• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে মহুয়া সমাদ্দার 

উপহার 

“কতো দিন বলেছি বাথরুম থেকে বের হলে লাইটটা অফ করবে । মনেই থাকে না নাকি ? মনে থাকবেই বা কেমন করে ! সারাদিন শুধু ফোনে কি ছাইপাশ লিখে চলেছে !  আর মনে থাকে কিছু ! আর ছেলেটাও তেমনি । বৌকে শাসন করবি কোথায় , তা নয় , মাথায় তুলে ধেই ধৈই করে নাচছে । আজ বারাসত তো কাল মালদায় নিয়ে ছুটছে । বৌ নাকি সাহিত্যিক হবে ! ছ‍্যাঃ । সাহিত্যিক না ছাই ।
আমরা তো কোন ছোট্টটিতেই শ্বশুর ঘরে এয়েছিলুম । তারপর থেকেই তো স্বামী, সংসার , সন্তান । এর বাইরে কিছু ভেবেছি কোনো দিন ? এতো ভালো গাইতাম , সেই গানও ছেড়েছি ।
আর বাবু তোকেও বলি এতো দামি ফোন ঘরের মেয়েমানুষের হাতে দেওয়া কেন বাপু ? ”  বেশ রাগত স্বরে বলছিল সীমাদেবী ।
“আঃ মা , তোমায় কতো দিন বলেছি না  এভাবে কথা বলবে না ? নিজে মেয়ে হয়ে আর একজন মেয়েকে মিনিমাম রেসপেক্ট তো করো ?
আর রোজ একই কথা বলা  কেন শুনি ? ফোনটা তো ও শুধু কাজের জন্য ব‍্যবহার করে মা । পর্ণা লিখতে চায় লিখুক না । মেয়ে হলেই কি শুধুই সংসার , স্বামী , সন্তানেই আটকে থাকতে হবে ? ওর গুণ আছে মা । গুণটাকে কাজে লাগানোই ভালো নয় কি ? ” ধীরে ধীরেই কথাগুলো বললো বিকাশ । এই রকম কথা চালাচালি রোজ চলে ছেলে আর মায়েতে ।
পর্ণা , বছর ছাব্বিশের সুন্দরী বাংলায় এম.এ. পাশ মেয়ে । ছোট থেকেই লেখালেখি করে । নানা নামী পত্রিকায় গল্প , উপন্যাস  বের হয় । নানা জায়গা থেকে ডাক ও আসে । স্বামী বিকাশ কখনো এতে বাধা দেয়নি । বরং উৎসাহ ই দিয়েছে । শুধু পর্ণার শ্বাশুড়ি সহ্য করতে পারে না । পর্ণা বুঝতে পারে ,আসলে আগেকার দিনের স্বল্প শিক্ষিত মানুষ বলেই হয়তো এমন । এমনিতে মানুষটা ভালোই । পর্ণার পছন্দের খাবার যেমন , আচার , নাড়ু এসব সবসময় নিজের হাতে বানিয়ে রাখে । পর্ণার শরীর খারাপ হলে এই মানুষটাই কি ভীষণ শান্ত হয়ে যায় !
সীমাদেবী আছেন বলেই পর্ণাকে সংসারের ব‍্যাপারে মাথা ঘামাতেই হয় না । শুধু যা একটু বকবক করেন । সব ভালো যার এটুকুতো সহ্য করে নেওয়াই যায় ।
আর দশটা মেয়ের থেকে পর্ণা আলাদা , সীমাদেবী বেশ বোঝেন । হাজার বকাবকি করলেও মুখে একটি কথা ও বলে না মেয়ে । বাবু নতুন দামি ফোন কিনে দিয়েছে বলে রাগারাগি করেছেন ঠিকই , কিন্তু মনে মনে তারিফ করেছেন ছেলের । অন্তত ছেলেটা বাবার মতো হয়নি । হাড়কিপ্টে অতুলবাবু , সীমাদেবীর স্বামী কোনো দিনই বউয়ের কোনো শখ আহ্লাদ মেটাননি ।এমনকি ভালোবাসার ক্ষেত্রেও বড়ই মাপা। স্বামী-স্ত্রীর যে বন্ধুত্বের সম্পর্কও হয় , তা কোনো দিনই বুঝতে পারেনি তিনি । সবকিছুই ছিল বড়ো মাপা ।
গান গাইতে ভালোবাসতেন সীমাদেবী । কতো কতো দিন বলেছিল , একটা হার্মোনিয়াম কিনে দিতে । কিন্তু না । কোনো দিন ও দেয়নি । পুজোতে কোনও দিনও সীমাদেবীকে নিয়ে যাননি শাড়ি কিনতে । পাছে বেশি দামের শাড়ি দিতে হয় !
