জন্ম উত্তরবঙ্গে হলেও পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা কলকাতাতেই। অক্ষরজ্ঞানহীন শৈশবাবস্থা থেকেই তাঁর সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগ কিন্তু সাহিত্য রচনার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন পরিণত বয়সে এসে। শুরু হয়েছিল অনুবাদকর্মের মধ্যে দিয়ে। পরে স্বকীয় রচনাতেও মগ্ন হয়েছেন। সম্প্রতি ব্রততীর ছোটগল্পের একটি সংকলন "কোজাগরি" প্রকাশিত হয়েছে।
পুজোর বোধন
আজ সকাল থেকে আমার ভারি ব্যস্ততা। নিখিলেশ অফিস বেড়িয়ে যেতেই আমি ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। হাতে ছাতা, বগলে ব্যাগ, কাঁধে আর হাতে ঢাউশ ঝোলা সামলে রওনা হলাম পুজোর বাজার করতে। হাতে এক লম্বা লিস্টি তাই সক্কাল সক্কাল বেরিয়েছি। মিমি কলেজ আর বুবান অফিস যেতে আর দেরি করিনি, ফাঁসির খাওয়া যখন খেতেই হবে বিলম্বে কাজ কী? রান্না-বান্না সারতে গেলে কিছুই হবে না তাই ঠিক করলাম বাইরেই কিছু খেয়ে নেব। এদিকে দেখো টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে, দুত্তেরি!
শাশুড়ির গঙ্গা-যমুনা পাড়ের ঢাকাই, শ্বশুরের জন্য তসরের পাঞ্জাবী, ভাসুর আর দেওরের অ্যালেন সালী ফর্ম্যাল টি শার্ট, দু জায়ের জন্য মটকা সিল্ক, এছাড়া মিমি, বাবান, গুড়িয়া, ছোটুর জন্য প্লাজো, কুর্তি, বেবি ফ্রক, বাবা স্যুট, সায়া-ব্লাউজ উফফফ বাবা রে বাবা… কাঁধের ব্যাগ হাল্কা হচ্ছে আর হাতের ব্যাগ ক্রমশ ভারি হচ্ছে। আর কী ভিড়, কী ভিড়! উপছে পড়া ব্যাগ আর উপছে পড়া জনস্রোত ঠেলে যাওয়া যেন খড়কুটোর খরস্রোতা নদীর উজান বেয়ে চলার মতই দুরূহ! এই জন্য আমার ছেলে মেয়ে বলেছিল অন-লাইনে কেনাকাটা সারার কথা। আসলে বছরে এই একবারই তো দেওয়া-থোওয়া। নিজের হাতে করতে পারলে একটা তৃপ্তি হয়।
এক বোতল ঠান্ডা পানীয়ে গলা ভিজিয়ে দ্বিতীয় দফা শুরু হল। আজ আমি ধনুক ভাঙা পণ করে বেরিয়েছি যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ…রোজ রোজ এই খুচরো যুদ্ধ আমার পোষাবে না। আজ এস্পার ওস্পার করেই ফিরব। যা যা কেনার আজই সারব…অন্তত নব্বই শতাংশ তো খতম করতেই হবে। আমার এই রণং দেহী মূর্তি দেখেই আমার ছেলে বলে দিয়েছে”আজ জয়ী হয়েই ফিরো,মা…!”
