“আবেগে কাঁপিছে আঁখি, বসন্ত এসে গেছে… “
বাংলায় বসন্তের স্থায়িত্বকাল দোল পর্যন্ত। এই যেন শুরু হলো, এই শেষ। স্বল্প সময়ের বসন্তকে নিয়ে বাঙালীর আদেখলাপনার শেষ নেই। বসন্ত এক আবেগ, বসন্ত এক ছাড়পত্র বর্ডার লাইন পার করে দুরু দুরু বুকে ওপারে যাবার, … ‘টুকরো করে কাছি/আমি ডুবতে রাজী আছি/ তোমার খোলা হাওয়ায়… ‘। বসন্ত কোন বয়সধর্ম মানে না, কোন বাঁধন মানে না, কোন পরিস্থিতি মানে না। আসে আপন খেয়ালে, আপন গতিতে, আপন গরিমায়। গগনচুম্বী ফ্ল্যাটবাড়ীর টেরেসের টবে বেড়ে ওঠা পিটুনিয়া, সাজানো বাগানে যত্নে বেড়ে ওঠা গোলাপ দীপ্ত রোদে ক্রমশঃ শুষ্কপ্রায়, চন্দ্রমল্লিকারও সেই দশা, রজনীগন্ধাগুলি সতেজ হতে শুরু করলো, অশ্বত্থগাছের মতো পর্ণমোচীর পাতাগুলি ঝরে পড়ছে, নিম গাছগুলিতে নতুন হাল্কা তামাটে সবুজ পাতাগুলি ইতিউতি উঁকি মারছে, সূর্যের আলো অথবা নিয়ন বাতির আলোতে পাতাগুলি অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে, একটু বেলা হতেই দামাল হাওয়া, ঝরা পাতাগুলি এপাশ থেকে ওপাশ সরসর্, সে শব্দ কখনো হৃদয় দুলিয়ে দেয় – “ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে… “। জবা গাছ ফুলে ফুলে ভরে আছে, হলুদ রাধাচূড়া এবং লাল কৃষ্ণচূড়ার ডুয়েট গান, পুকুর-ডোবা এখনো ভরন্ত, ভোরবেলা সে জলের উপর স্থির প্রলেপ, বেলা বাড়তে সে জলে মানুষের উথাল-পাথাল, যে পাখীগুলি শীতে এসেছিলো, ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত, হয়তো তাদের মন খারাপ। বাজার-হাটে বুড়ো বাঁধাকপি, ফুলকপিকে পাশ কাটিয়ে ক্রেতারা চলেছে সবুজ সজনে ডাঁটার দিকে, সেগুলি সারি দিয়ে শুয়ে আছে, পাশেই রাখা কচি এঁচোড়, হরেক রকম শাক। রঙের ছড়াছড়ি ফলওয়ালার ঠ্যালায়, কমলালেবুর এক রং তো আপেল-আঙুরের রঙের বাহার। গৃহস্থের শাল-সোয়েটার ন্যাপথলিনের গন্ধ মেখে ফের ঢুকে পড়েছে বাক্সে, লেপ-কম্বল ঢুকেছে ডিভানের গুমঘরে। বিছানার ওপর একটি চাদর ভাঁজ করে রাখা, ভোরবেলা আমুদে শীত যে! মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেছে, পরীক্ষার্থী রিল্যাক্সড, উচ্চমাধ্যমিক ও কলেজের পরীক্ষার্থীরা টেনশনে। এর মাঝে সার সার ন্যাড়া ক্ষেতে, মানভূমের টাঁড়ের মাঝে এক-দুটি গাছ মাথাভর্তি লাল লাল ফুল নিয়ে হাসছে, আবার কোথাও এই লাল লাল ফুল ভর্তি গাছগুলিতে যেন আগুন লেগেছে, যে আগুনে চোখ পুড়ে যায়। পথিকেরা পাগল, বিস্ময়াস্তব্ধ! আরে! এই তো শিমূল! এই তো পলাশ! তোরা জ্বালা আগুন, মনের আগুন, প্রাণের আগুন, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দে সব, স…ব কিছু, মন খাঁটি সোনা হোক। তোদের দেখেই মানভুঁইয়ারা মনে বল পাক, কদিন পরেই তো তাদের যুদ্ধে যেতে হবে, গ্রীষ্ম আসছে যে, ক্ষেত, মাটি রুখা-সুখা হবে, ফুটিফাটা হবে, তৃষ্ণার জলও অপ্রতুল। ও আগুনরঙা শিমূল, পলাশ, তোদের দেখে লোকজনেরা হা-হা হাসুক, প্রিয়ার কবরীতে একটি করে প্রেম হয়ে যা। তোরা আমাদের ঘরের দুলাল, মানভুঁইয়াদের মনের কথা তোরাই বুঝিস, ‘উ গোলাপ-টোলাপ আমাদের জন্যে লয়, বড় বড় বাবুদের …’।
আচ্ছা সব আম মুকুলেই কি আম ফলবে? গাছ হতে যতগুলি পাতা ঝরছে, ততগুলিই পাতা ঠিক গজাবে তো? রাতের রজনীগন্ধার গন্ধ প্রত্যেকের মনের মানুষকে স্মরণ করাবে? যে সাঁওতালীর সাঁওতাল দূরে গেছে কাজে, শিমূল-পলাশের মাতাল করা রঙ আর ফাগুন বাতাস তার মনটাকে হু-হু করে নিদারুণ কষ্ট দেবে? প্রশ্ন অনেক মনের ভেতর। ইচ্ছে করে না একা, একদম একা শালবনে হারিয়ে যেতে? বোহেমিয়ান হয়ে যেতে? উত্তর একটাই — হ্যাঁ। উত্তর যে বলিয়ে দেয় বসন্ত! বসন্ত কি শুধু দোল? শুধুই রবীন্দ্রসঙ্গীত? বসন্ত কি শুধু কাব্যে? বসন্ত কি বাঙালী ছাড়া এতো গভীরভাবে আর কেউ অনুভব করে? রোমান্টিক বাঙালীদের কাছে বসন্ত ‘ফাগুনের মোহনায়, মনমাতানো মহুয়ায়… কোন আকাশে নিয়ে যায়’। বসন্ত অনুভবী বাঙালীর কাছে ‘চৈতি রাতের চাঁদ, মহুয়া বনের ফাঁদ’। বসন্ত বাঙালীদের ক্ষ্যাপামী, বসন্ত ক্ষণিকের — তাই বসন্ত বেদনার, বসন্ত জ্বালার। জোর করে বসন্ত হতে মুখ ফিরিয়ে সংযমী হতে চায় মন – ‘উড়িয়ে দেবার ছড়িয়ে দেবার মাতন তোমার থামুক এবার/নীড়ে ফিরে আসুক তোমার পথহারা বিহঙ্গ।’