• Uncategorized
  • 0

চারণকবি বৈদ্যনাথের কবিতায় সন্তোষ ভট্টাচার্য

প্রেম-প্রতিবাদের যুগলবন্দী ঘটেছে চারণকবি বৈদ্যনাথের কবিতা

কবিতা মানে বাসমতী চালের ভুরভুরে গন্ধ
কবিতা মানে আলতা পরা নরম পায়ে
ঢেঁকিতে পা দেওয়া গৃহস্থালি বউ।’ ……..
কবিতার অর্থ খুঁজতে খুঁজতে কবিতাকে সঙ্গী করে রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ সারাজীবন ছুটতে ছুটতে নিজভূম মন্দিরনগরি বিষ্ণুপুরে মা করুণাময়ীর চরণতলে থিতু হয়েছিলেন মানুষটি। বৈচিত্র্যময় জীবনে মার্ক্সবাদ চর্চা, তন্ত্র সাধনা, জ্যোতিষ চর্চা, অভিনয় এবং কবিতা একসাথে চালিয়েছেন বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৩২ এর ৩রা সেপ্টেম্বর বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে বৈদ্যনাথের জন্ম। পিতা রামগতি ও মা লীলাবতীর কনিষ্ঠ সন্তান গর্ব করে বলতেন – ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মতো আমিও অষ্টম গর্ভের সন্তান’। মাত্র ছয় মাস বয়সেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মা লীলাবতী ছিলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বংশের কন্যা। বিষ্ণুপুরের কৃষ্ণগঞ্জে জানকী পণ্ডিতের পাঠশালায় বৈদ্যনাথের শিক্ষাজীবন শুরু। তারপর বিষ্ণুপুর মিশন হাইস্কুল ও বিষ্ণুপুর হাইস্কুলে পড়াশোনা। শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন প্রত্নসন্ধানী গবেষক ডঃ মাণিকলাল সিংহকে। কিন্তু মেট্রিক পরীক্ষায় বসার আগেই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। ফলে প্রথাগত পড়াশোনায় এখানেই ইতি ঘটে। শুরু হয় কবিতা লেখা। ১৯৪৬ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে জ্বালাময়ী কবিতা লেখা শুরু। ১৯৪৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে কাকদ্বীপের চন্দনপিঁড়িতে শহিদ অহল্যার স্মরণে কবিতা প্রকাশ করেন এবং ঝংকার নামে একটি গানের সংকলন প্রকাশ করেন। ওই বছরই ‘আম কাঁঠালের ভোজ’ নামে একটি ছড়া পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরেও বৈদ্যনাথের প্রতিবাদী কলম থেমে থাকেনি। ১৯৪৯ সালে বাঁধগাবা কৃষক আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রকাশ করলেন কবিতা পুস্তিকা ‘জমি দখলের কবিতা’। একের পর এক রক্ত গরম করা কবিতায় আন্দোলিত করতে লাগলেন শ্রমিক কৃষক বুদ্ধিজীবীদের চেতনাকে। সে কবিতা যেমন ১৯৫১ সালে কোচবিহারে খাদ্য আন্দোলনের দুই বোন বকুল ও বন্দনাকে নিয়ে লিখেছেন তেমনি ১৯৫৩ সালে এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে ‘ট্রামের চাকা বন্ধ রে’ কবিতা পুস্তিকা প্রকাশ করে কলকাতার রাস্তায় গ্রেফতার বরণ করেছেন। এমনিভাবে কখনও বার্নপুরে