• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবহ শ্রী সুতনু হালদার বিরচিত (পর্ব – ২)

আলাপন

(আত্মজৈবনিক কাব্যোপাখ্যান)

(৬)
আলাপচারী ফোনে তার ঘুমন্ত কণ্ঠস্বর শুনতে আমার বড্ড ভালো লাগে, ঠিক সন্ধ্যা নাগাদ মৃদুমন্দ বাতাসের প্রতিলিপি স্বরূপ সেই কণ্ঠ আজ হঠাৎ আমাকে আবার অকৃপণ হস্তে পাখির উচ্ছলতা দান করল। নদীর স্রোত যেমন তার ছলাৎছলাৎ শব্দে প্রতিটা ঢেউকে মাতাল করে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়, আমিও তেমন মিছিল ভাঙা ঘুমন্ত কণ্ঠস্বরের ভাষা পান করা মাতাল মুদ্রা রাক্ষস…
সামনে যে শ্মশানের রাস্তা নেমে গেছে সেই রাস্তাতেই বাতাসের চিরস্থায়িত্বটা বজায় থাকে, অথচ কয়েকটা সুসামঞ্জস্য অবরোধ যখন কণ্ঠরোধ করতে উদ্যোগী হয় তখন কিছুটা মেটামরফোসিস বিলাস আড়মোড়া ভাঙা ক্লোরোফিলকে চির-রোমান্টিক করে তোলে; প্রতিটা অনুভূতির বাকলে রঞ্জক মাখাতে মাখাতে সময় এগিয়ে চলে।
একটানা ঊনিশ মিনিট পরে একটা পালতোলা নৌকা তোমার স্রোতের অনুকূলে ভাসতে চেয়েছিল, গাছেরা রূপালি জ্যোৎস্নায় স্নান করতে চাইলে বাতাস গেয়ে উঠল-
“কানুর পিরীতি চন্দনের রীতি ঘষিতে সৌরভময়”
মাটির সৌন্দর্য তাকে আরো মহনীয় করে তুলল। শিল্পীর আন্তরিকতা সেই মূর্তিকে অনিন্দ্যসুন্দর করে উপস্থাপন করল, ভাষা দিল রক্ত…
প্রাণ প্রতিষ্ঠা হ’ল-
রোদ্দুর স্নাত অমলকান্তির…
(৭)
অন্তরীক্ষে একটা তুমি ডাক ভাসিয়ে দিলেও নীল জ্যোৎস্নায় সবাই প্রেমিক হতে পারে না! আমাদের বাড়ির থেকে কয়েক মাইল দূরে যে ব্রহ্মশ্মশান আছে কখনও কখনও তারকাছে অনেক পরিযায়ী পাখি চলে আসে, সেখানকার সমস্ত মৃত্তিকা আমাকে চেনে, সেখানকার নীল জ্যোৎস্নাগুলো আমাকে আলিঙ্গন করে…
অন্তরীক্ষের আজীবন সঞ্চিত নিশ্বাসপ্রশ্বাসের প্রাচুর্যে ঘাসের আস্তানায় এক জাতিস্মরের বসবাস। তার মৃগনাভিতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না; শাল্মলী তরুতলে আখড়াবাড়ির বাউলটি একতারায় গান ধরলে আমি হাতে তুলে নিতাম মাটির সেতার। একতারার সঙ্গে সেতারের একটা প্রেমিক-প্রেমিকা ব্যাপারস্যাপার থাকে। নিখিল বিশ্ব তখন অপার বিস্ময়ে শুধু তোমাকেই খোঁজে…
তিরতির করে অনবরত উড়ে চলা পাখিটি যেন ঠিক তখনই আপন খেয়ালে গেয়ে ওঠে-
‘আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে ভেতর দুয়ার খোলা’
শতবর্ষ জুড়ে মাঝ দরিয়ায় উদ্ভ্রান্ত
বংশীধ্বনিতে চির চঞ্চলা হয়ে ওঠে যমুনার কূল…
(৮)
ঝাপসা রোদ্দুরে ফেলে আসা সেই বিকেলগুলোর ত্বকে যখন খাজুরাহের ভাস্কর্য ভরিয়ে দিতাম, তুমি হেসে উঠতে অথচ নিখুঁত পলিমাটি ছেনে ছেনে গড়ে তোলা কদম্ব তলের বংশীধ্বনিকেই ভুল করে মাথুর ভাবতে!
আজ হয়ত জেনে গ্যাছো প্রতিটা বৃষ্টি ফোঁটায় কীভাবে খাজুরাহো ফুটিয়ে তুলতে হয়। দিন যখন কিছুটা প্রৌঢ়ত্বে বিচরণ করতে শেখে তখন চিন্তাগুলো ক্রমশ খাঁটি রোদ্দুরের অপেক্ষা করে।
একটার পর একটা সিঁড়ি টপকানো চোখের উষ্ণতায় লুকিয়ে রাখা নীল জ্যোৎস্নাগুলোর শীৎকার তুমি সেই বিকেলগুলোতে কিছুতেই বুঝতে চাইতে না!
ক্যানভাস জুড়ে খেলা করত এক মায়াবী সান্ত্বনা…
এরপর স্বভাবতই বৃষ্টি আসত। আমরা দুজনেই তখন বৃষ্টিতে খুব ভিজতাম। তখন ওই ভেজাটাই দুজনের একমাত্র পছন্দ; একমাত্র সম্বল
