জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ১০)

মায়া – মফস্বল ও ক্যাংলাসপার্টিরা 

পর্ব ১০

সিনেমা সিনেমা

রাসমাঠ পেরিয়া বাঁহাতে কোশাঘাট, শিবমন্দির ফেলে দুটো পুকুরের মাঝে একটা সরু রাস্তা দিয়ে বাঁদিকে বেঁকলেই শো হাউস। সেখানে মেয়েদের দোতলায় আলাদা বসার ব্যবস্থা এবং টিকিটের দাম পঁচাত্তর পয়সা।এই ব্যবস্থা করে গেছেন ঝিল্লির দাদু। এইরকম যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে এ শহরের মহিলারা যে ম্যাটিনি শো দেখতে পাড়া ঝেঁটিয়ে যাবেন, তাতে আর সন্দেহ কি? আমার মা-ও যেত এবং আমাকে বগলদাবা করে নিয়ে যেত। আক্ষরিক অর্থেই অক্ষর পরিচয়ের আগে থেকে সিনেমা দেখার শুরু। সিনেমা শুরুর আগে যেসব নাম দেখাত, তার একটাও আমি পড়তে পারতাম না, তাই মাকে বলে রাখতাম কখন সিনেমা শুরু হবে আমাকে বলে দিতে। এদিকে সিনেমা শুরু হলেও ছিল মহা বিপদ। মেয়েরা কাঁদতে খুব পছন্দ করে, সিংহভাগ দর্শকই মেয়ে, তাই চলচ্চিত্রনির্মাতারা বেশিরভাগ দুঃখের সিনেমাই বানাতেন। দুঃখের মতো এত হিট কমই হয়। আর সেসব সিনেমা দেখে আমার বেজায় কান্না পেত। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না নয়, তারস্বরে কান্না। ফলতঃ লাইটম্যান (সেসময় মনে হয় সিনেমাহলে শব্দভেদী বাণ ছোঁড়া শিখে এলে তবে লাইটম্যান হওয়া যেত!)ঠিক   ছুটে এসে আমাদের গায়েই আলো ফেলত এবং সারা হলকে জানিয়ে বলত ‘বাচ্চা নিয়ে বাইরে যান, বাচ্চা নিয়ে বাইরে যান!’ আমি তখন বিল্বমঙ্গল- চিন্তার দুঃখে কিংবা ফুলওয়ালি রজনীর ভাগ্য বিপর্যয়ে কিংবা অন্ধ ও খোঁড়া দুই বন্ধু লালু ভুলুর দুঃখে হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছি। মা অপ্রস্তুত মুখে আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এসে বলত ‘আর যদি কখনো তোকে আনি! কতবার বলব, ওগুলো মিছিমিছি, সত্যি নয়!’
এ কথা বললে সত্যের অপলাপ করা হবে, আমি শুধু মিছিমিছি দুঃখ দেখেই কাঁদতাম।বাস্তব দুঃখ দেখেও সমান দক্ষতায় কান্নার ক্ষমতা আমার ছিল। বিদ্যাসাগরের জীবনীতে ছিল, রামচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর একজায়গায় অদ্ভুত মিল। পুরুষমানুষের কাঁদতে নেই- এমন মিথকে মিথ্যে করে তাঁরা সারাজীবন কান্না পেলেই কেঁদেছেন এবং উচ্চৈস্বব্রে কেঁদেছেন। আমার জীবনের ঊষাকালে বিবিধ মহাপুরুষের অনেক ঝলক দেখা গিয়েছিল। বাবার জেদে একটুর জন্যে মিস হওয়া রামকৃষ্ণের মতো উনুনের ছাইমাখা-প্রতিম ইলিশের রক্তমাখা জন্মকথা। তারপরেও রবীন্দ্রনাথের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অক্লান্ত অধ্যাবসায়ে ইস্কুল পালানো, এবং এই বিদ্যাসাগরীয় ক্রন্দনপরায়ণতা। কালের কুটিলা গতি আমাকে বারবার ধোপার চৌবাচ্চায় চুবিয়ে নীলবর্ণ শৃগালের মতো আসল রঙ বার করে ছেড়েছে। তবে এখনও একটা ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের মতো কাঁদতে ইচ্ছে করে। শেষ বয়সে নাকি বিদ্যাসাগর ডাক ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন ‘এত বয়স হয়ে গেল, পড়াশনা করার সময় পেলাম না!!’ আমারও, ওইরকম, একেবারে ন্যায্য কারণে, মাঝে মাঝেই ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। বেলা যে পড়ে এল লালাবাবু।