শ্রমিক ধর্মঘটের সমর্থনে কখনও বঙ্গ বিহার সংযুক্তির প্রতিবাদে কখনও প্রধানমন্ত্রীকে পোস্টার কবিতায় খোলা চিঠি লিখে চললেন বৈদ্যনাথ। ১৯৫১ তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি রাজস্ব দপ্তরে কেরানির একটা চাকরি জুটলেও সরকার বিরোধী কবিতা লেখার অপরাধে ১৯৫৬ সালে বৈদ্যনাথ সে চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন। ইতিমধ্যে ১৯৫৪ সালে বিষ্ণুপুর সন্নিকটস্থ মুনিনগর গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু মিশ্র পরিবারে সীতাদেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। চাকরি হারিয়ে বৈদ্যনাথের কোন হেলদোল নেই। বৈদ্যনাথ ব্যস্ত যুদ্ধ বিরোধী কবিতা হ্যান্ডবিল ‘দাও লিখে দাও ঘোড়ার গায়ে লাল রঙে লাল ইস্তাহার’ প্রকাশে, ব্যস্ত পোস্টার কবিতায় প্রধানমন্ত্রীকে দ্বিতীয় খোলা চিঠি লেখায়। ১৯৫৭ তে ‘দিগন্তে মৃণাল হৃদয়’ এবং ‘হে আকাশ হে জীবন’ নামে বৈদ্যনাথের দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সে বছরই কলকাতায় গিয়ে স্বাধীনতা পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহন করেন। একই সঙ্গে ‘স্বদেশ’, ‘বসুমতী’, ‘২৪ পরগণা বার্তা’য় তিনি লেখাও শুরু করলেন, যোগ দিলেন যাত্রাদলেও। লিখলেন নাটক ‘রঙের গলাম’ ও ‘পথ’। অভিনয়ও করলেন সেই নাটকে। বোহেমিয়ান কবি বৈদ্যনাথ চষে বেড়াতে লাগলেন রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ। বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে চারণকবি বৈদ্যনাথ হওয়ার যে দীর্ঘ পথ সেই পথে স্ত্রী সীতাদেবীর চরম ত্যাগ ও জীবন যন্ত্রণা জড়িয়ে আছে বলে চারণ কবি নির্দ্বিধায় স্বীকার করতেন। বৈদ্যনাথের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় বিগত শতকের ৭০ এর দশকের শেষদিকে। তখন বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নয় ‘চারণকবি বৈদ্যনাথ’ নামেই তাঁর পরিচিতি। আর তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ৯০ এর দশকের এক সন্ধ্যায় বাঁকুড়া শহরের সুপরিচিত এক বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানে। যে দোকানের মালিক কবি অবনী নাগ যিনি ইতিমধ্যেই ‘ইলেকট্রিক কবি’ নামে আখ্যায়িত হয়েছেন সাহিত্যিক বিমল করের লেখনীতে। প্রথম আলাপেই চারণকবি বৈদ্যনাথ জড়িয়ে ধরলেন তাঁর প্রশস্ত বুকে আর কম্বুকণ্ঠে নিজের কবিতায় বরণ করে নিলেন এই অনুজকে পরম স্নেহে –
“ছুটে এসো তরুন তরুণী সবে/ তোমাদের সাথে কবিতা উৎসবে
নাচবো গাইবো ভাসাবো প্রেমের ভেলা/ এসো যৌবন ডাকছে কবিতা মেলা।”
