• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে গদ্যে অমিতাভ মৈত্র (গল্প – ১ ।। পর্ব – ১)

অমিতাভ মৈত্র, বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও গদ্যকার। কর্মজীবনে উচ্চপদস্থ সরকারী প্রশাসকের দায়িত্ব সামলেছেন।

ক্রাচ, সূর্যঘড়ি ও সমুদ্র  

১।

মাঝরাতে তারায় ভরা আকাশের নিচে, স্থিমিত হয়ে আসা ঢেউয়ের সামনে দুটো ক্রাচ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। শান্ত আকাশ, শান্ত পৃথিবী, শান্ত জল আর শান্ত বুজে আসা দুটো ক্রাচ। বাতাস আর জলের অস্ফুট শব্দ ক্রাচদুটোর প্রতীক্ষাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, কুর্নিশ করছে তাদের একাগ্রতাকে। বালির ওপর ছড়ানো খাবারের আমিশাষি দোকানের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো কুকুরগুলো এখন বালির ওপর ঘুমিয়ে। স্বপ্ন দেখছে দ্রুত হারিয়ে যাওয়া বালি কাঁকড়াও। ক্রাচ শুধু নিজেকে দেখছে। ভাবছে তার শুকনো কাঠের শরীরে পাতলা বরফের মতো কোনো মাংসের স্তর জেগে উঠবে একদিন। রক্তপ্রবাহের অনুভূতি, যা সে জানে না, একদিন সেও টের পাবে নিজের শরীরে। পায়ে মশা বসলে যে মৃদুতম শিহরণ সে টের পেত পোড়া লোকটি, নিজের অস্তিত্বে সেই শিহরণ চায় সে। দংশনে আঘাতে আনন্দে সে কেঁপে উঠতে চায় সেই অশক্ত পায়ের মতো।
যে খোঁড়া ভিখারির সঙ্গী হয়ে দশ বারোটা বছর কেটে গেল, সেই মানুষটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। নিজের পায়ের দিকে তার খেয়াল ছিল না, কিন্তু সারাদিনে একবার অন্তত সে পরীক্ষা করত ক্রাচকে, ডাক্তারের মতো। কখনও ইট ঠুকে, কখনও ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো জড়িয়ে ব্যবহারের উপযুক্ত করে রাখত তাকে।
ট্রেনে ভিক্ষা করত লোকটা। গেটের পাশে কোনো সিটের নিচে ক্রাচ রেখে ছেঁচড়ে শরীর টেনে দাঁড়ানো আর বসে থাকা যাত্রীদের হাঁটু ছুঁয়ে ভিক্ষা চাইত সে। তার সামনে কোনো মুখ নেই, দৃশ্য নেই, যাওয়া নেই, ফেরাও নেই। হাজার হাজার হাঁটু আর জুতো পরা পা—এর মাঝখান দিয়ে সরীসৃপের মতো কোনোভাবে তার জীবন চলে যায়। মাঝে মাঝে ছোট্ট ধাতব শব্দ ওঠে তার কৌটোয়, মাঝে মাঝে হাতের আঙুল কেঁপে ওঠে মাড়িয়ে যাওয়া জুতোর চাপে। রাত্রে যখন নিজেকে ঠেলে, জাগিয়ে বাড়ি ফিরত লোকটা তার মুখে কোনো আলো থাকত না, অন্তর্দৃষ্টি থাকত না।
চলমান জীবন ছেড়ে প্ল্যাটফর্মের একপ্রান্তে শুয়ে তার দিনাবসানের দিনগুলো পার করেছে লোকটা। দরকার নেই বলে ক্রাচ সে বর্জন করেছে। হয়তো এখন তার ক্রাচ আর সে কয়েকশো মাইল দূরত্বে আর যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গরম চকচকে ধারালো বালির মরুভূমি। সময়ের সাথে বদলে গেছে ক্রাচও। এক অস্তিত্বহীন অস্তিত্বে খোঁড়া মানুষটির সাথে জড়িয়ে ছিল সে একদিন। প্রতিদিন সেই মানুষটির সাথে সে ঘর ছেড়ে বেরোনো, সারাদিন তার শরীরের ভর বহন করা; এই পরজীবীর জীবনে দ্রোহ আসত মাঝে মাঝে। ঘৃণা আর আত্মকরুণা আসত। নিজের অসার শক্তিকে সংযত করে এরপর একদিন সে জীবনে প্রথমবার উঠে দাঁড়াল বিশ্বজয়ীর মতো, তারপর একদিন সে মাঝরাতের তারাদের সাক্ষী রেখে নেমে এল রাস্তায়—নিজের পা খুঁজে পেতে। তার বেঁচে থাকার প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠল মাঝরাতের এই একার অভিযান। ঘুমন্ত অন্ধকে রেখে একা রাস্তায় বেরিয়ে পড়া।
ক্রাচ বুঝেছিল এবার সে ছেড়ে যেতে পারে লোকটাকে। বাধা নেই কোথাও। তবু এই হাঁটার সামর্থের মধ্যে তার মুক্তির পুর্ণাবয়ব নেই। তার অর্জন সবেমাত্র শুরু হলো। গাঢ়-দাগ রাখতে হবে তাকে এবার। বাতাসে উড়ে আসা বালি যেমন একটু একটু করে মরুভূমির ক্ষতগুলো ঢেকে দেয়, তার কাঠের শরীরে সেভাবেই খুব আস্তে আস্তে ফুটে উঠবে রক্ত, মাংস, ত্বক আর শিরা উপশিরার নতুন স্পন্দন ও রণন। তারপর সে নিজেই খুঁজতে বেরোবে তার বাবাকে, সেই খোঁড়া ভিখারিকে, যে তাকে জীবন দেখিয়েছে, যে তাকে রাস্তায় নামার মহার্ঘ সুযোগ দিয়েছে, যে সুযোগকে একদিন শৃঙ্খল বলে মনে হতো তার।
মাঝরাতের এই নির্জনতম সমুদ্রতীরে এক শান্ত নক্ষত্রের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে ক্রাচ চাইছে সেই লোকটার কাছে ফিরে যেতে। নিজের রক্তমাংসের সমর্থ পায়ে সেই অসমর্থকে বাকি জীবনটুকু বহন করতে, যাতে সে হয়ে উঠতে পারে সেই লোকটার এক সম্প্রসারিত অস্তিত্ব। তখন সেই লোকটাও হয়তো আংশিকভাবে ক্রাচের জীবনে মিশিয়ে নেবে নিজেকে, নিজের সীমাবদ্ধতা ছেড়ে ভার নেবে অন্য কারো, এই রাত্রির মতো নিঃশব্দে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।