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো অনেকটা নেশার আকার নিয়ে রিনরিন শব্দে বেজে উঠত; উন্মুখ কুয়াশায় নিজেই হয়ে উঠতাম পৃথিবীর আদিমতম সন্তান; সলজ্জিত আড়ষ্টতায় মেরুদণ্ড জুড়ে কেউ দাগিয়ে দিত নক্ষত্রদাগ
তখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত একটা বকুল গাছ, তারপাশ দিয়ে সন্ন্যাসীর মতো হেঁটে চলত নদী; নিশ্চুপ চারিদিক, মন্ত্রের বলিষ্ঠতা নিয়ে এগিয়ে আসত বাতাস…
বাতাস আমার অনেকদিনের বন্ধু, সেই বাতাসের সামনেই একদিন আমি ভুলে গেলাম নিজের পূর্বনাম! পূর্বের সমস্ত পরিচয় যেন বাতাসকে অস্বীকার করে নদীতে মিশে যেতে উদ্যত হ’ল!
নাভিচক্র থেকে উত্থিত পূর্ণিমা সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে উঠল ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’…
(৯)
এসো, বাহারি পানপাত্রে সেবায়েত হাত রাখি। সমস্ত গুপ্তবিদ্যা খননের প্রাচুর্য গাছের অন্যমনস্কতায় ঘুমিয়ে, আস্তে আস্তে রাত কেটে ভোরের আলোর সুরে ক্ষুধার্ত সূর্য বড়ো হয়…হঠাৎই বর্ষাকাল অষ্টাদশী যুবতি হয়ে উঁকি দ্যায়, সুডৌল স্তনাভারে পোয়াতি বর্ষা আমাকে চিরটাকাল মাঝি বানিয়েই রেখে দিল!
বাড়ির পাশের মেহগনি গাছের নীচে প্রতিদিন একটা গরু জিরিয়ে নিতে নিতে জাবর কাটে, ধ্রুপদী ব্যস্ততায় নিজেদের বসন্তকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপারটা ঠিক ততোটা আরোপিত নয় কিন্তু মাটিতে মিশে থাকা এক পড়ন্ত রোদের গন্ধ মগ্ন চৈতন্যকে যেভাবে সমাধিস্থ করে তার সঙ্গে মিল থাকে।
ছোটোবেলার স্বপ্নগুলোতে ফিরে আসা সেই আশ্চর্য প্রদীপের মেঘরূটে লেগে থাকে এমনই এক অত্যাশ্চর্য জলতরঙ্গ। অথচ কী ভীষণ সমাধিস্থ!
(১০)
ধূম জ্বরে মেঘবর্ণ একটা চাঁদনী রাত ফিরে আসে। ঝিরঝিরে কুয়াশায় সমস্ত পথ যখন নিজেকে খুন করতে উদ্যত ঠিক তখনই আমার জ্বরের প্রকোপ আরো বেড়ে যায়! কপালের জলপটি দ্রুত উষ্ণ হতে হতে নিজেকে ভাঙতে থাকে; আর সেই মুহূর্ত থেকেই একটা গন্ধ আমার শরীরকে সুস্থ করে তোলে, ওই গন্ধটা মৃত্যুর মতো শীতল অথচ জ্বরের থেকেও উষ্ণ! জানলা দিয়ে উঁকি দেওয়া চাঁদের উৎকণ্ঠা কমতে থাকে; তারপর বেশ কয়েকদিন আর চাঁদবদনীর কোনো দ্যাখা মেলে না!
ছোটোবেলার যাবতীয় অপ্রাপ্তি কবিতা হয়ে কাছে বসে, গায়ে হাত বুলিয়ে দ্যায়। কিন্তু এখনকার অপ্রাপ্তি নিয়ে সেও নির্বিকার! বেলা গড়াতে গড়াতে আবার রাত নামে, আমি বুঝতে পারি এই রাত অমাবস্যার। পূর্ণিমার ঘোরে একটা সন্ন্যাসী থাকে, যেটা অমাবস্যায় থাকে না। থাকে না বলে আমার অবশ্য তেমন মাথাব্যথা নেই, যদি সেই সন্ন্যাসী কপূর্রের মতো উদ্বায়িতা রোগাক্রান্ত হয় তাহলে একটা রিনরিনে স্বর ঠিক যেন জন্মস্থানের করতলে একটা ভাঙাচোরা জ্যোৎস্নাময় আকাশকে নিয়ে আসে। আমরা যারা এখনো নিজেদের মানুষ বলে ভাবতে ভালোবাসি এমন সময়ে যথারীতি তারা মাছরাঙা স্বভাব পরিত্যাগ করে সরাসরি দরদী পুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। রক্তবসন আর শুভ্রবসনের মধ্যেখান দিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতে রক্তের যেসব দাগ থাকে তারা চিরটাকাল নিজের জন্মদাগকে অস্বীকার করে। তবুও আমরা ওই দাগটিকেই জীবনের হিমশৈল মনে করে ভুল করি। প্রতিটা হিমশৈলে অস্তরাগের গন্ধ মিশিয়ে ধ্যান আর মুদ্রার সঙ্গমে ফুটতে থাকে আদি-অনন্ত ভোরবেলা।
(চলবে)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।