টুকুনের বড় হওয়া
এবার মামাবাড়ি এসে অবধি টুকুনের মনে শান্তি নেই ৷ কি করেই বা থাকবে ? আজ বাড়িতে চৌদ্দপ্রদীপ দেবে ভেবেছিল,কাল ঠাম্মা লক্ষীপূজো করবে,কত মজা হত, রাতে বাজী পোড়ান হত….এসব বাদ দিয়ে বাবার সাথে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিল মা ৷ কোন মানে হয় ! এমনিতে মামাবাড়ি আসতে টুকুনের ভালই লাগে, এই তো গত এপ্রিল মাসেও এসেছিল,মামার বিয়েতে৷ সে সময় কুড়িদিন একটানা ছিল, স্কুল খুলে যাওয়ায় এক সপ্তাহের পেনডিং ওয়ার্ক নিতে হয়েছিল উড্ডুর কাছ থেকে ৷ উড্ডু টুকুনের খুব ভাল বন্ধু ৷ উড্ডু টুকুনদের সোসাইটিতেই থাকে, ওদের পরের ব্লক এ ৷ উড্ডুর ভাল নাম রুদ্রপ্রিয়া আর টুকুনের কথামালা৷ কথামালা একটা নাম হল? সারা পৃথিবী জুড়ে এত ভাল ভাল নাম থাকতে টুকুনের নাম হল কথামালা ৷ দিদুন কে কেউ যে কেন বারণ ও করেনি ! টুকুনের কথা ভাবার কি আর কেউ আছে ? ক্লাশে উড্ডু ছাড়া সবাই ওর নাম নিয়ে হাসাহাসি করে ৷ এমন কি ম্যাম ও বলেন , ” কথা, স্টপ টকিং ৷” টুকুন মোটেও অত কথা বলতে জানে না , অন্তত উড্ডুর চেয়ে কম কথা বলে ৷ সব দিদুনের দেওয়া নামের জন্য !
এই যে এখন, বলা নেই কওয়া নেই , কালী পূজোয় ছোটনীলপুর চলে আসতে হল তার কারণ তো দিদুন ! দিদুন গত পরশু রাতে ছোট বাইরে যেতে গায়ে পড়ে মাথা ফাটিয়েছে ! শেষ সিঁড়িটা নাকি অন্ধকারে দেখতেই পায়নি, পায়ে পা লেগে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছিল ৷ এসব কথা টুকুন জানতে পেরেছে মা-বাবার কথা থেকে ৷ টুকুনদের ফ্ল্যাটই এজন্য ভাল, সবসময় আলো, সবকিছু ঘরের মধ্যে ৷এখানে তো সব অন্যরকম , সেপারেট ৷ দিদুন আর মামাদের ঘর পাশাপাশি, উঠোনে নেমে গিয়ে ডানদিকে বড় ঘর, টুকুনদের জন্য, এখানে আগে দাদুভাই থাকত ৷ দাদুভাই এর ঘরের উল্টোদিকে মামার অফিস ঘর ৷ অফিস ঘর টা টুকুনের খুব প্রিয় কারণ ঘর টা অনেক বড় ,এখানে অনেক মোটা মোটা লাল শালু দেওয়া খাতা আছে , পেন আছে ,একটা কাঁচের পেপার ওয়েট আছে, খুব বড় ৷ অবশ্য ওটাতে টুকুনের হাত দেওয়া বারণ আছে ৷ আর আছে অনেক ধান, গম,মুসুর ডাল,কলাই ডাল এর বস্তা, বিশাল বিশাল বাটখাড়া আর দাঁড়িপাল্লা ৷ মামা টুকুন কে ছোটবেলায় ভয় দেখাত ‘দাঁড়া তোকে মেপে দেব’ বলে ৷ টুকুন মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে ও বড় হলে মামার মতো অফিস করবে ৷ দুপুর বেলা খেয়ে দেয়ে একটু হিসেব লেখা আর ধান গম ওজন করে বস্তায় ঢোকানো ৷এই তো কাজ ৷ তাও কাজল আর সজল মামা হেল্প করে দেয় কত ৷ ও হ্যাঁ , ছোট বাইরে বড় বাইরের ঘরগুলো আছে পুকুরের পাশে ৷ ওখানে রাতে টিম টিম করে আলো জ্বলে, গ্রামে বোধহয় আলোর জোর বেশী হয় না ৷ না হলে কি আর দিদুন পড়ে যায় !
এবার এসে মোটেও ভাল লাগছে না টুকুনের ৷ মা আসেনি বলে মামী সাথে সাথেই থাকছে আর খালি বলছে , “টুকুন, হাত মুখ ধুয়ে নাও” , “টুকুন, স্নান করে নাও”., “টুকুন, পুকুর ধারে যেও না” , “টুকুন, স্বর্ণময় কে ধোরো না, আঁচড়ে দেবে” – খালি এটা কোরো না ওটা কোরো না ৷ টুকুন কি বোকা নাকি ? আর তা ছাড়া গতবারই তো টুকুন স্বর্ণময়ের লেজ ধরে টেনে রেখেছিল, স্বর্ণময় তো শুধু মাঁওঔ মাঁওঔ করেছিল, কই আঁচড়ায়নি তো ! মামী তো জানেই না টুকুন ক্লাশ টু তেই একা একা সবার সাথে ডে ট্রিপ এ গিয়েছিল ইকো পার্ক এ ৷ সেখানে লাইন মেনটেইন করেছিল বলে ম্যাম সবাই কে চকোলেট কেক আর ফ্রুটি দিয়েছিলেন ৷ এখন তো টুকুন বড় হয়ে গেছে ৷ সামনের ইয়ার ফোর হবে, ওরা সবাই স্কুলের মেইন বিল্ডিং এ বসবে ৷ কিন্তু এখন কি ? এখন যে সবাই টুকুন কে একলা রেখে যার যার মতো আছে , সেটা ঠিক হচ্ছে?
