১৯৭৮ সালে জন্ম। কাঁচড়াপাড়ায় ও কল্যাণী শহরে বড় হওয়া। পেশায় স্কুল শিক্ষিকা।
ছোটোবেলা থেকেই সাহিত্য-চর্চার শুরু। মাঝে বেশ কয়েক বছর বিরতির পর আবার এই জগতে প্রবেশ।
নানা পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
বিদ্যাসাগর২০০/বিশেষ সংখ্যা
আমার চোখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি লেখা থেকে জানা যায় সাল ১৮৫৩, শীতের সময়। একদিন তাঁরই সামনে ” পেয়েছি , পেয়েছি ” বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলেন একজন মানুষ। কি পেয়েছিলেন তিনি ?
পরাশর সংহিতার দুটি লাইনের একটি শ্লোক।
” নষ্টে, মৃতে, প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ “
অর্থাৎ স্বামী নিখোঁজ অথবা মৃত্যু , নপুংসক অথবা পতিত হলে তাঁর স্ত্রী পুনরায় বিবাহ করতে পারবেন।
এরপর শুরু হয়েছিল তাঁর সমাজের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
আর আজ তাঁর জন্মের দু’শ বছর পর সমস্ত হিন্দু নারী সমাজ তাঁর কাছে ঋণী। আগামীতে আরো শত শত বছর এই ঋণ অম্লান থাকবে।
তিনি আমাদের ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমি প্রথম অ, আ, ক, খ শিখেছিলাম আমার বাবার ছোটোবেলার একটি বই থেকে। বইটির নাম ছিল “স্বাধীন ভারতের অ, আ, ক, খ ” …. অ এ অজগর আসছে তেড়ে আমি পড়ি নি। আমি পড়েছিলাম অ এ অশোক চক্র দেশ পতাকায়, আ এ আশুতোষ যেন জ্ঞান গরিমায়……. ব এ বীরসিংহের সিংহ শিশু বিদ্যাসাগর বীর।
ছোট্ট মনে সিংহ সম্পর্কে ধারণা বেশ ভয়ের। সেখান থেকেই এই ছবিটি দেখলেই আমার শিশু মনে ভীষণ রাগী বা ভয় মিশ্রিত অনুভূতি হত। এর পর ক্লাস ওয়ান। বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ও পরের ক্লাসে দ্বিতীয় ভাগ। শ্রুতিলিখন ও বানান লিখন এর ১০০ নম্বর পরীক্ষার দৌলতে এবং আমার মা ও স্কুলের যৌথ প্রচেষ্টায় এই বই আমায় গলাধঃকরণ করতেই হয়। একটিও বানান ভুলক্রমে ভুল করলে মা এর বেতের বাড়ি এবং প্রথম পাতায় ঈশ্বর চন্দ্র শর্মা নামে সহি থাকলেও ছবিটি সেই সিংহ শিশুর। সুতরাং ধারণা এতটুকুও বদলায়নি সেই সময়। পরবর্তীকালে এবং এখনো পদে পদে বুঝতে পারি এই বইটি আমার কাছে ধর্মগ্রন্থ তুল্য।
এরপর স্কুলে রচনা লেখা শুরু হতেই তাঁর সাথে বিস্তারিত পরিচয়। ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ শে সেপ্টেম্বরে মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে ভগবতী দেবী ও ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র ….. ইত্যাদি ইত্যাদি। বাকি তথ্য তখন রচনা বই আর এখন গুগুলের দৌলতে কারো কিছুই অজানা নয়। তবে বিদ্যাসাগর রচনা না লিখে স্কুল টপকেছেন এমন বাঙালীর সংখ্যা বড়ই কম তা বলাই যায়।