একবার পাড়ার একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে। পরেরদিন তাকে বিদায় জানাবার তোড়জোড় চলছে। মেয়েটি আর তার বাড়ির লোক কাঁদছে, খুব স্বাভাবিক। পাড়াপ্রতিবেশী, যারা ভিড় করে দেখতে এসেছে, তাদের চোখ ছলছল করছে। সেটাও স্বাভাবিক। দেখতে দেখতে আমারও ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। আমি রীতিমতো হাঁউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। জাস্ট পাড়াতুতো দিদি, আমার পছন্দের তালিকাতেও নয়, সে চলে যেতে এত কাঁদছি দেখে বাড়ির লোক অবাক হয়ে নিজেদের হকের কান্নাটাও কাঁদতে ভুলে গেল। আমি কিন্তু অবিচলিত ভাবে কেঁদেই চলেছি।
তবে সেই সময় সিনেমা দেখে কান্নাটা একটা গণ-হিস্টিরিয়া টাইপ ছিল, অন্তত মেয়েদের মধ্যে। শুনেছি পঞ্জাব হরিয়ানার ধাবায় চায়ের কড়াত্ব মাপা হয় মাইল দিয়ে, ওরা  বলে মিল। যেমন এক মিল কড়ক চা, দো মিল কড়ক চা। মানে ওই চা খেয়ে এক মাইল বা দু মাইল অব্দি বিন্দাস লরি চালিয়ে যেতে পারেন ড্রাইভার। সেরকম, কান্নার ক্ষমতা মাপার একক ছিল রুমাল। সিনেমা যাবার সময় মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করা হত কটা রুমাল লাগবে। খুব ক্রন্দনপটীয়সী হলে তার সিনেমার সঙ্গী পাওয়া মুশকিল ছিল। তবে সে কান্না অবশ্যই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না, যাকে বলে sob। এইসব নিয়ে নানা মজার গল্পও চালু ছিল। ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ হচ্ছে। শেষ দৃশ্যে শ্রীচৈতন্য আস্তে আস্তে সমুদ্রে মিলিয়ে যাচ্ছেন। খুবই মর্ম্ন্তুদ দৃশ্য সন্দেহ নেই। ‘নিমাই, চলে গেলি বাবা!’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠে এক বৃদ্ধা পাশের সুবেশা ফ্যাশনদুরস্ত মহিলার আঁচলে নাক মুছে ছিলেন। অবশ্য এ আমার শোনা কথা , স্বচক্ষে দেখা নয়। তবে আবেগের মুহূর্তে কী না হয়! একজন বিখ্যাত রকবাজ বলেছিল ‘হিট অব দা মোমেন্টে বাবাকেও শুয়োরের বাচ্চা বলা যায়!’
বৃদ্ধার কথা যখন উঠলই, তখন মনে পড়ে গেল একদল বৃদ্ধা গেছেন ‘হরেকৃষ্ণ হরেরাম’ দেখতে। ভক্তিমূলক ছবি ভেবেই গেছেন। জিনাত আমনের ‘দম মারো দম’ দেখে তাঁদের তো আক্কেল গুড়ুম। তাঁরা নাকি বাইরে বেরিয়ে কাউন্টারে পয়সা ফেরত চেয়ে ব্যপক হুজ্জুতি করেছিলেন।
শুধু কাঁদা বা হুজ্জুতি নয়, একেকজন ছবি দেখতে গিয়ে অদ্ভুত সব আচরণ করত। সঙ্গী হিসেবে তারা ছিল বিভীষিকা। আমার এক মাসী, হিরো যখন ভিলেন পেটাত, তখন এমন হাততালি দিত, যে সারা হল ঘুরে আমাদের দিকে তাকাত। কেউ উত্তেজিত ভাবে পাশের লোককেই এক ঘা দিয়ে বসত। সম্ভবত ক্লাস এইটে উঠে আমরা বন্ধুরা পুজোর ছুটি পড়ার দিন দুটি রিচুয়াল চালু করেছিলাম- একটি শাড়ি পরে যাওয়া এবং স্কুল ছুটির পর একটি সিনেমা দেখা। সেবার রাম তেরি গঙ্গা মইলি দেখতে গেছি আটটি মেয়ে মিলে। মন্দাকিনী ঝরনার জলে স্নান করছে, পরনে রাজ কাপুরের পেটেন্ট সাদা ফিনফিনে শাড়ি।  হিমাচলি সমীরণ এসে সেটুকুও উড়িয়ে নিয়ে গেল।আমরা সবাই যেন আত্মীয়বিয়োগ হয়েছে –এমন মুখ করে দেখছি। কারণ নন্দিতার জামাইবাবুর হল, বেচাল দেখলে বাড়িতে রিপোর্ট চলে যাবে। আমার পাশে বসে স্বাতী বক্সী, বাবলি। সে প্রবল উত্তেজলায় আমার হাত খামচে ধরল। বেরিয়ে তাকে যাচ্ছেতাই করলাম ‘আর কোন দিন যদি তোর সঙ্গে সিনেমা দেখি’ সেই মা যেমন বলত আমাকে। যদিও তারপরও দেখেছি ওর সঙ্গে। আর অবশ্য দেখতে হবে না কোনদিন। বছর তিনেক আগে সে চলে গেছে ক্যান্সারে, হয়তো রাজ কাপুরের সঙ্গে এ নিয়ে তার কথাবার্তাও হয় আজকাল।
