• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় আলম তৌহিদ

এক মধ্যবিত্ত নারী গল্পটি বলেছিল

আমার মা প্রতিবেশির কাছে প্রায় গল্প শুনান, আমি নাকি বয়সের অনুপাতে বাড়ন্ত কথাটির গুঢ় অর্থ বুঝার মস্তিস্ক তখন আমার ছিলনা তবে দর্পণে নিজের এপিট-ওপিট দেখার আনন্দগুলো ঘুড়ির মতো উড়াতাম মেঘের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ উন্নত হওয়া বুকের উপর হাত রেখে ভাবতাম- এই আমার অহংকার
এক হিরণ্ময় বিকেলে আমি নদীর ধারে গিয়েছিলাম দূর্বার স্রোতের মতো আশ্চর্য একসত্য উপলব্ধি এলো আমার ভেতর আমার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে যেন বহু অপ্রকাশিত মানুষের অস্তিত্ব ; বুঝতে পারলাম এইসব অস্তিত্বকে প্রকাশের মাধ্যমেই আমার বিকাশ পূর্ণাঙ্গ হবে আমার নারী সত্ত্বা আমি হবো তখন কবিদের বেঁধে দেয়া নদীর উপমা
একদিন আমার স্নেহময়ী জননী আমাকে কাছে ডাকলেন তারপর আমার সর্বাঙ্গে দিলেন পর্দার আড়াল মনে হলো, এক পূর্ণাঙ্গ নারী কালো আলকেল্লার নির্মম সেলাইয়ে বন্দী হয়ে পড়েছি পৃথিবী আমার কাছে খুব ছোট হয়ে এলো পিপীলিকার স্বাধীনতায় আমি ঈর্ষান্বিত হতাম যখন-তখন আহা, আমার যদি এরকম স্বাধীনতা থাকত ! 
জানালার গ্রিলে মাথা রেখে আমি কতোবার নীলাম্বরী আকাশকে আমার অভিলাষের কথা জানিয়েছি আকাশ শুনেনি নীলাদ্র হয়ে উঠত মন তাছাড়া নীল রঙে ছিল আমার প্রবল আসক্তি একবার কলেজের এক বর্ণচোর সহপাঠি বলেছিল, পৃথিবীর তিন ভাগ নীল তোমার চোখে, আর তুমি দেখ আকাশ কেন ?
আমি ছিলাম উত্তরহীন নীলের ঘোর তখনো কাটেনি যখন আকাশে সাদাসাদা পুঞ্জপুঞ্জ মেঘ এলো, নদীর ওপারে গুচ্ছগুচ্ছ কাশ শারদ বাতাসে যখন চঞ্চল হয়ে উঠল ; আমার খুব মনে পড়তে লাগল তার কথা জানিনা সে এখন কোথায় 
প্রপাতের জলজ মূর্ছনা থেকে আমি আত্মস্ত করেছিলাম সঙ্গীতের পাঠ তানপুরায় যখন সারেগামা বেজে উঠত, পথচারী থমকে দাঁড়াত আমাদের সদর দরজার সামনে বাবার অনুশাসন ছিল কঠোর মেয়েদের উচ্চকন্ঠি হতে নেই তওবা কর এখন আমার আকাশে শুধু কালোমেঘ চোখের প্রস্রবণে মুছে গেছে সব নীল আমার বিবর্তন আমি দেখেছি মানুষ থেকে আমি এখন অন্য প্রজাতি
এভাবে এক সীমাবদ্ধ পারিবারিক বেষ্টনীর ভেতর আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম আমার জানা হলো না আমার প্রতিবেশী কে, পৃথিবীর রঙ কেমন কিন্তু মন কী বেষ্টনী মানে ? আমার মন তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল সেই কলেজ সহপাঠিকে, যার নাম সুনীল এক পড়ন্ত বিকেলে ঘর থেকে বের হলাম সুনীলের খোঁজে মা জিজ্ঞেস করলো-কোথায় যাচ্ছিস ? উত্তর আগে থেকেই রেডি ছিল, বললাম মন্দিরাদের বাসায় মা বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরবি আমি কোন জবাব দিলাম না মন্দিরাদের বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে আমার উপর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না কারণ মন্দিরা আমার ছোটবেলার বন্ধু এক সাঙ্গে খেলাধুলা করে বড় হয়েছি তাছাড়া মন্দিরাদের বাসা আমাদের বাসা থেকে খুব দূরে নয়; হেঁটে যাওয়া যায় মন্দিরার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সুনীলের খোঁজ-খবর নেয়া সুনীল মন্দিরার দূরসম্পর্কের কাজিন সুনীল এখন কোথায় আছে হয়ত মন্দিরার কাছ থেকে কিছু জানা যাবে