এই যে মামা ফোন করে বাবাকে নিয়ে আসল দিদুন কে দেখতে হবে বলে, এখন তারা কোথায় ? না , মাছ ধরতে বাওড়ে ! সকালে আসা মাত্রই খেয়ে দেয়ে বাবা আর মামা ছিপ নিয়ে জাল নিয়ে চলল ! মা আর মামা ফোনে ফোনে না জানি কি তা জানি আলোচনা করছিল, টুকুন ভেবেছিল দিদুনের খুব শরীর খারাপ ৷ কোথায় কী? উল্টে বাবাও দিদুন কে একটু বকে দিল দিদুন কারুর কথা শোনে না বলে ৷ বোঝ ! দিদুন তো সবার বড়, দিদুন কেন সবার কথা শুনবে? দিদুন কি প্রাইমারী স্কুলের হেড দিদিমণি ছিলনা? দিদুনের কথাই তো সবাইকে শুনতে হবে৷ টুকুনদের স্কুলে সবাই প্রিন্সিপ্যাল ম্যাম কে ভয় পায়না? এদিকে মামী তো সেই থেকে ব্যস্ত দিদুন কে ড্রেসিং করানো নিয়ে ৷ আবার বলছিল এই বয়সে এত চুল রাখা নাকি ঝামেলার ৷ দিদুনের হেয়ার কাট হবে আজ ৷ মামী করে দেবে নাকি সাবধানে ! সব কেমন পালটে যাচ্ছে ! এই যে টুকুন সেই কখন ফুলদিদার কাছে চান করে খেয়ে দেয়ে নিয়েছে , কেউ জানে ? এখন যে টুকুনের কিছু মিছু খেতে ইচ্ছে করছে সেটা শুধু দিদুন জানে ৷ দিদুন জানে ঠিক কি খেলে টুকুনের মন টা, পেট টা ভরবে ৷ সেই দিদুন এখন বিছানায় ! কি জানি মামী কী করে দিল ! টুকুন মনে মনে ঠিক করল বড় হলে দিদুন কে নিয়ে আলাদা বাড়ি করে থাকবে ৷ দিদুনের জন্য একটু কষ্ট লাগলো টুকুনের ৷ আহারে মানুষটা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েই না ওর কথামালা কে দেখতে চেয়েছিল ! আর টুকুন কিনা….খুব দুঃখ পেয়ে টুকুন জোরে কেঁদেই ফেলল !
আরে !
টুকুন সোনা!
তুমি এখানে ? আর আমি কোথায় কোথায় খুঁজে এলাম৷ পেয়ারা মেখেছি, কাসুন্দি দিয়ে ৷ খাবে এস৷
তোমার দিদুন কে কেমন সাজিয়েছি দেখবে না? তোমার বাবা আর মামা চলে এসেছে, কত্ত মাছ আর কাঁকড়া এনেছে দেখবে এসো ৷
আমি ফুলমাসি কে বলেছি ,তোমার জন্য স্পেশাল কাঁকড়ার ঝাল করবে রাতে ৷
টুকুন কান্না থামিয়ে লজ্জা পেয়ে মামীর দিকে তাকিয়ে ডাঁই করে রাখা ধানের বস্তার ওপর থেকে নেমে এল ৷
“ইশ্ , দ্যাখো ধোয়া ফ্রকটার কী অবস্থা করেছ ! চলো হাত মুখ মুছে দি ৷ ধূলো লাগলে তোমার সর্দি হয় না?”
তারপর মামীর হাত থেকে ছাড়া পেয়ে টুকুন যখন দিদুনের ঘরে গেল তখন দিদুন কে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল ৷ দিদুনের ব্যান্ডজ খুলে দেওয়া হয়েছে, শুধু একটা স্টিকিং প্লাষ্টার দেওয়া ৷ দিদুনের চুলগুলো প্রায় টুকুনেরই মতো ৷ ফরসা সাদা শাড়ী আর চন্দনের টিপ পড়ে দিদুনকে দেখতে ছোট্ট দুষ্টু মেয়ের মতো লাগছে ৷ দিদুনের হাতে জপের মালা, তাই কথা বলতে পারবে না এখন৷ টুকুন গুটি গুটি পায়ে বিছানায় উঠে দিদুনের গা ঘেসে বসে সাবান, ডেটল আর ধূনোর গন্ধ নিতে নিতে মনে মনে ঠিক করল ভাইফোঁটা পর্যন্ত থেকেই যাবে ৷ কাল বাবার সাথে কলকাতায় ফিরবে না ৷
এই ক’ দিন দিদুন আর মামীর কাছেই থাকবে ৷ মামাবাড়ির মতো মজা আর কোথায় পাবে?