১৯৬০ সালে মালদহ থেকে তাঁর ‘দিবারাত্রির কাব্য’ নামে কবিতা সংকলনের প্রকাশকে কেন্দ্র করে আয়োজন করেছিলেন কবিতা মেলা। এই কবিতামেলা আয়োজন পরবর্তীকালে কবির এক নিত্য নেশায় দাঁড়িয়েছিল। তিনি ‘এসো যৌবন ডাকছে কবিতা মেলা’ ফেস্টুন টাঙিয়ে কবিতা মেলার আয়োজন করে দিতেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এ নেশা তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিল। তিনি লিখলেন – ‘এখন পৃথিবী জুড়ে কবিতার বড় প্রয়োজন।’ ১৯৬১ সালে দিঘায় সারা বাংলা কবি সাহিত্যিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন বৈদ্যনাথ। উদ্দেশ্য রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রস্মরণ। সম্মেলনের স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। কিন্তু সম্মেলন ভেস্তে যাওয়ায় ঋণগ্রস্ত হয়ে বাড়ি বন্ধক দিতে বাধ্য হন তিনি। সেই সময়ে ‘কর্ণ সোমের ডায়েরি’ নামে তাঁর অনু উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ১৯৬২তে স্নেহানশু আচার্যের আর্থিক অনুদানে ‘দেয়ালের অক্ষর’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বোহেমিয়ান কবি তরজা ও কবিগানের দল তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠান করে চললেন। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নেচে নেচে তাঁর কবিতা ও ও কবিগান মুগ্ধচিত্তে উপভোগ করেছেন গ্রাম বাংলার মানুষ। সমাজের এমন কোন বিষয় নেই যা বৈদ্যনাথকে নাড়া দেয়নি বা তিনি কবিতা লেখেননি। ১৯৭০ এ তাঁর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘পোস্টার কবিতা’ তাঁকে চারণকবির সম্মান এনে দিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে, নকশাল আন্দোলনের সমর্থনে, ইন্দিরা গান্ধির জরুরী অবস্থা ঘোষণার প্রতিবাদে রাজনৈতিক কবিতা লিখে কারাবাস করেছেন অনশনও করেছেন আবার প্রেমের কবিতা লিখে আপন মনের মাধুরীতে ভেসে বেড়িয়েছেন বৈদ্যনাথ। তাঁর একই কবিতার মধ্যে রাজনীতির নোংরা পাঁক যেমন দেখতে পাই তেমনি প্রকৃতিপ্রেম ও ভালবাসার গান খুঁজে পাই। বৈদ্যনাথের কবিতা হল জীবনের গান, সমাজের দর্পণ। মনুমেন্টের নীচে কবিতা পড়তে পড়তে তাঁর কলম কবিতার মানে খুঁজেছে এভাবেই –

“কবিতা মানে বছির চাচার নৌকো
নৌকোর ভেতর লাজুকলতা বউ
কপাল জুড়ে টায়রা
গোলাপফুল আঁকা সুটকেশ
……………………………………….
কবিতা মানে কারখানায় কর্মরত মানুষ
তেলকালি মাখা মানুষ
রক্ত আর ঘামে ভেজা মানুষ
…………….
কবিতা মানে গাঁয়ে ঘরে ভাইয়ে ভাইয়ে কোন্দল
বখরা নিয়ে কলহ
জমি উচ্ছেদ, জমি দখল, খুন জখম”।

দুর্নীতি আর সমাজের পঙ্কিল আবর্তে ডুবতে থাকা মনুষ্যত্ব কবিকে সব সময় ব্যথিত করেছে। তাই তাঁর কবিতায় বারে বারে মানুষের কথা উঠে এসেছে নানাভাবে। তিনি কখনো লিখেছেন –
“মানুষের মুখে আমি কবিতার মুখ দেখতে
সতত ইচ্ছুক।”
