ডুংরীর মাথায় একাকী দাঁড়িয়ে থাকা ছাতিমগাছের তলায়ইজেলটা সেট করা। সূর্যটাকে ঈষৎ পশ্চিমে রেখে এমন একটা অ্যাঙ্গেল তৈরী করা হয়েছে যে ডুংরীর মাথায় চন্ডীমন্দির, আশেপাশের ছড়িয়ে থাকা বোল্ডারস্, রকস্ আর ইতিউতি উঁকি দেওয়া কয়েকটাগাছই ক্যানভাসে টার্গেট পয়েন্ট। পেন্টিং অবজেক্ট। এই জায়গাটা প্রাঞ্জলের পূর্বপরিচিত। অতীতে বেশ কয়েকবার এসেছেন। বেড়াতে। ছবি আঁকতে। নেচার স্টাডির কাজে।
আঘরপুর ডুংরী। নেচার পেন্টিং-এর এক মায়াময় জগৎ। আউটডোর পেন্টিং লোকেশন হিসেবে দুরন্ত একটা স্পট। ডুংরীর একদিকে সবুজ গালিচা মোড়া অনুচ্চ ঢাল বেয়ে নেমে গেছে গ্রামের দিকে। পায়ে পায়ে হাঁটা পথ সবুজ গালিচাকে সিঁথির মতো চিরে এগিয়ে গেছে গন্তব্যের দিকে। অদূরে পুরুলিয়া গর্ভমেন্ট ইন্জিনিয়ারিং কলেজ। অপর দিকের ঢাল নেমে এসেছে মোরামের রাস্তায়, ধানখেত আর পুরুলিয়া– কোটশিলা মিটারগেজ সিঙ্গেল রেল লাইনের দিকে। সবুজ গাছগাছালি আর দূরের ধানখেত গুলোতে শরতের মধ্যাহ্নে তরতাজা যুবতী হিল্লোল। দিগন্তে ক্রমশ অপসৃয়মান আকাশ আর মাটির আলাপন।
আঁকার জন্য নির্বাচিত ফ্রেমের ওপরের কোনায় ধরা পড়েছে, নেমে আসা ছাতিম পাতা সহ কয়েকটি ডাল। সুনীল আকাশের বুকে শরতের মেঘালি বাহিনী। পারফেক্ট নেচার ফ্রেম। প্রাঞ্জল এক মনে ব্রাশ চালাচ্ছেন । ফিরোজা ব্লু রঙের সাথে সাদা মিশিয়ে ঘন থেকে হালকা প্রলেপ। ক্যানভাসের আকাশ সাজছে শরৎ নীলিমায়। মন্দিরের গায়ে চাপানো রঙটাও প্রাঞ্জলের খুবই পছন্দের। সাদা আর লাইট অ্যাকুয়া-মেরিনের অদ্ভূত কম্বিনেশন। সূর্যের আলোছায়ায় জীবন্ত সঙ্গম। তারিফ করতেই হয় রঙ বাছাইয়ের শিল্পীসত্তার। আপন মনে এঁকে চলেন প্রাঞ্জল । নির্জন প্রকৃতির বুকে তুলির প্রতিটি টানে নিমগ্ন সাধকের প্রকৃতি বন্দনা। রং, তুলি, প্যালেট আর তারপিন তেলের গন্ধে মিশেছে ছাতিম সুবাস। মাঝে মাঝে একটু অপেক্ষা। রঙের ওপর রঙ চাপাতে যে সময় ব্যয় করতে হয়, ততটুকুই।
আসুন, শিল্পীকে তার ছবিটি একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিই। ততক্ষণ জেনে নিই তার ব্যক্তিজীবনের কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য। প্রাঞ্জল রায়। বয়স আটচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ, কাঁচা পাকা অবিনস্ত চুল। চওড়া কপাল, মাঝারি গড়ন, মাঝারি উচ্চতা। স্মার্ট এপিয়ারেন্স। বাবা স্বর্গীয় পরিতোষ রায়। সাকিন পুরুলিয়া শহরের মুনসেফডাঙ্গা। বনেদী পরিবার। বাবা ছিলেন পুরুলিয়া জেলা আদালতের নামকরা অধিবক্তা। পসার ছিল তেমনই। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর প্রফেশনে আসুক। বিধাতার ইচ্ছে ছিল ভিন্ন। প্রাঞ্জলের হাতে আইনের বইখাতার পরিবর্তে তুলে দিয়েছেন রং, তুলি, প্যালেট। আইন কলেজের পরিবর্তে নিয়ে গিয়েছেন আর্ট কলেজে। যেখানে প্রাঞ্জলের চিত্রশিল্পী হিসেবে উত্তরণ।