বেলা সাড়ে তিনটেয় পেটে ছুঁচোর কেত্তন শুরু হল আর একটু অবসন্ন লাগছিল। কিন্তু কী করব, গত দু বছর মা, বোন, মাসি, মামীশাশুড়ির টাকাগুলো সব জমা ছিল। এবার না কিনলে সব তেড়ে তেড়ে আসবে বকাবকি করতে। তাই নিজের জন্য একটা খাদি সিল্ক, নারায়ণপেট আর কলমকারি কিনলাম। আর দশমীর দিন ঠাকুর বরণ করে সিঁদুর খেলব বলে চওড়া লাল পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ি কিনলাম। সবাই বলে আমায় তাঁতের শাড়িতে খুব মানায়…চওড়া লাল পাড়ের শাড়ি, সিঁথিতে সিদুর,কপালে মস্ত লাল টিপ, কানে ঝুমকো পাশা, গলায় বিছে হার, দু হাতে মকরমুখী বালা পরে আর এলো চুলে নাকি আমায় মা দুর্গার মত লাগে। আর নিখিলেশ অবশ্য বলে আমার টিকোল নাকের হিরের নাকছাবিটির আলোর ঝলকানি থেকে ও চোখ সরাতে পারে না…যাই হোক ব্যাগপত্তর নিয়ে একটা রোডসাইড রেস্তোরাঁ গোছের দোকানে বসে খাওয়ার কিছু অর্ডার দিয়ে ফর্দটা মেলাতে বসলাম…কাজের মাসি, মলিনা, দুধওয়ালা, জমাদার, ফুল দেয় যে ছেলেটি…সবারটা হয়েছে তো…আর কিছু? হঠাৎ ঠক করে শব্দ করে ওয়েটার এক প্লেট চিকেন চাওমিন দিল টেবলের ওপরে। খুব খিদে পেয়েছে, প্রায় হামলে পড়লাম। কিন্তু চোখ পড়ল রেস্তোরাঁর বাইরে একটি মেয়ের ওপর…ফুটপাতে পা ছড়িয়ে বসা এক মা, ছিন্ন মলিন বসন, এলো চুলে একটি ছোট ফ্রক মেরামত করছে। আর তার এক জোড়া কন্যা তাকে চারদিকে ঘিরে ঘিরে খুব খেলা করছে। যেটি ছোট সেটা বারেবারে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের মনঃসংযোগের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। তবে মা-টি একেবারে নির্বিকার, দুই মেয়ের দৌরাত্ম্যেও সে অবিচল মুখে সতর্কভাবে সে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি খাওয়া ভুলে গিয়ে হাঁ করে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম। পুজো আসন্ন, জামাটার ছেঁড়াফাটা সারিয়ে মেয়েটার গায়ে চড়াতে হবে তো! সেলাই সমাপ্ত করে এবার বড়টিকে ধরে সামনে বসিয়ে একটা ভাঙা চিরুণি দিয়ে জট পাকানো, রুক্ষ্ণ চুলগুলো অসীম মমতায় আঁচড়ে দিতে লাগল। একটা নিটোল সাংসারিকতার দৃশ্য ফুটে উঠল আমার সামনে। মাটির বাড়ির নিকোন উঠোন রাংচিতার বেড়া ঘেরা, তুলসী মঞ্চের পাশে একটা গোলাঘর। পড়ন্ত রোদ্দুরে চড়াই এসে খুঁটে খাচ্ছে দানা। মা তার সন্তানের পরিচর্যায় ব্যস্ত। তার ত্রিনয়নে গার্হস্থ্যের লক্ষ্মীপ্রদীপের স্নিগ্ধ আলো বিকিরিত হয়। এরা মেদনীপুর, সুন্দরবন বা বাঁকুড়ার যে কোন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেই আসুক না কেন বুকে করে নিয়ে এসেছে এক নিটোল সংসারের চিত্র। এই মহানগরীর রাজপথের ধারে হাঁড়ি কড়াই ইটের উনোনে দৈনন্দিনতা সারে। দেওয়ালে পেরেক গেঁথে ছেঁড়া ক্যালেন্ডারে মা দুর্গার ছবি ঝুলিয়ে দু বেলা ভক্তি ভরে পুজো করে। কামনা করে মা দুর্গা তার সন্তানদের রক্ষা করুক রাজনগরীর আসুরিক প্রাবল্যের হাত থেকে। ঘর বসায় ফুটপাথের এক কোণে, নিটোল তুলসি মঞ্চে মাটি লেপা থাকে। এদের চোখে দারিদ্র্যের মলিন অঞ্জন অথচ মুখে হাসি। বাংলার ঘরের চিরকালীন মাতৃসত্ত্বার চিরন্তন মঙ্গলমূর্তি!
আমি ব্যাগ হাটকে জায়ের মেয়েদের জন্য কেনা দুটো ফ্রক আর আমার লাল-পাড় তাঁতের শাড়িটা বার করলাম। ওয়েটারকে ডেকে একশোটি টাকা ওর হাতে গুঁজে বললাম আমি চলে গেলে এই কাপড়ের প্যাকেট তিনটে ঐ মায়ের হাতে দিতে। অভুক্ত খাবার প্লেট ফেলে রেখে, ওয়েটারের হতবাক দৃষ্টির সামনে থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার পেট না ভরুক, মন ভরে গেছে। পশ্চিমাকাশের সূর্যের শেষ অস্তরাগ দশমীর সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছে, রাস্তার দু পাশে ছাতিমফুলের গাছ সান্ধ্য-সৌরভ বিকিরণে প্রস্তুত। আমার পুজোর ঢাক বেজে উঠেছে।