কিন্তু শো মাস্ট গো  অন। কথাটা হচ্ছে, সেসময় সিনেমাটাই ছিল একটা টোটাল বিনোদন, গিন্নিদের শ্বাস ফেলার জায়গা, বা প্রেমের ডেটিং, কিংবা নতুন জামাইবাবুর ঘাড় ভাঙতে, বন্ধুদের সঙ্গে বাজিতে হারজিতে, বাড়িতে অতিথি এলে তাকে আপ্যায়িত করতে, এককথায় যেকোন বাহানায়, রণে বনে জলে জঙ্গলের মতো আমাদের যাবার জায়গা ছিল একটাই। সিনেমাহল। এমনকি ছ বছর বয়সে যখন দার্জিলিং যাওয়া হল, তখন সবাই টাইগার হিল গেল, আমার শরীর খারাপ বলে বাবা আমাকে নিয়ে থেকে গেল হোটেলে। সেদিন আমাকে ভোলাতে বাবা  সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। হলের নাম মনে নেই। সিনেমার নাম ক্রেজি বয়। চারটে দুষ্টু ছেলের গল্প। একটা দৃশ্য স্পষ্ট মনে আছে। একটা হুড খোলা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে একটা টাকমাথা লোক। ছেলে চারটে বাইক চালিয়ে তার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল, মাথায় চাকার দাগ ফুটে উঠল! পরে, অনেক অনেক বছর পরে শান্তিনিকেতনে ভাঙ্গা মেলায় গিয়ে ৩১ ডিসেম্বরের প্রবল শীতের রাতে কিছুই করার নেই বলে সোজা সিনেমাহল। বিচিত্রা হলে চলছিল কুছ কুছ হোতা হ্যায়। হলের বাইরে আর ভেতরে দুর্দান্ত একটা কন্ট্রাস্ট। বিশুদ্ধবাদীরা আঁতকে উঠছেন নিশ্চয়। রবীন্দ্রনাথ আর শাহরুখ! তবে বিশুদ্ধবাদীদের আমি সযত্নে এড়িয়ে যাই। কে না জানে বিশুদ্ধবাদ থেকে মৌলবাদ খুব দূরে না।
আমার আবার সিনেমা দেখার কোন বাহানার দরকার পড়ত না। স্রেফ সিনেমা দেখার জন্যেই দেখা, একা একা কতবার। সেসময় ছোট ছোট শহরে সিনে ক্লাব ছিল। তারা সাধারণত মনিং শো করত। বাড়িতে কার্ড আসত, সাতসকালে সিনেমা দেখতে যাবার সময় কারো ছিল না। তাই কার্ড নষ্ট না করার মহান দায়িত্ব পালন করতে আমি একা একাই চলে যেতাম মাঠ পেরিয়ে। আর এইভাবেই খুব ছোট থেকে যাদের সিনেমা দেখেছি, বড় হয়ে আবিষ্কার করেছি তাঁরা ওয়ার্ল্ড সিনেমার এক একজন কিংবদন্তী।
একবার প্রবল বৃষ্টিতে চরাচর ভেসে গেছে। রাস্তাঘাট জনশূন্য। কিন্তু আমাদের দুটো সিনেমার টিকিট কাটা আছে যে। তাও আবার নাইট শো-তে।  আমি আর  পাড়ার  এক দিদি সেদিন যে একরোখা জেদে  সাঁতরাতে সাঁতরাতে সিনেমাহলে পৌঁছলাম, তার সঙ্গে একমাত্র বিদ্যাসাগরের  দামোদর পারের তুলনা হয়। উনি মার জন্যে আর আমরা সিনেমার জন্যে। একে অত বৃষ্টি, তায় আবার ইংরেজি সিনেমা। সারা হলে ওপর নিচে মিলিয়ে মেরেকেটে জনা ছয়েক দর্শক (আমাদের ধরে)। ভিজে চুপচুপে জামায় বসে দেখছি জাহাজে করে সার্কাসের জন্তুজানোয়ার নিয়ে যাবার মজার সিনেমা। যেখানে একটি শিম্পাজি বাঘের খাঁচা খুলে বিপত্তি ঘটায়। শেষ পর্যন্ত মানুষ বাঘের খাঁচায় ঢুকে প্রাণ বাঁচায়।
সুবিমল বসাক একবার বিহারের এক প্রত্যন্ত শহরে সিনেমা দেখতে গেছিলেন, সম্ভবত সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরী। টিকিট কেটে ভাবলেন নদীর ধার থেকে একটু ঘুরে আসবেন। সেখানে কোথা দিয়ে ঘন্টাখানেক কেটে গেল। টনক নড়তে পড়িমড়ি করে এলেন হলে, মনে দুঃখ, একঘন্টার ওপর সিনেমা এগিয়ে গেছে।  তাঁদের দেখে লাইটম্যান দরজা খুলে যত্ন করে ভেতরে বসালেন। প্রজেক্টরের আলো পড়ল সাদা  পরদায়। সিনেমা এবার শুরু হবে। এই শো তে তাঁরা দুজনেই যে দর্শক!

ক্রমশ…

Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!