প্রাঞ্জল রায় বর্তমানে স্বনামখ্যাত চিত্রকর। স্বদেশে, বিদেশে বহু নামীদামী কর্পোরেট সংস্থা, হোটেল ব্যাঙ্কোয়েটে তার ছবি শোভা পায়। কখনো কলকাতা, কখনো দিল্লী, মুম্বাই। আবার কখনো, লন্ডন, ফ্রান্স, টোকিও, সিঙ্গাপুর। এক্জিবিশন। সেল। কনফারেন্স। তবু ভোলেননি নিজের মাটির টান। ভোলেননি নিজের জেলার কোণায়, কোণায় ছড়িয়ে থাকা আবিল সৌন্দর্য। যখনই সুযোগ পান ছুটে আসেন পুরুলিয়ায়। নিজের খেয়ালে ক্যানভাসে তুলে নেন অপরূপা পুরুলিয়ার প্রকৃতিকে।
মশগুল প্রাঞ্জল, মশগুল প্রকৃতি চিত্রণে। খেয়ালই করেননি যে তার আজকের আউটডোর পেন্টিং এখন আরো একজোড়া আবিষ্ট চোখের নিবিড় পর্যবেক্ষণে। রিলিফের রোড ধরে ডুংরীর মাথায় ধীরেধীরে কখন উঠে এসেছে, এক উনিশ কুড়ির তরুণী। প্রাঞ্জল লক্ষ্যই করেননি। শেষ তুলির টান থামতেই কানে এলো,
এর উত্তরে কেমন যেন ইতস্তত করছে মেয়েটি। প্রাঞ্জল প্যালেট আর তুলিগুলো তারপিন তেলে ধুয়ে প্যাক আপ করতে থাকে।
–” না, মানে… আমার মা… ” কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল মেয়েটি। নিরবতায় কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল।
প্রাঞ্জল–ই কথা শুরু করলেন –” তোমার নামটা তো জানা হলো না? “
–” আমি দিতিপ্রিয়া, দিতিপ্রিয়া সরকার”
–” আমি প্রাঞ্জল রায়। ছবি আঁকি। তুমি কি করো?”
কিছু দূরে ইন্জিনিয়ারিং কলেজটির দিকে পয়েন্ট আউট করে দিতিপ্রিয়া। –” আমি ঐ কলেজের ইলেকট্রনিক্স স্ট্রীমে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী।”
–” ব্রাভো, ক্যারি অন, সুইট লেডি।”
–” থ্যাংকস আঙ্কেল। একটা রিকোয়েস্ট করবো?”
–” সার্টেনলি, ডিয়ার”
–” আমার একটা পোট্রেট করে দেবেন?”
প্রাঞ্জল খানিকটা থতমত খান। আনএক্সপেক্টেড এই রিকোয়েষ্টে কেমন আনইজি ফিল করেন। প্রফেশন্যাল প্রাঞ্জল, বিখ্যাত নেচার পেন্টার প্রাঞ্জল, পড়ল এক আনটোলড ডিলেমায়।দিতিপ্রিয়া কোন উত্তর না পেয়ে আবার অনুরোধ করে –” আঙ্কেল, প্লীজ, অন্ততঃ একটা রাফ স্কেচ।”
–” ওয়েল, সুইট লেডি, আই উইল ডু। বাট…”
–” বাট! ” দিতিপ্রিয়া অধীর আগ্রহে জানতে চায়।
–” দেয়ার ওয়াজ এ হিস্টরী বিহাইন্ড মাই পোট্রেট পেন্টিং। আই হ্যাভ নট ড্রন এ সিঙ্গেল পোট্রেট ফর লাষ্ট টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার।” প্রাঞ্জল থামেন। থামতেই হয়। শরতের পড়ন্ত বিকেলে দিতিপ্রিয়ার একটা সামান্য অনুরোধ যে তার বুকে এভাবে মোচড় দেবে, জাগিয়ে তুলবে চাপা পড়া অভিমান।কল্পনা করেননি তিনি।
দিতিপ্রিয়া বয়সে অনেকটাই ছোট । তবু, প্রাঞ্জলের মনের মধ্যে চলতে থাকা অস্থিরতাকে অনুভব করে।