কখনো বা লিখেছেন – “মানুষের গর্ব কিন্তু যথার্থ মানুষ
প্রেমের মানুষ
মনুষ্যত্ব মূল্যবোধ যার মধ্যে আছে ষোলআনা
আমি শুধু খুঁজে ফিরি
সেই সব মানুষের ঘরের ঠিকানা।”
উদাত্ত কণ্ঠে তিনিই আবার তাঁর কবিতায় আহ্বান জানান –
“এসো ঐক্য, ভালবাসা, এসো প্রেম, মনুষ্যত্ব
চরিত্র সুন্দর
তুমি ছাড়া বড়ো শূন্য আমাদের ঘর।”
চারণ কবি তাঁর জবানবন্দী কবিতায় লিখলেন – “আমি কবি আমি বাঁধা ধরে পথে
ছুটিনা
রাজার দুয়ারে কখনো তো মাথা
কুটিনা”।
তাই ‘বাবুগো’ কবিতায় তাঁর কলম থেকে ঝরে পড়ে – “এখানে পয়সা দিলে
সব পাওয়া যায়
কোর্টের আইন কিনতে পার
হাকিম পাবে, হুজুর পাবে
বিচারকের বিচার পাবে
যা খুশি চাও পাবেই তুমি
ধন্য স্বদেশ, ধন্য স্বরাজ
ধন্য আমার জন্মভূমি।”
আবার কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে কখনো লেখেন – “দুহাত তুলে দিচ্ছি তোকে রাধা নামের বাঁশি
নীল যমুনার জল
কদমতলার জমি
তুই আমাকে না দিস কিছু নাই বা দিলি
নুপুর বোষ্টমী”।
সময় বদলায়, শাসক বদলায় কিন্তু শাসকের চরিত্র বদলায় না। ফলে মৃত্যু এসে কলম কেড়ে না নেওয়া পর্যন্ত চারণকবির প্রতিবাদী কলম বন্ধ হয়নি। ১৯৫৩ সালে তিনি যেমন ‘জাবাব চাই’ কবিতায় সরাসারি প্রশ্ন তুলে লিখেছেন- “রইলোই যদি
রন্ধ্রে রন্ধ্রে
দুর্নীতি আর
অসৎ পাপ
কেন তবে ঐ অশোক স্তম্ভ – অশোক ছাপ?
প্রশ্ন তাই
জবাব চাই
জবাব না পেলে লেখনী বন্ধ করবো নাই।”
১৯৯২-এ এসে একইভাবে এই বামপন্থী তান্ত্রিক কবি চাঁছাছোলা ভাষায় লিখতে পারেন – “দেশটা বিকিয়ে মানুষ ঠকিয়ে, যারা আজ আছে মহা সুখে / হিসি করে দিতে পারি আমি সেই ভ্রষ্ট নেতার মুখে।” কিম্বা “স্বার্থসুখের ভোগের নেশায় / গজিয়ে ওঠে নতুন শ্রেণী / তাদের পতন ঘটলে তবেই / পাঞ্চালী ফের বাঁধবে বেণী।”
তন্ত্রসাধক কবি বৈদ্যনাথের নারী জাতির প্রতি ছিল অসীম শ্রদ্ধা। তিনি বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন মেয়েরা সমাজের গর্ব, সমাজের অলঙ্কার। তিনি বেদ পুরাণ হিন্দু মাইথোলজির উদাহরণ টেনে বলতেন অসুরনাশিনী, অশুভনাশিনী, কলুষনাশিনী –– এভাবে নানারূপে বিভূষিতা নারীকে পরবর্তীকালে সমাজপতিরা এসে খাটো করেছে, অবজ্ঞা করেছে, হেয় জ্ঞান করেছে। ৯০এর দশকে রূপ কানোয়ার হত্যায় চরম ব্যথিত কবি লিখলেন – “আমারই স্নেহের মেয়ে রূপ কানোয়ার / সম্পত্তি লোভের মোহে, বেশ কিছু দুষ্ট লোক, নৃশংস বর্বর / জোর করে চিতাতে পোড়ায় / অথচ দেশের রাজা নির্বিকার মন্ত্রিত্ব চূড়ায়।”
তিনি লিখলেন – “চারণ চারণ কেমন চারণ ? / সত্যি কথা বলতে বারণ”।