সতেরো বছরে মাধ‍্যমিক পাশের পরেই বিয়ে হয়ে যাওয়া সীমাদেবী দশ জনের সংসারে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো সান্ত্বনা পাননি ।
বাবু সবে চাকরিতে ঢুকেছে , স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন অতুলবাবু । ততোদিনে সংসারে এক হাঁড়ি আর নেই । অতুলবাবুর ভাইরা সবাই ছেলে মেয়ে ছোট থাকতেই হাঁড়ি আলাদা করেছেন ।
বাবুর পাঁচ বছর চাকরির মাথায় পর্ণাকে পছন্দ করে নিয়ে আসেন সীমাদেবী ।
পর্ণার চোখদুটো কেমন যেন দুঃখী , দুঃখী । মা মরা মেয়ে তো । বুকে কেমন যেন চিনচিনে কষ্ট হয়েছিল মেয়েটার জন্য । তাই আর বাক‍্যান্তর না করে পর্ণাকেই বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিল ।
ওরা সেবার পুরী গেছিল ঘুরতে ।  সীমাদেবীকেও বারেবারে অনুরোধ করেছিল পর্ণা । কিন্তু সীমাদেবী ইচ্ছে করেই যায়নি সেবার । থাক , দুটোতে কদিন একসাথে ঘুরে আসুক । পর্ণা ঘরেই বেশিরভাগ ওষুধ গুছিয়ে রাখে । হঠাৎ খুব পেটের গন্ডগোল হওয়ার জন্য ওষুধ নিতে ঢুকেছিল ছেলে- বৌমার ঘরে । ওষুধ নিতে গিয়ে দেখলো একটা বেশ নামকরা পত্রিকা ওদের খাটে পড়ে আছে । একা একা কাজ বিশেষ কিছু নেই বলেই হাতে করে পত্রিকাটি নিয়ে এসেছিল সীমাদেবী । তারপর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা গল্পে চোখ আটকে গেছিল । গল্পের লেখিকা পর্ণা রায় । অসম্ভব সুন্দর একটি গল্প “ঠিকানা-চোরাবালি ” । গল্পটা পড়তে পড়তে দুচোখে জল আর বাধ মানেনি । একটি মেয়ের জীবন নিয়ে লেখা । “কিন্তু এই মেয়েটির জীবনের সাথে কোথায় যেন আমার জীবনের বড়ো মিল ! তবে কি আমার জীবন নিয়েই লিখেছে পর্ণা ! এতো বোঝে পর্ণা আমায় ! ” বিড়বিড় করে বলেছিলেন সীমাদেবী ।
সেই শুরু । তারপর থেকেই পাড়ার মোড়ের ম‍্যাগাজিন কর্ণার থেকে সূচিপত্রে পর্ণার নাম থাকতো সেই সব  লেখা সংগ্ৰহ করে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতো সীমাদেবী । যদিও পর্ণাকে জানতে দেননি এসব বিষয় । কারণ , এতদিন ধরে যে লেখা নিয়ে এতো গালমন্দ করেছেন , তাকেই যে আজ সীমাদেবী এতো ভালোবাসেন সেটা পর্ণা  জানলে লজ্জা বাড়বে বৈকি ।
বিয়ের পর থেকেই পর্ণা লক্ষ্য করেছে কাজ করতে করতে সীমাদেবী গুনগুন করে গান করেন বেশ সুন্দর । একদিন কথায় কথায় শুনেছিলো একটা হার্মোনিয়ামের ভীষণ শখ ছিল তার একসময়ে ।
সীমাদেবীর শরীরটা আজ কয়েকদিন ভীষণ খারাপ । হাঁটুতে ব‍্যথায় কাহিল । সীমাদেবী স্নানে গেছেন দেখে পর্ণা ভাবলো , ওনার ঘরটা একটু গোছাবে । টেবিল , খাট ইত্যাদি গোছাতে গিয়ে তোষকের একটা পাশ  উঁচু দেখে সেটাকে ঠিক করতে গিয়ে দেখে কতগুলি পত্রিকা তোষকের তলায় রাখা । সেগুলি টেনে বের করলো পর্ণা ।
ও অবাক হয়ে দেখলো , তারই লেখা যেসব গল্প নানান ম‍্যাগাজিনে বেরিয়েছে সবগুলি সীমাদেবী নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন ! “তারমানে আমার লেখা মা পড়েন ! পছন্দ ও করেন নিশ্চয়ই । তাই জন‍্যেই এভাবে নিজের কাছে রেখেছেন ! “– পর্ণা বিড়বিড় করে বললো । কয়েক ফোঁটা জল চোখ থেকে নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়লো । বাথরুমের শব্দ পেয়েই পর্ণা বইগুলি যেমন ছিল রেখে বেরিয়ে এলো ।
