হঠাৎ করে কোনো উপলক্ষ ছাড়াই বাড়িতে বেশ কয়েকটা খাবার টেবিল , চেয়ার সহ রান্না-বান্নার ডেকরেটর্সের জিনিস-পত্র এসে পড়ল বাড়িতে । বৌমা আর শাশুড়ি বাড়িতে । কথা সবার সাথে সবারই হয় কিন্তু কোথাও যেন একটা পাহাড় জমে থাকে একে অপরের সাথে কথা বলার প্রসঙ্গে । বৌমা ঝুমা তাড়াতাড়ি টোকেন এর সাথে মিলিয়ে দেখে , অর্ডার করা জিনিসের কিছু কম এল কিনা । দেখলো সব ঠিক ঠাকই আছে , কোথাও কিছু হিসাবে গণ্ডগোল নেই ।
বৌমা মফসসলের মেয়ে , আধুনিকা , তাই গ্ৰামে বিয়ে হওয়াতে নিজেকে বড়ো করে তুলবার প্রচেষ্টা , গ্ৰাম এবং গ্ৰামের মানুষকে অনেকটা ছোটো চোখে দেখা — তার অহংকারের এক অন্যতম দিক । এ কারণ বশত আশ-পাশের পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে তেমন ভালো সম্পর্ক ও নেই । একমাত্র পুত্র বাবাইকেও ঘর বন্দী করে রাখে একরকম । প্রতিবেশীর ছেলে-মেয়ের সাথে মিশলে নিজের সন্তানও গেঁয়ো হয়ে যাবে – এই মানসিক বিকারগ্ৰস্থ ধারণা থেকে ।
এদিকে বাড়িতে ডেকরেটর্সের জিনিসপত্র আসা দেখে শাশুড়ি মনে মনে ভাবে —
” বাড়িতে কিসের অনুষ্ঠান , নাতিটার জন্মদিন তো না । প্রসাদের বাবা মরেছে আজ বছর পাঁচেক হল , মৃত্যুদিবস তো কখনোই পালন করেনি , আর মৃত্যুদিন ও তো এ মাসে না , তবে কিসের অনুষ্ঠান । “
মনে মনে এমনি কত কথা ভেবে শেষ করবার আগেই গম্ভীর কণ্ঠে বৌমার কথার আওয়াজ কানে আসে তীক্ষ্ণভাবে —
” কি করছেন ? বেলা দশটা বাজতে চলল , সে খেয়াল আছে ? তরকারি গুলো তো এখন কাটতে বসেননি । তাড়াতাড়ি কেটে শেষ করুন । ডেকরেটর্সের জিনিস গুলো মাজবেন , কাটা-কুটো হয়ে গেলে । “
মাজাটা আর চলছে না বৃদ্ধার । বছর পাঁচেক আগে স্বামী বিয়োগের পর নিত্য দিন এমন আচরণের সম্মুখীন হতে হতে আজ বুকে পাথর বেঁধেছে সে। একবুক কষ্ট নিয়ে বৃদ্ধা নিজেই নিজের মনে বলে —
” পেটের ছেলে হয়ে যে ব্যবহার মায়ের সাথে করে , আর এ তো পরের মেয়ে ! এমন ব্যবহার যে করবে , এটাই তো স্বাভাবিক ! আজ যদি বুড়োটা বেঁচে থাকতো , নতুবা আমার নামে বিষয় -আশয় থাকতো !”