১৯৯০ এর দশকে বাঁকুড়ায় তাঁকে এবং অবনী নাগকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল সাহিত্য সংস্কৃতির এক নির্মল পরিমণ্ডল। যেখানে এসে যোগ দিয়েছিল মাদল, ত্রিবেণী, যামিনী, লগ্ন ঊষা, হেমলক, দীপ্তি, সুচেতনা, রুদ্রবীণা, আশাবরী, অনামী ও সোপান সহ জেলার এবং জেলার বাইরের অনেক পত্র-পত্রিকা। নিজে প্রকাশ করলেন ‘খড়গ’ পত্রিকা। এখান থেকেই মাদল পত্রিকার উদ্যগে প্রকাশিত হল তাঁর নির্বাচিত কবিতার বই ‘মাটিতে হৃদয় আকাশে দৃষ্টি’। প্রকাশিত হল তাঁর ৫০০ পৃষ্ঠার আত্মকথা – ‘একটি প্রচ্ছদপটের গল্প’। গ্রন্থে চারণকবির বোহেমিয়ান জীবনের প্রতিচ্ছবি পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় পাঠককে মোহিত করে। সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন, চলচ্চিত্র সর্বত্র তাঁর উপস্থিতি আমাদের চমকিত করে। বাঁকুড়ায় থাকার সময়ে তিনি নিজের শিক্ষক ও পুরাতত্ত্ব গবেষক ডঃ মাণিকলাল সিংহকে নিয়ে তৈরি একটি তথ্যচিত্রও পরিচালনা করেন।
১৯৯৫এর ৩রা সেপ্টেম্বর কবির ৬৪তম জন্মদিনে যখন বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর পৌরসভা দ্বারা তাঁকে নাগরিক্ সম্বর্ধনা দেওয়া হল বাঁকুড়ার পৌরভবনের হলঘর মানুষের ভিড়ে উপচে পড়েছিল। অনুষ্ঠানের সভাপতি কবি রূপাই সামন্ত সেদিন তাঁকে ‘বাঁকুড়ার কবিকুল শিরোমণি’ সম্মানে ভূষিত করলেন। চারণকবি বৈদ্যনাথ তাঁর আজানুলম্বিত রক্তবসন, শ্বেতশুভ্র একমাথা চুল ও একমুখ দাড়ির মাঝে প্রশস্ত বুকে ভালবাসায় টেনে নিতেন তরুন প্রজন্মের সকলকেই। শুধু কবিতা লেখা নয়, কম্বুকণ্ঠে একনাগাড়ে আবৃত্তি করতে পারতেন অনেক কবিতা, অনেকের কবিতা। আর বলতেন – “প্রতিষ্ঠা নয় প্রত্যাশা হে প্রতিষ্ঠা নয় প্রার্থনা / প্রতিষ্ঠা যার হাতের মুঠোয় প্রতিষ্ঠা তার স্বার্থ না”। বলতেন – “সার্থক কিছু রসের সৃষ্টি / যদি পারি আমি করতে/ হাসতে হাসতে যেতে রাজি আছি / তাহলে নরক গর্তে / স্বর্গলাভের একটুও নেই কামনা / পৃথিবীকে ছেড়ে / মানুষকে ছেড়ে অন্য কোথাও যাব না”। ২০০০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর প্রাণখোলা হাসি এবং প্রেম-প্রতিবাদের কলম চিরতরে স্তব্ধ হয়ে পড়লেও তিনি এবং তাঁর কবিতা আমাদের হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকবে চিরকাল। বিষ্ণুপুর শহরে গঠিত হয়েছে ‘চারণকবি বৈদ্যনাথ আকাদেমি’।এই আকাদেমির উদ্যোগে প্রতিবছর কবির জন্মদিন ও মৃত্যুদিনকে কেন্দ্র করে তাঁর জীবন ও কবিতা নিয়ে চর্চা ছাড়াও চালু হয়েছে বৈদ্যনাথ স্মৃতি পুরস্কার। মন্দিরনগরি বিষ্ণুপুরকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করতে প্রশাসন নানান উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল বিষ্ণুপুরের সরকারি ভবনের দেওয়ালগুলি চারণকবির কবিতায় সাজানো হয়েছে। আরও আনন্দের কথা, আশার কথা তাঁর কবিতাকে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।