• Uncategorized
  • 0

বড়দিনের প্রবন্ধে মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

মানবপুত্র যিশু

“এলি এলি লামা সাবাখতানি”
ক্রুশে ঝুলতে ঝুলতে নবম প্রহরে
যিশু এই কথা বলে উঠলেন।
দু জন চোরের সাথে যিশুকেও একই রকম শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। পরনের কাপড় খুলে নিয়ে, গায়ে থুতু ছেটাতে ছেটাতে ওঁকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তেষ্টার জল চাইলে গলায় ঢেলে দেওয়া হয়েছিল কড়া মদ। গলা জ্বলে যাচ্ছিল যিশুর। হাতে ও পায়ে গজাল বিঁধে ওঁকে ক্রুশে ঝুলিয়ে রাখা হল। নবম প্রহরে যিশু এই কথা বলে উঠলেন। এর মানে রবীন্দ্রনাথের কলমে – হে ঈশ্বর, হে মানুষের ঈশ্বর, আমায় কেন পরিত্যাগ করলে!
আজ যিশুর জন্মদিনের পূর্ব মুহূর্তে “পুনশ্চ” কাব্যগ্রন্থের ‘মানবপুত্র’ কবিতাটি খুব মনে পড়ছে।
সহবাস জিনিসটা প্রাপ্তবয়স্কের ও প্রাপ্তমনস্কের পক্ষে আমাদের দেশে আদৌ অবৈধ নয়।
কিন্তু, সহবাস সূত্রে সন্তান চাইছেন কি না, সে ব্যাপারে মেয়েটিকে স্পষ্ট জেনে নিতে হবে নিজের অবস্থান।
আমাদের যিশু ছিলেন কুমারী মায়ের সন্তান। কুমারী মা যে সে কালে গর্ভধারণ করতেন সে কথা ভালো জানতেন মহাবল কর্ণ আর মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস। ওঁদের মায়েদের কুমারী থাকাকালীন সঙ্গম ও জন্মদানের ঘটনা ওঁরা জেনেছিলেন। কিন্তু আজ আমাদের চলমান সমাজ এ নিয়ে খুব সহজ স্বাভাবিক নয়। আইনে অবশ্য সিঙ্গল মাতৃত্বের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দিন আনি দিন খাই গোত্রের লোকেদের জন্য সে সব ধরাছোঁয়ার বাইরের ব্যাপার স্যাপার। তাই গর্ভবতী হয়ে নিরাপত্তাহীনতা আর হীনমন্যতায় লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েরা মরছে।
সেই যিশু। কুমারী মায়ের সন্তান, নিজেকে বললেন, ঈশ্বরের পুত্র। পরে পরে ধর্মধ্বজীরা তাঁর নামে বহুতর কীর্তিগাথা বানিয়েছে। কিন্তু কীর্তিগাথা বানানো এক, আর যুক্তি দেখিয়ে বাস্তব ঘটনার মুখোমুখি হ‌ওয়া আর এক। যে মানুষ সামান্য একটু মাছের টুকরো থেকে হাজার হাজার লোকের খাবার বানিয়ে দিতে পারেন, কেবলমাত্র হাত বুলিয়ে অক্ষম অচল পঙ্গু মানুষ কে সচল করে দিতে পারেন, জন্মান্ধকে করে দিতে পারেন দৃষ্টিবান, আর মূক বধিরকে দিয়ে দিতে পারেন বাচিক ক্ষমতা, তিনি দু দুটো চোরের মাঝখানে ক্রুশবিদ্ধ হ‌ওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন না? যে যিশু মৃত্যু কে অতিক্রম করে হেঁটে চলে যেতে পারেন, দেখা দিতে পারেন মেরি মাগদালিনাকে, তিনি নিজেকে বধ‍্যভূমিতে ক্রুশ কাঠ কাঁধে চাবুক খেতে খেতে যাওয়া র মতো ঘটনা থেকে পরিত্রাণ করতে পারেন না?
যুক্তি বুদ্ধি কে ঘুম পাড়িয়ে না রাখতে জানলে, এসব বিশ্বাস করা শক্ত।
কতো না অলৌকিক ক্ষমতা ছিল যিশুর। মৃত্যুর আগেই তিনি শেষ নৈশভোজে আপ‍্যায়িত করেন শিষ্যদের। রুটির টুকরো দেখিয়ে বলেন এই আমার মাংস, পানীয়টি দেখিয়ে বলেন, এই আমার রক্ত, এ আমি সর্ব মানবের কল‍্যাণসাধনে উৎসর্গ করলাম। তিনি জুডাস নামে অন্তরঙ্গ শিষ‍্যকে বলেন, আগামীকাল সকাল হবার আগেই সামান্য কয়েকটি মুদ্রার জন‍্য তুমি আমায় পরিচিত বলে স্বীকার করতে অগ্রাহ্য করবে। যিশুর বন্দিত্ব মোচন করতে ঈশ্বরের দূত বিচারপতির নিজস্ব নারীকে স্বপ্নাদেশ দেন ।