–” আই শ্যাল নট আস্ক দ্য রিজন। বাট, ইফ ইউ উইশ, ইউ ক্যান টেল মী। পারহ্যাপস ইট মে গিভ ইউ সাম রিলিফ।” দিতিপ্রিয়া প্রাঞ্জল কে জড়িয়ে ধরে। এক অচেনা অজানা হাঁটুর বয়সী যুবতীর কাছে পাওয়া স্নেহ অন্তঃসলিলা কান্নায় ভিজে যায় প্রাঞ্জলের হৃদয়। সংযত হতে ক্ষানিকক্ষণ সময় নেন প্রাঞ্জল।
–” কিছু মনে করো না, দিতি। ইট‘স অ্যা স্টোরি অফ অ্যান আনফরচুনেট ইয়াং আর্টিস্ট হু লষ্ট হিজস্ লাভ।”
–” না, তার কোন দোষ দেখি না, গো মেয়ে। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে, বাবা মার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাবার মতো সাহসী করে সমাজ তাকে গড়ে উঠতে দেয় নি,” বলে চলেন প্রাঞ্জল।” ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার দের তুলনায় একজন অনামী চিত্রশিল্পী কতোটা আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারবে– এটাই কোটি টাকার প্রশ্ন হয়ে ফিরে ফিরে এসেছিল আমাদের জীবনে। তার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী ইন্জিনিয়ার। নিশ্চিত ইনকাম। সেটেল্ড লাইফ।” প্রাঞ্জল কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েন।
“আমার সেই প্রেমিকার সাথে এখানে আমি বেশ কয়েকবার এসেছিলাম। এই যে বিচিত্র ভঙ্গিমায় পড়ে থাকা পাথরগুলো দেখছো, এগুলোর ওপর বসে এঁকেছি অনেক পোট্রেট। কিন্তু তার বিয়ে হয়ে যাবার পর আজ পঁচিশ বছর হয়ে গেল, আর কোন পোট্রেট আঁকি নি আমি।”
দিতিপ্রিয়া নির্বাক শ্রোতার মতো মন দিয়ে শুনছিল প্রাঞ্জলের অতীত ইতিহাস।
প্রাঞ্জল থামলেন। হয়তো লজ্জা পেলেন নিজের প্রগলভতায়। এই টুকু একটা মেয়ের সামনে কেন বলে চলেছেন তার অতীতকথা, তিনি নিজেই বুঝতে পারছেন না। তারপর, দিতিপ্রিয়ার হাত ধরে সামনের একটা পাথরের ওপর বসান। ব্যাগের ভিতর থেকে স্কেচবুকটা বের করেন।
সূর্যের পড়ন্ত আলোয় রক্তিম হয়ে উঠেছে পশ্চিম আকাশ। সোনাঝরা রোদ এসে পড়েছে দিতিপ্রিয়ার মুখে। হাতের দ্রুততায় সাদা কাগজে ঝড় উঠেছে যেন। দু একবার দিতিপ্রিয়ার দিকে তাকালেন ঠিকই। কোথায় যেন মিলে যাচ্ছে মুখ। মুখের আদল। নীরবে এঁকে চলেছেন প্রাঞ্জল। নীরবতা কখনো কোন কথা বলে কি? মনে মনে? প্রাঞ্জল অদ্ভূত ভাবে এখন মৌণ মুখর। আঃ অদিতি নড়ছো কেন? একটু স্থির হয়ে বসো। আর বেশীক্ষণ নেব না। হয়ে এসেছে। স্টেডি। নড়বে না। নড়বে না, প্লিজ। প্রাঞ্জল ফিরে যায় পঁচিশ বছর আগেকার এক শরৎ গোধূলিবেলায়। চোখের সামনের সমস্ত পট পরিবর্তন হয়ে যায়।
–” আঙ্কেল, ক্যান আই হ্যাভ এ লুক?” দিতিপ্রিয়া উৎসুকভাবে প্রশ্ন করে। সম্বিৎ ফেরে শিল্পীর।
–” আরে আপনি কার ছবি এঁকেছেন?” দিতিপ্রিয়া র প্রশ্নে স্কেচটাকে ভাল করে লক্ষ্য করেন প্রাঞ্জল। সত্যি তো। এতো দিতিপ্রিয়া নয়। পঁচিশ বছর আগেকার অদিতি।
দিতিপ্রিয়া স্কেচবুকটা বুকের কাছে তুলে ধরে। ভাল করে লক্ষ্য করার পর স্কেচ টা প্রাঞ্জলের দিকে ফিরিয়ে বলে, — ” আমার মা”।