বৌমার শত বাজে কথাতেও বৃদ্ধা অতটা ভেঙে পড়ে না , যতটা ভাঙে নিজের ছেলের দেওয়া আঘাতে । দ্রুত কাজ শেষ করে মাজা-ধোয়ার কাজে লেগে পড়ে বৃদ্ধা । গ্ৰীষ্মের দুপুরে মধ্যাহ্নের প্রখর রোদ বৃদ্ধাকে শারীরিক ভাবে আরও অসুস্থ করে তো বটেই কিন্তু মানসিক দিকে ততটা আঘাত করে না , যতটা দশ মাস গর্ভে ধারণ করা পুত্র আর তার বউ করে । সব কাজ শেষ করে স্নান সেরে নিজের ঘরে গিয়ে বসে সে ।
এই বয়সে শরীর আর চলে না । তার উপর গ্ৰাস করে একাকিত্ব । মনে পড়ে পুরোনো সব স্মৃতি , যা মনের কোণে জমে থাকা ব্যথাগুলোকে শতগুণ বাড়িয়ে দেয় । মৃত্যু আর একাকিত্ব , এ দুইয়ের মাঝে কাউকে যদি কোনো একটাকে বেছে নিতে বলা হয় , তবে মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে অধিকাংশ মানুষই একাকিত্বকে বেছে নেবে জানি কিন্তু দুটো দিন একাকিত্ব জীবন কাটাবার পর সে যে নিজেই নিজের মৃত্যু কামনা করবে সেটা অবশ্যম্ভাবী । বৃদ্ধাও ঈশ্বরের কাছে এই একটা প্রার্থনাই বার বার করে । কারণ বাড়ির বাইরে , প্রতিবেশীর বাড়িতে যাওয়াও যে তার মানা ।
এরই মাঝে ছেলের আবির্ভাব বাড়িতে । সাথে সাথে গ্লুকোন-ডি জল তৈরি হয়ে যায় । গ্লাস ভরে খায় ছেলে , বৌমা আর নাতি । মা’এর চোখের সামনে । বৌমা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে —
” এই আর একটু নাও , এখনো তো অনেকটা আছে । “
স্বামী স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে —
” না গো , আর খাবো না , বাবাইকে দাও , ওর শরীরে এখন পুষ্টির দরকার , ওকে অনেক বড় হতে হবে , ও চাকরি করবে , অনেক নাম হবে । “
কথাগুলো সবই কানে গেল বৃদ্ধার । আজ বয়সের সংখ্যাটা অনেক হলো , চোখে সবই ঝাপসা দেখে সে , শরীরের চামরা গুটিয়ে গেছে কিন্তু মনের চামরাটা বোধ হয় পুরোনো তো দূর , আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নতুন রূপে জন্মগ্ৰহণ করেছে বার বার । স্নান সেরে খাওয়ার সময় মা’কে ডাক দেয় —-
” ও মা , মা , কোথায় তুমি ? এদিকে এসো , আজ একসাথে খাবো । “
বৌমা নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে ওঠে —-
” খেয়ে যান । সারাদিন ধরে সব এক এক করে খেতে দিতে পারবো না । কাজ আছে । আমি এ বাড়ি চাকরগিরি করতে আসিনি । “
ছেলে কোনো প্রতিবাদ করে না । বরং স্ত্রী’র পক্ষ নিয়ে সুরে সুর মিলিয়ে বলে ওঠে —-
” আমি ডাকলাম , তোমার বৌমা ডাকছে , কানে যাচ্ছেনা নাকি ? তোমাকে কি ধূপ-ধুনো দিয়ে বরণ করে আনতে হবে ? “
বুড়ি দুমরে মুষড়ে যাওয়া শরীরটা নিয়ে মন্থর গতিতে খাবার ঘরে প্রবেশ করে । তার যে গায়ে জ্বর , সে কথাটুকু বলবার সাহস বুড়ির হয়ে ওঠে না । আর ওষুধ কিনে দেবার কথা তো দূর অস্ত ।
খাবার সময় কথা উঠলো ছেলের —-
” কাল শহর থেকে আমার বন্ধু-বান্ধব আসবে সব , তোমার বৌমার মা আর বেশ কয়জনও আসবে ও বাড়ি থেকে , কাল কিন্তু তোমার ছুটি , সকালে বেলা করে ঘুম থেকে উঠবে , বেশি সকালে যেন উঠবে না । আর তোমার এ সব কাপড়-চোপড় কিছুই যেন বাইরে রেখো না , সব তালা বন্দী করে তোমার বাক্সে ভরে রাখবে । “
