জন্ম মেদিনীপুর জেলার লক্ষ্যাপাল গ্রামে।পেশায় শিক্ষক।অবসরে দু এক কলম লিখে ফেলা নেশা।
বিদ্যাসাগর২০০/বিশেষ সংখ্যা
পিতা পুত্র
বাবার ইচ্ছে ছেলে গ্রামের বাড়িতে একটা টোল খোলার মতো শিক্ষা লাভ করলেই হবে ।আসলে ঠাকুরদাসের স্বপ্ন ছিল অধ্যাপনা করার, হয় নি।হবে কি করে ? ছোটে থেকে মাকে দেখেছেন চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে ।পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ঠাকুরদাসের পিতা রামজয় তর্কভূষণ দেশান্তরী হন। মা দুর্গা বাধ্য হয়ে তাঁর শ্বশুর বাড়ি বনমালীপুর থেকে পুত্র কন্যা দের নিয়ে বাপের বাড়ি বীরসিংহ গ্রামে ফিরে আসেন। ভায়েরা সঙ্গে থাকতে দিতে অস্বীকার করলে গ্রামের শেষে একটি কুটির নির্মাণ করে থাকতে লাগলেন। চরকা কেটে দিনগুজরাণ হতো তাদের। একটু বড়ো হলে মায়ের দুর্দশা দেখে রোজগারের আশায় ঠাকুরদাস পাড়ি দিলেন কলকাতায়। শুরু হলো বেঁচে থাকার জন্য আর এক নতুন লড়াই।এই লড়াইয়ের ফলে সফল হলো না তাঁর অধ্যাপনা করার স্বপ্ন ।কিন্তু তার এই স্বপ্ন জিইয়ে রেখে বুনে দিতে চেয়েছিলেন পুত্র ঈশ্বরের চোখে। তখনো জানতেন না, শিক্ষকতা নয়, শিক্ষার পুরো খলনলচেটাই বদলে দেবেন ঠাকুরদাসের এই পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হয়ে।
পুত্র ঈশ্বরের ইচ্ছা যেভাবে হোক একটা চাকরি যোগাড় করে সংসারটাকে দাঁড় করানোর।কলকাতার সংসারও ছোট নয়।গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে থাকতে শুরু করেছে দু ভাই।তাদের জন্যও খরচা আছে।ঠাকুরদাস একা পেরে উঠছেন না ।খরচ বাঁচানোর জন্য একটা নিম্নমানের বাড়িতে থাকতে বাধ্য হন তারা।কলেজ থেকে ফিরে নিজের হাতে সকলের জন্য রান্না করেন ঈশ্বরচন্দ্র।সংসারের কষ্ট দূর করার জন্য ব্যাকরণ শেখার পর স্মৃতির পরীক্ষা দিলেন হেড জজ হবার আশায়।পেয়েও গেলেন ত্রিপুরাতে।কিন্তু পিতা যেতে দিলেন না।সরাসরি জানিয়ে দিলেন খুব বেশি হলে তুমি অধ্যাপনা করবে।শুধুমাত্র এক্ষেত্রে নয়।বরাবর অনুগত থেকেছেন পিতা মাতার।বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন,” আমার মধ্যে যদি বিন্দুমাত্রও দয়ামায়া থেকে থাকে, তা আমি পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে।আর বুদ্ধি বলে যদি কিছু থাকে তা পেয়েছি বাবার কাছ থেকে।” কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন।হাঁটতে পারতেন খুব দ্রুত। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পড়ানো কালিন বেতন পেতেন 50 টাকা। তারমধ্যে বাবার জন্য বীরসিংহ গ্রামে পাঠাতেন 20 টাকা। প্রথম মাইনে পেয়ে বাবার ইচ্ছানুযায়ী গয়ায় দর্শনে পাঠিয়েছেন তাকে। স্বীকার করেছেন তার জীবনে পিতা ঠাকুরদাসের ভূমিকা।গ্রামের পাঠশালার পন্ডিত মশায় বেশি মারধর করতেন বলে তার পাঠাশালায় না পাঠিয়ে খুঁজে এনেছিলেন নতুন গুরুমশায় ।কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ঈশ্বরকে কলেজে পাঠিয়ে নিজে কাজে যেতেন।যেখানেই যান ঠিক ফিরে আসতেন চারটার সময়। এসে নিয়ে আসতেন ছেলেকে।রাত নটায় বাসায় ফিরে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতেন পুত্র কে।ঘুম পাড়িয়ে দিতেন দশটার সময়।পিতা জেগে বসে থাকতেন।বারোটা বাজলে পুত্র কে তুলে দিয়ে নিজে শুতে যেতেন। মাঝে উঠে দেখতেন ছেলে পড়ছে কিনা ?না পড়লে বেদম প্রহার জুটতো ঈশ্বরের কপালে।একবার তো গৃহত্যাগী হয়েছিলেন ঠাকুরদাসের প্রহারের ফলে।
বাবা ছেলেকে আজীবন শিক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়ে গেছেন ,আর পুত্র আজীবন শিক্ষিত করার চেষ্টা করে গেছেন বাঙালী জাতিকে।বাদ দেননি মেয়েদেরও। কিন্তু কতটা শিক্ষিত হতে পেরেছি বা আদৌ কি শিক্ষার আলো প্রবেশ করেছে বাঙালির চৌকাঠে বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবর্ষে বরং আলোচনা হোক তাই নিয়ে।