মন্দিরা দারুন বিস্ময় নিয়ে তাকাল আমার দিকে যেন সে আকাশ থেকে পড়ল সে বলল, অনেক দেরি করে ফেলেছিস নীলিমা সুনীলরা ঢাকায় চলে গেছে ওর চাকরি হয়েছে
এরকম একটি সংবাদের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না মনটা ভেতরে ভেতরে বিধ্বস্ত হতে লাগল কিন্তু মন্দিরাকে কিছুই বুঝতে দিলাম না 
ঢাকাতে কোথায় থাকে ঠিকানা জানিস ? 
না তবে ঠিকানা যোগাড় করতে পারব সময় লাগবে 
তাই কর 
মন্দিরাদের বাসা থেকে ফেরার পথে সুনীলের কথাই বেশি মনে পড়তে লাগল বিশেষ করে কলেজের শেষ দিন ঐ দিনই ছিল সুনীলের সাথে শেষ দেখা সেদিন সুনীল বলেছিল- “আকাশে নীলিমা আছে বলেই আমি সুনীল” অল্পভাষী সুনীল অল্পকথার মধ্যেই নিজেকে মহৎ করে তুলতে জানে আর প্রেমকে দিতে জানে বহুমুখি ভাষা যদিও তার প্রেমে এক মায়াবী রহস্যের প্রলেপ থাকে, তাকে আবরণ মুক্ত করা মোটেও কঠিন কিছু নয় মন্দিরা ঠিকই বলেছে আমি খুব দেরি করে ফেলেছি আসলে তাই এর কারণও ছিল মুসলিম পারিবারিক সংস্কারের মধ্য আমি নিজেকে যথাসময়ে তৈরি করতে পারিনি একজন হিন্দু পরিবারের ছেলেকে ভালোবাসতে গেলে যে স্রোতের প্রতিকুলে সাঁতার কাটতে হয় এবং তার জন্যে যতটুকু মানসিক শক্তির প্রয়োজন ছিল আমার মধ্যে তার ঘাটতি ছিল কিন্তু আমার মন, যাকে আমি বেঁধে রাখতে পারিনি কখনও প্রতিনিয়ত মনের নিশ্চুপ মনোবিদ্রোহে আমি জর্জরিত হয়েছি মনের মুখোমুখি দাঁড়ালে মন আমাকে বারবার শুনিয়ে দেয়- সুনীলই তোমার পুরুষ 
আমি জানি প্রতিটি নারীর ভেতর আছে শক্তির আধার কারোটা থাকে সুপ্ত অবস্থায় আবার কারোটা হঠাৎ জাগ্রত হয়ে উঠে যদি একবার জাগ্রত হয় তাকে থামানোর উপায় নেই আমার ভেতরে এখন সেই শক্তির উত্থান ঘটেছে এখন আমি সমস্ত সংস্কারের দেয়াল ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে পারি ইদানিং বাবা ঘরে না থাকলে আমি হারমোনিয়াম নিয়ে গান গায়তে বসে যেতাম আমার গানের গলা ভাল ছিল বলে সবসময় গানের প্রতি একটা দুর্বলতা অনুভব করতাম মা এসে স্মরণ করিয়ে দিত এই ঘরে গান গাওয়া নিষেধ তোর বাবা জানতে পারলে বকাঝকা করবে আমি মায়ের কথা না শুনার ভান করে গায়তে থাকতাম আজ কেন জানি মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে সুনীলের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে বাবা ঘরে নেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে খুব দরদ দিয়ে গায়তে থাকলাম- “আমার সকল দুখের প্রদীপ, জ্বেলে দিবস গেলে করব সমাপন……” হঠাৎ বাবা এসে উদয় হল হুংকার দিয়ে বলল- গান বন্ধ কর আমিও চুপ থাকতে পারলাম না বললাম- একটা গান গায়লে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না

কী আবার আমার মুখের উপর কথা বলা হচ্ছে বাবা উম্মাদের মতো চিৎকার করতে করতে হারমোনিয়াম দুহাতে তুলে নিয়ে সজোরে আছাড় দিল আমার চোখের সামনে সেটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম বাবা ফোঁস ফোঁস করতে করতে অন্য ঘরে চলে গেল আমার চোখ ফেটে জল এলো জীবনে এতো কষ্ট আর কখনও পাইনি আমার ভিতরে প্রবল বিদ্রোহ জেগে উঠল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমাকে এসব সনাতনী সংস্কারের দেয়াল ভাঙ্গতে হবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।