ছেলের কথা শেষ না হতেই বৌমার স্বর —
” আপনি গুছিয়ে কথা বার্তা বলতে পারেন না , লোক জনের সামনে তেমন বেশি কোনো কথা যেন বলবেন না , একটু সেজে-গুজে থাকবেন । সকাল সকাল স্নান সেরে নেবেন । আর হ্যাঁ , সাবান আর শ্যাম্পুটা দেবো , ভালো করে মেখে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে থাকবেন , আপনার তো আবার গায়ের কাছে গেলে টেকা যায় না । “
শুধু একটাই উত্তর , বৃদ্ধার ভাঙা করুণ স্বরে উচ্চারিত হল — ” ঠিক আছে ।”
খাবার শেষ করে এঁটো বাসনগুলো রোজকার মতো আজও মাজতে যাবার সময় বৌমার সেই স্বর —
” দেখে ধুতে পারেন না , একটু ঠিক করে বাসনগুলো ধোবেন , সাদা সাদা দাগ যেন বাসনে না থাকে ।”
নীরবে , কোনো উত্তর না করে বৃদ্ধা চলে যায় নিজের কাজে , জ্বরটা আরো বেড়েছে । এ বাড়িতে সে কথা বলে যে কোনো উপশম পাওয়া যাবে না , তা কবেই সে বুঝে গেছে । তাই আর বলে না । নিজের কাজ শেষ করে , নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে ।
শরীরে কাঁপ ধরেছে তার । তবু হৃদপিণ্ডটা মোচড় দিয়ে ওঠে । ছেলে বৌমার বলা প্রতিটি কথা তার কানে বাজে । বিষণ্ণ দুপুর , চারিদিকে নিস্তব্ধতা , বৃদ্ধার মনকে আরো বিষণ্ণ করে তোলে । চোখের জল টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ে । বালিশ ভিজে যায় । এ বিশ্ব ব্রম্ভাণ্ডে এ চোখের জলের কোনো দাম নেই । ঠিক যেন পোড়া সলতে , যে সন্ধ্যাবেলাতেও নিজে জ্বলে সমগ্ৰ ঘরকে আলোকিত করে শেষে অবশিষ্টাংশ হয়ে পড়ে রইল । ঠিক যেন তালপাতার পাখা , গ্ৰীষ্মের দুপুর কিংবা রাতে নাভিশ্বাস ওঠা , হাসফাস করা গরমে শীতল হাওয়া দিতে দিতে একসময় নিজেকে ক্ষয় করবার পরেও গৃহস্থ বাড়ির উনুনে নিজেকে ঠাঁই দিয়ে , নিজে জ্বলে সকলের ক্ষুধা নিবারণ করে ।
বিকাল গড়াতে থাকল বৃদ্ধার অস্ফুট কণ্ঠে ফুটে ওঠে —
” বাবা ! গর্ভে তোকে ধারণ করেছি , শত যন্ত্রনা সয়ে আজ তোকে বড় করেছি , বৌমা না হয় পরের মেয়ে ! তাই বলে তুইও এমন ! তোরও তো একটা ছেলে হয়েছে , সেও যদি তোর সাথে এমন ব্যবহার করে !”
বোধ হয় এ পৃথিবীর বন্ধন ছিন্ন হতে চলেছে , আর কোনো কথার আওয়াজ নেই , শুধু দুটো চোখের কোণে অনবরত জল ঝড়ে যায় । এ তো জল নয় , কত কথার সাক্ষী , কত ব্যথার সাক্ষী । বৃদ্ধার জীবনে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা আজ একত্রিত । পাখিরা ভাষা হারায় , পথ খুঁজে পায় না । গাছগুলো স্তিমিত হয়ে আছে আজ । নদীতে স্রোত আজ স্তিমিত ।
সন্ধ্যা হব হব , তখনও বৌমার সেই স্বর —
” কি হল ? উঠবেন তো নাকি ? সন্ধ্যা দেবে কে ? “
আর কোনো উত্তর আসে না শত ডাকেও । প্রদীপের সলতেটার বুক পুড়ে আজ নিঃশেষ । কিছুই অবশিষ্ট নেই । তাই প্রদীপ আজ আর জ্বললো না । ঘন অন্ধকারে ঘর ভরে গেল । ও চির শান্তি পেলো । আর কেউ কোনো কষ্ট বৃদ্ধাকে দিতে পারবে না ।