর বিক্রম ? কেন মাতৃদেবীকে বলতে পারেননি যে সমাজের সেবাই আপনার একমা্র ব্রত ! আর যদি মায়ের আদেশেই এই বিবাহে সম্মতি দিয়ে থাকেন তবু একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায় ঈশ্বরবাবু । যে কর্তব্যপরায়ণ তার তো সবার ক্ষেত্রেই কর্তব্যপরায়ণ হবার কথা  তাই নয় ? স্ত্রীর জন্য আপনার কি কোনো কর্তব্য ছিল না !
জানি ঈশ্বরবাবু আপনি নারীশিক্ষার জন্য প্রাণপাত করেছেন… বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য রাতদিন এক করে ফেলেছেন বাল্যবিধবারের দুঃখে কাতর হয়ে শাস্ত্রের বিধান ঘেঁটে ঘেঁটে দেখিয়েছেন বিধবা-বিবাহ কোনো গর্হিত কাজ নয় ।
ঈশ্বরবাবু এই দিনময়ীও তো একজন নারীই .. আপনি সব নারীর দুঃখ পড়ে ফেলতে পারলেন শুধু এই দিনময়ী ছাড়া ? !
আপনি কী পারতেন না ঈশ্বরবাবু আপনারই  বর্ণপরিচয়ের আলোয় রাস্তা দেখিয়ে দেখিয়ে আমাকেও আপনার সহধর্মে নিয়ে যেতে ! অথচ স্ত্রীকে আপনারা সহধর্মিনী বলেন তাই না !
যখন দশ বছরের একটি বালিকাকে আপনাদের গ্রামের বাড়িতে রেখে আপনি মাসের পর বাড়ি আসতেন না , আপনি কখনো ভেবেছেন তার আবদারের কথা ,তার ভয়ের কথা, তার বাপের বাড়ি ছেড়ে থাকার কষ্টের কথা , তার কিশোরী অনুরাগের কথা তার অভিমানের কথা সে বলবে কার কাছে  !
অথচ নিয়তির কী অদ্ভুত পরিহাস দেখুন যে বীরসিংহের জ্ন্য , যে বাঙালী সমাজের জন্য , যে বাংলার  দুঃখী নারীদের জন্য আপনি দাম্পত্য জীবন  হেলায় মাড়িয়ে চলে গেলেন শেষে আপনাকেও কিনা সেই জায়গা ছেড়ে যেতে হল !  আপনিও তো আসলে নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে গেলেন ।
ঈশ্বরবাবু , আমি আমার নিজের আহত অভিমানের তীব্রতা  থেকে আপনার কষ্টটা বুঝতে পারি । ছুঁয়ে দিতে পারি আপনার বিষাদ-গাথা । এই বছর আপনার জন্মদিনের দুশো বছর .. চারদিকে সাজো সাজো রব .. কত অনুষ্ঠানের ঢক্কানিনাদ শুনছি তাদেরই মুখে যারা আপনার কোনো আদর্শেই নিজেদেরকে চালিত করেনি, যারা আপনার মূর্তি ভেঙে ধুলায় লুটিয়েছে তাদের মুখে আজ আপনার কীর্তিকথা । জানি আজও অভিমান করে আছেন, এই আড়ম্বরে আপনার আর কিছুই যায় আসে না।  এটাও জানি এই দিনময়ীর কথা  আপনি কখনো শুনবার যোগ্য বলে মনে করেন না,তবু  বলছি আপনি আসুন ঈশ্বরবাবু । আজ আমাদের বঙ্গসমাজের যে আপনাকে বড় দরকার।  আসুন ঈশ্বরবাবু,  এই দিনময়ীর ডাকে   একবার অন্তত সাড়া দিন
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *