• Uncategorized
  • 0

গল্পে বিতস্তা ঘোষাল

ব্লার্বে যে কথা লেখা হয়নি

ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ক্লান্ত স্বরে মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, মা আসছি।
আয়, আমার আর ভালো লাগছে না। ভয় করছে।
কেন বাবান নেই বাড়িতে?
আছে, কিন্তু …
শরীর ঠিক লাগছে তো! কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাতো! মেয়েটি একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চায়।
না, না, ওসব কিছু না। তুই চলে আয়। অনেকক্ষণ হয়ে গেল তোকে দেখিনি। ওপ্রান্ত থেকে ম্রিয়মাণ স্বর ভেসে আসে।
মেয়েটি এবার শান্ত হয়। সে বোঝে নাতির সঙ্গে সারাদিন বকবক করলেও এখন তাকেই দরকার। বলে, আসছি মা। আর মিনিট কুড়ি ।
ফোন রেখে বইগুলো তাকের একপাশে সরিয়ে মেয়েটা বিলবই মিলিয়ে টাকাটা গুনল। আজ বিক্রি খুব বেশি হয়নি। যেটুকু হয়েছে সেটুকুই পরম মমতায় লাল ব্যাগটায় সযত্নে রাখলো। ধীর পায়ে বাইরে এল। কোলাপসিপল গেটটা টেনে তালা লাগালো। তারপর নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল- আঃ এতক্ষনে মুক্তি।।
সমানে মাইকের আওয়াজ আর তারস্বরে গানের চোটে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল তার। এবার যেন মাথা,কান সব বিশ্রাম পাবে।
সে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে একটা শ্বাস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে মোড়ের মাথায় গিয়ে অটোর অপেক্ষা করতে লাগল।
শরীর চলছিলো না তার। কোন্ কাক ভোরে উঠে সংসারের সব কাজ সেরে বেরিয়েছিল সে। মেট্রোর ঠেলাঠেলি, অটোর দীর্ঘ লাইন সামলে এগারোটার মধ্যে অফিস। সেখানেও একদফা লড়াই চালানো। তারপর সেখান থেকে চারটের মধ্যে মেলায় ঢোকা। কাস্টমারদের সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে প্রোডাক্ট বিক্রি করেছে সে হাসিমুখে এতক্ষণ। কখনো কখনো বিরক্ত হয়েছে প্রশ্নের ধরণ দেখে। আবার মজাও লেগেছে এদেশে শিক্ষার অবস্থা দেখে।
আর সবচেয়ে অবাক হয়েছে, ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলোকে দেখে, যারা ছবির বই হাতে তুলে নিয়েছে পরম আনন্দে, আর তার মা তাকে টানতে টানতে স্টলের বাইরে নিয়ে গেছে, এসব ছবি আঁকা, বই পড়া সময়ের অপচয় বলে। আর একটা বিষয় তাকে হতাশ করেছে, এই বাচ্চারা কেউ বাংলা জানে না, অথচ মা সেটা বেশ গর্বের সঙ্গে বলছে।
সেইমুহূর্তে তার মনে হয়েছে আসলে কেউ স্বাধীন হয়নি, এখনো সন্তানকে গোলাম বানাবারই প্রচেষ্টায় রত অভিভাবকরা। অথচ অন্য রাজ্যে মাতৃভাষা প্রথম,পরে বিদেশী ভাষা।
এসব নানা বিষয় ভাবতে ভাবতে সে অটোতে উঠে।
ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। বিকেলের দিকে হালকা মেঘ আর ছিটেফোটা বৃষ্টি দেখে মন কূ ডেকেছিল।এখন হাওয়াটা ভালো লাগছে। তার দুচোখের পাতায় আজন্মের ঘুম। অথচ বাড়ি ফিরেও বিছানায় যেতে পারবে না। কোনোরকমে স্নান পুজো সেরেই রান্না ঘরে ঢুকতে হবে। বৃদ্ধা মা, ছেলে সবাই অপেক্ষা করছে তার জন্য। সে গিয়ে গরম রুটি, ভাত, তরকারি বেড়ে দিলে তারা খাবে।
ছেলে অবশ্য একটু রাত করেই খায় এসব দিনে, মা যখন মেলা সামলায়। মা ফিরলে সারাদিন যা যা ঘটেছে সব ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্ণনা করে, জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ আদর খায়। তবেই তার শান্তি।
ঘরে ঢুকে পোশাক বদলাতে না বদলাতে, বৃদ্ধা মা পাশের ঘর থেকে ডাকে, এলি? আয়, দেখি মুখটা।
সে সামনে গিয়ে হাসি মুখে দাঁড়ায়।
একগাল হেসে পরমুহূর্তেই উৎকন্ঠা মাখা কন্ঠস্বরে তিনি বলেন, কালো লাগছে খুব। খেয়েছিলি কিছু?
আলতো করে মাথা নেড়ে সে বলে, হুম। চা মুড়ি। তুমি খেয়েছিলে কিছু?
ওই একটু চা বিস্কুট। কিন্তু এতটুকু খেলে তোর শরীর ঠিক থাকবে কী করে! গলায় উদ্বেগ নিয়ে তিনি বলেন।
সে কথার উত্তর না দিয়ে মেয়েটি বলে, কেন? কনিকা মুড়ি দেয়নি? এতক্ষণ এভাবে থাকতে হয়! আলতো স্বরে বকুনি দেয় মাকে।
মুখটা করুণ করে অভিমানী চোখে মেয়ের দিকে তাকায় সে।
বকিস না। তারপর আস্তে আস্তে বলে, তুই খেতে না দিলে পেট ভরে না যে।
মেয়েটি বুঝে উঠতে পারে না সে মেয়ে না মা! দুই বিনুনী আর ছাপছাপ ম্যাক্সি পরে বসে থাকা সত্তর উর্দ্ধ মহিলাকে তখন তার ছোট্ট একটা পুতুল মনে হয়। সে দুটো গাল টিপে আদর করে বলে, এমন করলে হবে মা? খেতে হবে তো। আমি কী সব সময় থাকব?
ভদ্রমহিলা মেয়ের হাত চেপে ধরে। ভগ্ন গলায় বলে, কোথায় যাবি তুই আমাকে ছেড়ে? আমার কী হবে তুই না থাকলে ?
মেয়েটির ভীষণ ইচ্ছে করে বলতে, মা কারোর জন্য কেউ থাকে না। কোনো স্থান শূণ্য থাকবে না। আমি না থাকলেও সব ঠিক চলবে ।
কিন্তু কিছু না বলে, কেবল বলে, আচ্ছা হয়েছে, আর ঠোঁট ফোলাতে হবে না। এবার রান্নাঘরে যাই, দেখি কী করতে হবে! খেতে দিই। খিদে পেয়েছে তো!
এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হেসে মহিলা বলে, যা, খুব খিদে পেয়েছে।
হুম। কী খাবে? ভাত না রুটি?
একটা রুটি দিবি। আর অল্প দুধ। বেশি খাইয়ে খাইয়ে তুই আমাকে মোটা করে দিচ্ছিস।
আচ্ছা বেশ, বলে হেসে মেয়েটি রান্নাঘরে যায়।
সব কাজ মিটিয়ে যখন ক্লান্ত শরীরটা টেনে নিয়ে যায় বিছানায়, তখন ছেলে নিজের সারাদিনের জমানো কথার ডালি উজার করে দেয়।
মা, আজ কলেজে আমি একটা প্রশ্নের ভালো উত্তর দিয়েছি। শুনবে তুমি কী বলেছি?
চোখের পাতা জুড়িয়ে এলেও মেয়েটি বলে, হ্যাঁ বল।
উৎসাহ পেয়ে ছেলে বলে, আজ ডেমোক্রেটিক শব্দের বিশ্লেষণ করে স্যার বললেন, তোমাদের কী মনে হয়  সংবিধানে ডেমোক্রেটিক বলতে যা বোঝানো হয়েছে, আসলে তা সত্যি? বিতান আর শামিম উত্তর দিল, কিন্তু তা স্যারের মনোমত হল না।
তারপর তুমি বললে? সে ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ ,বললাম, আসলে এটা একটা রিলেটিভ টার্ম। দেশ এবং সোসাইটি, ইকোনমিক স্ট্রাকচারের উপর নির্ভর করছে পুরোটাই।শুনতে শুনতে মেয়েটির হাই ওঠে। সে আর চোখের পাতা খুলে রাখতে পারে না। তার মনে হয় একটা দীর্ঘ দিন কেটে গেল। কাল সকাল থেকে আবার যুদ্ধ। মনে মনে তারই প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। বইয়ের পাতাগুলো যেন তার যুদ্ধ ক্ষেত্র, কলম অস্ত্র । আর কত টাকা দিনের শেষে ঘরে এল, সেটা যেন তার শত্রু নিধনের পর প্রাপ্তি।
প্রতি রাতে সে নিজেকে টার্গেট দেয়, আগের কাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, কী কী বিষয়ে সে ব্যর্থ আর কেন জয় এলো না তার মূল্যায়ন চলে মাথার মধ্যে। পরের দিনের যুদ্ধ ক্ষেত্র নিজেই ঠিক করে, নিজের চারদিকে ঘুঁটি সাজায়- এক, দুই তিন…। নিজেই নিজেকে শত্রু বানায়, জয়ের প্রত্যয়ে চোয়াল দৃঢ় করে, তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুমের মধ্যে সে দেখে সমস্ত শহর জুড়ে তার সংস্থার হোর্ডিং, দেশ বিদেশে সে তার কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করছে, যেখানে যাচ্ছে সেখানেই তার কথা শোনার জন্য উত্তেজনা।
সে শান্ত ভাবে বলে যাচ্ছে, সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য নিয়ে নানা কথা। বলছে, পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। শুধুমাত্র ভালবাসাই চিরস্থায়ী। যুগ যুগ ধরে এত অঘটন, অন্যায়, পাপ হওয়া সত্ত্বেও মানব সভ্যতা টিকে আছে। তার কারন মহামানব, আর যোগী পুরুষদের ভালোবাসার বার্তা, শান্তির বাণী প্রচার। তাই ভালোবাসার ফুল ফোটাতে হবে। ভালোবাসাই পারে চন্ডাশোককে জয় করতে। বিজ্ঞান যদি পারমানবিক বোমা বানাতে পারে, তবে ভালোবাসার বোমাও বানাতে পারবে। প্রয়োজনে মাতৃগর্ভে ভ্রুণের মধ্যে ভালোবাসার হরমোন অধিক পরিমাণে ইনজেক্ট করতে হবে, যাতে যে শিশু জন্মাবে সে শুধু ভালবাসতেই শিখবে। লোভ, হিংসা, ঈর্ষা, সংকীর্ণতা তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। তবেই আগামী পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে।
সে এসব স্বপ্ন দেখতেই থাকে যতক্ষণ না পাশের ঘর থেকে তার বৃদ্ধা শাশুড়ি মা ডাকে, রুমন, একটু আসবি? বাথরুমে যাবো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।