কিন্তু তাতেও সেই শিশু কালে আমার বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বেশ সংশয় ছিল, কিছুটা রাগ মিশ্রিত ভয়। রচনায় লিখতে হত মাইল স্টোন দেখে কলকাতা যাওয়ার পথে তিনি ন’ বৎসর বয়সে ইংরাজী ১ থেকে ৯ শিখে ফেলেছিলেন। কিছুতেই বুঝতাম না তাতে হল টা কি ? আমি কর গুণে বয়সের হিসেব কষে দেখতাম আমি ছ’এই এক থেকে একশ পারি ইংরিজি সংখ্যা লিখতে। এখন খুব হাসি পেলেও এই ভাবনা আমায় ভীষণ রকম ভাবিয়েছিল সে সময় তা বলাই বাহুল্য। আর রাগ ছিল কথায় কথায় মা বলতেন… বিদ্যাসাগর রাস্তার স্ট্রীট লাইটের তলায় বসে পড়াশোনা করতেন, বাসন মাজা থেকে রান্না করা সব কাজ করে পড়াশোনা করতেন… আর আমি বা বোন হচ্ছি অপদার্থ, ফাঁকিবাজ ইত্যাদি। অতএব এ হেন তুলনায় রাগ হবে কি না বলুন ? সত্যিই হত।
তখন বুঝতাম না বিধবার যন্ত্রণা, তখন বুঝতাম না নারীর ভাবনা। নারী হয়ে ওঠার পর অন্যভাবে চিনতে শিখলাম তাঁকে। শুধু একজন নারী নয় একজন মানুষ হিসাবে দেখলাম একজন মানুষকে যিনি কতটা বিধ্বস্ত হবার পরও এত স্থিতধী হতে পারেন তাঁর লক্ষ্যে। আজও জীবনের ভেঙে পড়া যে কোনো মুহূর্তে আমি বিদ্যাসাগরের জীবনী পড়ি। বারংবার পড়ি। ভেসে আসা মানুষের কথায় যন্ত্রণা যখন বিদ্ধ করে নিজেকে তখন কঠিন হবার শিক্ষা তাঁরই তো দান।
শোভাবাজারের রাধাকান্ত দেব, কবি ঈশ্বর গুপ্ত সহ বহু মানুষ তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন। ব্যাঙ্গ পদ্য বেড়িয়েছিল ” সমাচার সুধাবর্ষণ” পত্রিকায়।
সরকারের কাছে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিরুদ্ধে দরখাস্তের সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজারেরও বেশি। তবুও কার্যে স্থির ব্যক্তিকে সাফল্য থেকে সরাতে পারে নি কোনো বাধাই। ১৮৫৬ এর ২৬ শে জুলাই আজও আমাদের কাছে চিরস্মরণীয়।
আইন তো পাস হল … এরপর ? তাঁর মাষ্টারমশাই প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ তাঁকে সাবধান করে বলেছিলেন…
” উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু তোমার অর্থ বল কই ? ” উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন , ” বিধবার বিয়ে হবেই, আমিই দেব ” ১৮৫৬ এর ৭ ই ডিসেম্বর প্রথম বিধবা বিবাহ সম্পন্ন হল তাঁরই উদ্যোগে। শুধুমাত্র তাই নয় আজ থেকে ১৬৩ বছর আগে সেই বিবাহে কন্যার সম্প্রদান করছিলেন তাঁর মা লক্ষ্মীদেবী।
তাঁর অবদান বা রচনা লেখা নয়, সে সব তথ্য সবার জানা। দু’শ বছরে তিনি এখনো ভীষণ প্রাসঙ্গিক তাঁর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে নারী ভাবনা, বাংলা সাহিত্য থেকে বাংলা ভাষার পরিবর্তন। বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছে তাঁর দ্বিশতবার্ষিকী জন্মোৎসব পালনে তাঁর ছবি, মালা , বক্তব্য , জীবনীপাঠ শেষ কথা নয়, আসলে মননে তাঁর আধুনিক ভাবনাকে গ্রহণ, বাংলা ভাষার অসময়ে তার ভাবনাকে আবার ভাবাই হোক তাঁর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।