আজ পর্ণার একটি বড়ো উপন্যাস ভীষণ নামী  একটি পত্রিকা কিনে নিয়েছে । বেশ ভালো টাকাই দিয়েছে ওরা । বাজারে এসেছে পর্ণা । সবার জন্য কিছু কিছু উপহার কিনবে ।
সবার জন্য এটা সেটা কেনার পর কি মনে হতে একটা হার্মোনিয়ামের দোকানে ঢুকলো পর্ণা । দেখেশুনে একটা ভালো হার্মোনিয়াম কিনে বাড়ি ফিরলো ।
দুপুরে শুয়ে ছিলেন সীমাদেবী । চোখটা লেগে এসেছে সবে । হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল তার । কাকে যেন পর্ণা বলছে “এই যে এইদিকে ।হ‍্যাঁ , হ‍্যাঁ এইপাশে ।” আরে  তার ঘরের দিকেই তো কাকে নিয়ে যেন পর্ণা আসছে । মাথায় আবার কি ! সেই কখন মেয়েটা বেরিয়েছে । একটু আসছি বলে । এতোক্ষণে এলো । তাও আবার সাথে কাকে নিয়ে !
ধড়মড় করে উঠে বসলেন সীমাদেবী । দেখলেন একটি লোক মাথায় একটি বাক্স নিয়ে এসে খাটের এক কোণে নামিয়ে রেখে গেলো । লোকটি বেরিয়ে যেতেই পর্ণা বাক্সটা খুলে একটা হার্মোনিয়াম বের করে সীমাদেবীর সামনে রেখে বললো , ” মা দেখো দেখি বাজিয়ে , কেমন বাজছে । “
সীমাদেবী চোখ বড়ো বড়ো করে বললো , “ও মেয়ে , তুই কি লেখালেখি ছেড়ে এবার গান শিখবি নাকি ?”
পর্ণা সীমাদেবীকে জড়িয়ে ধরে বললো , ” মা, এটা শুধু তোমার । সেই কোন ছোট্ট বেলা থেকে সংসারের পেছনেই পড়ে রইলে । কতো কতো স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছো । তুমি বলেছিলে না , তোমার খুব শখ ছিলো হার্মোনিয়ামের । তাই আমার নিজের উপার্জনের টাকায় তোমার জন্য এটা এনেছি মা । তোমার পছন্দ হয়নি মা ?”
অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে পর্ণার দিকে ।
“আমার জন্য হার্মোনিয়াম ! কোথাকার কোন মেয়ে এনেছে ! তাও আবার ওর লেখালেখির টাকায় ! যে লেখালেখিকে আমি সারাদিন গালমন্দ করি ! বাবু আজ এতো বছর চাকরি করছে কই ওর তো মনে পড়েনি এই কথা ! আর এই মেয়েটা সারাদিন আমার বকাঝকা খায় , তারপরেও ওর পাওয়া সব টাকা দিয়ে আমার জন্য এইরকম উপহার নিয়ে এসেছে ! “– মনে মনে বললো সীমাদেবী । কিন্তু চোখদুটোতে জৈষ্ঠের প্রবল গরমেও শ্রাবণ নেমেছে জোর ।
দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন পর্ণাকে । পর্ণার ও চোখের কোণে জল । মাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বললো “তুমিই তো আমার ছোট্ট বেলার হারিয়ে যাওয়া মা । নইলে , আমার লেখা এভাবে সব গুছিয়ে রেখে দাও ! রান্নার লোক থাকতেও আমার পছন্দের খাবার এতো শরীর খারাপ নিয়ে ও তুমি বানাও ! তুমি আমার সোনা মা । “
বিকাশ সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আবিষ্কার করেছিল একটি শান্ত , সুন্দর পরিবেশ । মা মেয়ের এক অদ্ভুত ভালোবাসা ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।