কিন্তু, জনতার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর দেবতার স্বপ্নাদেশকে মিইয়ে দেয়।
যিশুর বেলা কেন এইরকম হয়েছিল?
না, পুরোহিতরা যিশুর কথা বার্তায় সর্বনাশ দেখতে পেয়েছিল। লোকটা বলে কি? সে ঈশ্বরের পুত্র? আর পৃথিবীর সব লোকেই ঈশ্বরের সন্তান? তা হলে তো রাজা গজার সাথে হাজা মজা দের কোনো তফাৎ থাকবে না। না না, যিশু লোকটা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার পক্ষে বিপজ্জনক। ওকে তো বাঁচতে দেওয়া চলে না। ব্যস, হয়ে গেল। যিশুর শাস্তি নির্ধারিত হয়ে গেল।
ওদিকে শাসক পিলাতের বউ স্বপ্ন দেখেছে একটা ভালো লোককে মেরে ফেলা হচ্ছে। পিলাত ভাবলো অন্ততঃ নিজের শাসকীয় ক্ষমতাবলে যিশু লোকটাকে বাঁচিয়ে দেওয়া যাক।
কিন্তু পুরোহিতরা তাতে চটে উঠছিল। পুরোহিত দল চটে উঠলে পিলাতের আসন নড়বড় করে উঠতে পারত।
পুরোহিতের দল জানে কেমন করে জনতা জনার্দনকে ক্ষেপিয়ে তুলতে হয়। পিলাত তার ব‌উয়ের স্বপ্নাদেশ স্মরণ করে বলল, যিশুকে ক্ষমা প্রদর্শন করলে হয় না? উৎসবের দিনে আমার বিশেষ ক্ষমতায় না হয় ছেড়েই দিলাম বেচারা যিশুকে!
জনতা জনার্দন‌ যিশুকে পছন্দ করে নি। তারা পুরোহিতদের কৌশলে ক্ষেপে‌ই ছিল। তারা বললো – না হয়, দস্যু বারাব্বাসকে মুক্তি দাও। কিন্তু যিশু কবভি নেহি। জনতা জনার্দন ক্ষেপলে তাকে সামলায় কার সাধ্যি!
যিশুকে দু দুটো চোরের সাথে একসাথে ক্রুশে ঝুলতে হল। সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন যিশুর পক্ষে জোটে নি। জনতার উন্মাদনায় যিশুকে ক্রুশে ঝুলতে বাধ্য হতে হয়েছে।
তাঁকে হাতে পায়ে লোহার গজাল পুঁতে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছিল।
তিনি ঈশ্বরপুত্র তার আগে নিজের ক্রুশ তাঁকে নিজের ঘাড়ে বইতে হয়েছিল
মাথায় পরানো হয়েছিল কাঁটার মুকুট আর গায়ে দেওয়া হয়েছিল থুতু আর টান মেরে কাপড় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
তিনি যে ঈশ্বরপুত্র।
তার পর তাকে ক্রুশে ঝুলিয়ে দেওয়া হল।
দুপাশে ক্রুশে ঝুলল দু দুটো সাজা পাওয়া চোর।
তেষ্টা পেয়েছে বললে
যীশুর গলায় ঢালা হল কড়া নির্জলা মদ।গলা গেল জ্বলে।
তিনি ঈশ্বরপুত্র।
ঈশ্বর বেহালা বাজাতে বাজাতে এসব দেখছিলেন।
এমনটাতো হয়েই থাকে।
কাউকে দেখে, কারো অনুপ্রেরণায় যে সক্রিয়তা, তার চাইতে অনেক বেশি মূল্যবান নিজের বুদ্ধি বিবেকের শাসনে পরিচালিত হ‌ওয়া। জনতার তরফে অজ্ঞতা অসচেতনতা সক্রেটিসকে হেমলক পান করতে বাধ‍্য করে, জনতার হররায় দস্যু বারাব্বাস ছাড়া পেয়ে যায়, কিন্তু যিশু সাজা পায়, মার খায়, চোরের সামিল হয়ে। গ‍্যালিলিওর উপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন স্মরণ করে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন টরিসেলি। এইসব স্মৃতি আরো প্রগাঢ়ভাবে সামাজিক বৈজ্ঞানিক সত‍্য প্রতিষ্ঠায় আমাদের সংহত করুক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।