ছেলেটি এবার আঙুল তুলে বললো, ” নতুন বাবু, ওই যে জোরা শিমুলগাছ! ওইখানেই নন্দাইমিস্তিরির মন্ডি! আমাকে জোরা শিমুলগাছ দেখিয়ে দিয়ে ছেলেটি বললো, ” এবার আমি যাই, মায়ের জন্য কাপড়ে ফুল তোলার রঙিন সুতো কিনতে হবে! “
আমি তাকে ধন্যবাদ জানাবার আগেই সে হাঁটা দিল। আমি জোড়া শিমুলগাছ লক্ষ্য করে এগোলাম।
(পর্ব – ৪)
দেখলাম , হরেক কিসিমের পসরা সাজিয়ে হাটুরেরা হাটের বিভিন্ন জায়গায় সব দলবেঁধে বসেছে। বড়ো বড়ো তাবু খাটিয়ে নেপালি ব্যপারিরা রঙবেরঙের পাথর, তাবিজ, মাদুলি, পাহাড়-প্রমাণ রুদ্রাক্ষ মাটিতে ঢেলে বিক্রি করছে ! কেউ কেউ আবার তাদের কাঁধের ঝোলাতে করে হিং, কেশর, জাফরান, পাহাড়ি গাছের শেকড়বাকড় ঘুরে ঘুরে খদ্দেরদের কাছে গিয়ে বিক্রি করছে ! হাটের একধার জুড়ে বসেছে সারি সারি ফলের দোকান! সেখানে থরে থরে সাজানো আছে কাঁদি ভর্তি ডাব, কলা, খোসা ছাড়ানো নারকেল, আখরোট, কিসমিস, পেল্লায় পেল্লায় আঁখ, রাঙাআলু, আম, পেয়ারা, ঝুড়িভর্তি দারিম্ব! লক্ষ্য করলাম, হাট ফিরতি মানুষজন কেউ কেউ সেইসব ফলমূল কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছে । কেউ কেউ আবার, ঘাড়েগদ্দানে মালপত্র চাপিয়ে খালায় করে কাটা ফলমূল দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই খুব মজা করে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে ! আর, দোকানিরা তাদের মাছের আঁশের মতো পাতলা রূপোলি ছুরি দিয়ে সেইসব ফলপাকড় কেটে পরিচ্ছন্ন করে শালপাতার খালায় করে খদ্দেরদের হাতে হাসিমুখে ধরিয়ে দিচ্ছে !
হাটের প্রায় মাঝখান দিয়ে ঠিক ছবির মতোই , বয়ে গেছে সরু একচিলতে একটা পাথুরে খাল! ছোট ছোট কাঠের পুল দিয়ে সহজেই খালটার এপার ওপার করা যায়! এ-রকমই ছোট্ট একটা পুল দিয়ে সেই খাল পেরিয়ে আমি ভুলভুলাইয়ার হাটের আরেক প্রান্তে গিয়ে পৌঁছালাম ! পুলটার উপর দিয়ে পেরোনোর সময় মনে হলো কেউ যেন সেই খালের ভিতর বরফগোলা জল ঢেলে দিয়েছে ! আর,তার সেই ঠাণ্ডা হাওয়ায় আমার শরীরের ভেতরেও যেন কাঁপুনি ধরে গেল! আমি খালের ওপারে পৌঁছে দেখলাম, কয়েকটা চালাঘরের উঠোনে মাটির ভাঁড়ে করে বিক্রি হচ্ছে মহুল থেকে তৈরি টাটকা মদ। সেখানে নারী পুরুষের ভীড় যেন একেবারে উপচে পড়ছে! আমি তাদের সেই উদ্দাম হুল্লোড়-হৈচৈ পেরিয়ে খানিকটা এগোতেই, দেখলাম , একটু দূরেই হাটের একটা বেশ বড়ো অংশ জুড়ে মাছধরা জাল, মাটির তৈরি গৃহসজ্জা , রান্নার নক্সাকরা তৈজসপত্র, ঝলমলে রঙিন শাড়ি, ড্রাগনের পেল্লায় পেল্লায় ছবি আঁকা স্কার্ফ , রুমাল, ছাতা, রাঙাপেড়ে ধুতি, ময়ূরকণ্ঠী চাদরের পসরা ঘিরে ভীষণ ভীড় জমে উঠেছে!
আমি ধীরে ধীরে জোরা শিমুলগাছের নীচে নন্দাই মিস্তিরির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।মাথা নীচু করে নন্দাই মিস্তিরি একমনে কাজ করে যাচ্ছে। শরীরের গড়ন দেখে তার বয়স আন্দাজ করা মুসকিল । লক্ষ্য করলাম, হাতের কাজ সারা হলেই, নন্দাই মিস্তিরি সেগুলোকে পরপর সাজিয়ে রাখছে আর, খদ্দের এলে সেই সমস্ত জিনিসপত্রগুলো যথাযথভাবেই খদ্দেরদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে তারপর, পাশের নক্সাকরা বাক্সের ঢাকনাটা খুটুস করে খুলে পাওনা -গণ্ডাগুলো গুনেগেঁথে ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখছে! খানিক দূরে দাঁড়িয়েই লক্ষ্য করলাম, বেশ কয়েকটা সাইকেল একটা বাঁশের খুঁটিতে পর পর ঠেসানো আছে। আমিও আমার সাইকেলটা সেখানে রাখতে যেতেই নন্দাই মিস্তিরি বলে উঠলো , ” উঁহু , উখেনে লয়!হাতে লিয়ে রাখুন, আমি ডেকে লিব! ” দেখলাম , আসেপাশে বেশ কয়েকজন লোক আমার মতোই সাইকেল হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেই বকবক করে একনাগাড়ে গাল -গল্প করছে। একটি লোককে দেখলাম, সেই ভীড়ের থেকে একটু দূরে সাইকেলের ক্যারিয়ারে ঠেস দিয়ে বসে নিজের মনেই বাঁশিতে এক অদ্ভুত সুর তুলে চলেছে !
নন্দাই মিস্তিরির হাতের কাজটা সারা হতেই , “ও লোটন! ” বলে কাকে যেন হাঁক পারলো ।দেখলাম, শাড়ির স্তূপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে একটা লোক ” যাইগো নন্দাই দাদা ! ” বলে যথারীতি এগিয়ে এলো! লোকটা এগিয়ে আসতেই, নন্দাই মিস্তিরি উঠে গিয়ে দোকানের একপাশে রাখা কুঁরির পরিস্কার জলে হাত ধুয়ে এসে শুকনো গামছায় ভালো করে মুছে নিল তারপর , পাশের দাওয়ায় গিয়ে পেতলের পাইয়ে করে মেপে মেপে লোকটাকে চাল দিয়ে এসে নন্দাইমিস্তিরি আবার আগের জায়গায় বসে পড়লো। মাঝখানে শুধু একটা শব্দ কানে ভেসে এলো , খুটুস ! দেখলাম, চালের পুঁটুলিটা ভালো করে বেঁধে নিয়ে কাঁধে ফেলে লোকটা সেই পড়ন্ত বিকেলে হনহন করে গাছের সারির ভিতর দিয়ে হাঁটা দিল।