কলকাতার স্কুলে চাকরিটা অবশেষে হয়েই গেল। যদিও তার জন্য যে অতনু খুব খুশি, এমনটা নয়। আসলে এই গ্রামটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে অতনু শেষ কয়েক বছরে। কিন্তু যে কাজে এখানে এসেছিল সে তো শেষ হয়েছে বেশ কিছুদিন – – কোম্পানির আর কোনো কাজ নেই এখানে, সুতরাং তারা পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে – – সেটাই স্বাভাবিক। এরপরের কোম্পানির কাজ নাকি রাজ্যের বাইরে – – অতনুকে সেখানে পাঠাতে চেয়েছিল, কিন্তু অতনুই রাজি হয় নি। ওর আসলে কোনোদিনই এই কাজটা ভালো লাগে না। কনট্রাক্টরি লাইনে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করা মানেই হাজারটা সমস্যা নিয়ে চলা, লেবারদের হ্যান্ডল করতে কালঘাম ছুটে যায়। যখন এই লাইনে কাজ শুরু করে তখন এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না অতনুর। বাবা মারা গেল হঠাৎ, তখন সবে এইচ এস দিয়েছে। মা তো অনেক আগেই মারা গেছেন। তারপর দাদা বৌদি বাড়িতে থাকার জায়গাটুকুও দিতে রাজি ছিল না – – তবু জোর করে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রতিদিন এত অশান্তি, আর নিতে পারছিল না অতনু। তারপর একদিন এই কাজের সুযোগ-টা আসতেই আর কিছু না ভেবেই কাজে লেগে গিয়েছিল। তারপর নানা জায়গায় কাজ করে শেষ তিন বছর এই গ্রামে। এর মধ্যে ওপেন লার্নিং থেকে গ্রাজুয়েশনটা করে নিয়েছে, আর আঁকার হাত তো বরাবরই ভালো। এর দুই কাজে লাগিয়েই একটা চাকরি জোটাতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত।
কিন্তু এই গ্রামের মানুষজন ভালোবাসা দিয়ে এত আপন করে নিয়েছিল,আজ ছেড়ে যেতে হবে বলে মন খারাপ করছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। আজ একবার
ইঁটভাটার স্কুলে যাবে – – সবাইকে জানিয়ে দেবে ওর চলে যাওয়ার কথা। এই বাচ্চাগুলোর মায়াও কি কম! এদের দু-বেলা ভাত জোটে না, শীতের রাতে গায়ে কম্বল জোটে না, বাপ মা সারাদিন ইঁটভাটায়, নয়ত ঠিকাদারের কাছে কাজ করে। স্কুল যায় কেউ কেউ, কেউ কেউ যায় না। এদের নিয়ে একদল ছেলে স্কুল মত করেছে… বেসিক এডুকেশনটুকু যাতে পায় আর কি। স্কুলে এলেই ডিম সেদ্ধ মিলবে – – এই ছিল পদ্ধতি। কাজও হয়েছিল। এই কাজে অতনুও সামিল হয়েছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি আঁকা শেখাত ও।
“তু আর আসবিক লাই?”
বাচ্চাদের এই প্রশ্নে সত্যি চোখ ভারী হয়ে আসে। মিথ্যা জেনেও বলতে হয় – – “আসব রে, আসব ।”
বাকিদের সবটুকু বুঝিয়ে বলে অতনু।
মুনিয়া আজও আসে নি। ও নাকি বলে দিয়েছে, আর আসবে না।
মেয়েটার মাথায় কি যে বিয়ের ভূত চেপেছে। কতই বা বয়স হয়েছে, আঠারো – উনিশ – – খুব বেশি হলে। কিছুদিন আগেও সবার সাথে পড়তে আসত। অতনুই প্রথম লক্ষ্য করে ওর অসাধারণ গানের গলা। কোনো প্রথাগত শিক্ষা নেই, অথচ যে কোন গান একবার শুনলেই আয়ত্ত করে ফেলে নিমেষে। তারপর থেকে অতনু ওকে বাকি বাচ্চাদের গান শেখানোর দায়িত্ব দেয়। অতনুর স্বপ্ন ছিল ওকে কোনো রিয়েলিটি শো-তে যদি গাওয়ানো সম্ভব হয় । কিন্তু গত কয়েক মাস আগেই বিট্টু বলে একটা ছেলে ওকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ছেলেটা এখানেই একটা রাইস মিলে কাজ করে। তারপর থেকেই মেয়েটার আর কিছুতেই মন নেই। অবশ্য ওর বাপ বুধনও মা-মরা মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। সেটাই স্বাভাবিকও।
অতনু চায় নি ওর প্রতিভা এভাবে নষ্ট হোক। আর একটু বয়স হলে নাহয় বিয়েটা হবে। বার কয়েক বোঝাতেও গিয়েছিল বাড়িতে – – তবে কোন লাভ হয়নি।
মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতনু। থাক, বিয়ে করেই সুখী হোক। কাল একবার দেখা করে আসবে, শেষবারের মত।
একটা শাড়ী কিনে নিয়ে গিয়েছিলো অতনু।
মুনিয়া তখন ঘরে একলা, বুধন তো কাজে। তার আগেই বিট্টুর সাথে চরম ঝগড়া হয়েছে।
মুনিয়াকে কাঁদতে দেখে পিঠে আলতো করে কাঁধে অতনু।
মুনিয়া ওকে দেখেই অদ্ভুতভাবে রিঅ্যাক্ট করে ওঠে। ছিটকে সরে যায়। চিৎকার করে ওঠে হিস্টেরিয়া রোগীর মত।
“কেন আসো তুমি বারবার আমার কাছে? কিসের এত লোভ! চাও না না আমি সুখী হই আমি বিট্টুর সাথে! একলা মেয়েমানুষ ঘরে জেনেও কেন আসো – – – চাও তো বদনাম হোক, বিট্টু আমায় ছেড়ে চলে যাক! তাহলেই কাজ হাসিল হয়ে যাবে তোমার, তাই না!”, এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁফাতে থাকে মুনিয়া।
হতভম্ব হয়ে যায় অতনু। এসব কি বলছে মুনিয়া। লোভ… মুনিয়ার ওপর!! যাকে ছোট বোনের মত দেখেছে বরাবর!!
অপমানে মুখ কালো হয়ে গেছে, কান মাথা সব ঝাঁ ঝাঁ করছে, কোনো রকমে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে এল। টিনের ট্রাঙ্কের নিচে থেকে বহু পুরনো, হলদেটে হয়ে যাওয়া একটা ফটোগ্রাফ বেরোলো বহুদিন পর।
মায়া, অতনুর বোন – – – ক্লাস সিক্সে পড়তে জ্বরে মারা গেছিল। মায়াও খুব সুন্দর গান গাইত মুনিয়ার মত।
কড়ি কাঠের সাথে মুনিয়ার জন্য কেনা নতুন শাড়িটা দিয়ে মজবুত ফাঁস বানাতে বেশি সময় লাগে নি। গলায় ফাঁস দিয়ে মুহূর্তের জন্য থমকালো অতনু—কিন্তু তখনই আবার মুনিয়ার কথাগুলো কানের মধ্যে ইকো হতে লাগল। বাঁ-হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে এক ধাক্কায় ফেলে দিল চেয়ারটা। কয়েক মিনিটের জন্য ছটফট করল শরীরটা – – – তারপর সব স্থির।