কবিতার প্রতিটা অক্ষর হয়ে উঠুক এক একটা পোয়াতি অনুভূতি
(কবিতা বিষয়ক একটি গদ্য)
কিছুক্ষণের স্তব্ধতা সবুজাভ মুহূর্তকে ক্রমশ ম্লান করে দিয়েছিল কি? আমি সেটা বুঝতে বুঝতেই কবিতা লেখা শিখতে চেষ্টা করতাম। আজও প্রতিনিয়ত চাই যে, কবিতার প্রতিটা অক্ষর হয়ে উঠুক এক একটা পোয়াতি অনুভূতি। কিন্তু, সত্যিই কী আমরা কিছু লিখছি! সত্যিই কী রাতের অন্ধকার আর এক বৈমাত্রেয় জীবাশ্ম হয়ে পাতার পর্ণমোচনকে বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠতর করতে আজও প্রয়াসী হয়? নিছক দুপুরবেলার দাঁড়িপাল্লা হয়ে আমার অনুভূতিগুলোকে দিনের পর দিন মেপে যেত যে মেয়েটি, সে আজ পরম সুখে অন্যের ঘরণী; কিন্তু তার বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আমি যেদিন ঘটা করে গিয়ে কবজি ডুবিয়ে সমস্ত পদ সাবরে ফিরে আসছিলাম, ঠিক তখন তার দু’চোখ জোড়া বিস্ময় দেখে আমার মনে হয়েছিল, এর থেকে গভীর কবিতা আমি আগে কখনো লিখিনি। অবতল দর্পণের সমস্ত পাতা ছাড়াতে ছাড়াতে একদিন মহাশূন্যের দীর্ঘশ্বাস যাবতীয় পাসপোর্টের ইনবক্সে ভরিয়ে তোলে নীল আঁতুড়ঘর।
সেই দুপুরবেলাগুলোর উনুনের ধোঁয়া, রান্নাঘরের পূর্ণিমা আর অমাবস্যার স্বপ্নপটিয়সী ক্রিয়াপদে মাছরাঙা ছুটকাছাটকা নিষিদ্ধ বই হয়ে লোমকূপে আগুন জ্বালাতো। জোনাকিরা জাতিস্মর হয়ে তাই আমার কাছে আজও বারেবারে ফিরে আসে। কিন্তু ফ্লুরোসেন্ট কোলাজে সেই ‘গভীর কবিতা’ তার বিয়ের মাস ছয়েকের মধ্যেই যেদিন আরো গভীরতার বিছানায় হাতছানি দিয়ে আমাকে ডেকেছিল, সেদিন কবিতা লিখতে সত্যিই যেন হাতটা কেঁপে উঠেছিল। নিশ্বাস যত ঘন হয়েছিল ততই বিশ্বাসের সেই স্ফটিকাকার পেপারওয়েট থেকে খসে যেতে থাকল ছিন্নপত্রাবলী! সেগুলো আর কখনো খোঁজা হয়নি! যেমন খোঁজা হয়নি অন্যকোনো পাকদণ্ডী পথে অতি চেনা বিকেলের পড়ন্ত রোদে ভিজতে থাকা এক সময়ের অত্যন্ত প্রিয় নেলপালিশের সতৃষ্ণ ইশারাগুলোকেও। কিন্তু যে কোনো ইশারার সর্বনামে যদি একতারার সুর বেঁধে দেওয়া যেত তাহলে তারাও হয়ত কখনো কবিতা পদবাচ্য হয়ে চিত্রনাট্যে ইনসুইং করতো।
নিছক শব্দজব্দের আকারে কবিতা আমার কাছে কখনো ধরা দ্যায়নি। কিন্তু শব্দের মাধ্যমে অনুভূতির ক্লোরোফর্মে পারফিউমের এক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক যখন ক্রোমোজমের জ্যামিতিবাক্স থেকে শুক্রানুর মতো দ্রুততায় সমস্ত ট্র্যাফিকজ্যাম অগ্রাহ্য করে নিষিক্ত করতে ছুটে চলে তখন ডিম্বানুর সেই লাস্যময়ী হাসিটাতে আমি কবিতা দেখেছি। ধরাও পড়ে গিয়েছি। ধরেও ফেলেছি। এই ধরা পড়া আর ধরা দেওয়ার মধ্যে ক্ষণিকের যে ছলনা থাকে, সেই বাস্তবতার শ্রাবণেই আমার কবিতা জন্ম। বৃষ্টির অনুষঙ্গে এক প্রাগৈতিহাসিক জ্যোৎস্না আকাশ ফুটো করে তুলে আনে রূপালি মাছ। রামধনুর সুইসাইডকে দেগে দিই মার্কারে। তবুও চোখ আটকে থাকে সদ্যোজাত পঙক্তির নবযৌবনের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শে। কার বাপের সাধ্যি আছে যে, কুঞ্জবনের সেই অনাস্বাদিতপূর্ব সুর মুর্ছনার ফিউজ তার কাটতে পারে! কিছুটা হলেও আমরা সবাই মেঘজ্বরে জরাকীর্ণ অতএব দ্রৌপদী রোদের স্বেচ্ছাচারিতা মনে মনে প্রত্যাশা করাটা অবশ্যই কোনো অন্যায়ের নয়, বরং একান্তই স্বাভাবিক। এতে দোষেরও কিছু নেই। যে চিত্রনাট্যে মাটির গন্ধ নেই, সেই চিত্রনাট্য ক্ষেত্র বিশেষে মেকী।
প্রতিটা ত্রিভুজেরই লম্ব বরাবর একটা আকাঙখা থাকে, যে কোনো প্রেমিক পুরুষই সেটা জানে। সমস্ত জিজ্ঞাসাচিহ্ন যদি প্রেমিকা হয়ে ওঠে তাহলে প্রেমিকের একটা মস্ত বিস্ময়সূচক চিহ্ন হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। সেইজন্যে সমস্ত ফুলের মধ্যে আমার আজীবনের প্রিয় ফুল হ’ল গোলাপ। কাঁটা থাকলেও সেই কাঁটা উৎখাত করে গোলাপের অনুষঙ্গে আমি কবিতাকে যতটা দেখতে পাই তেমন অন্য কোনো ফুলে দেখি না। তবে গোলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে আসলে যে আগুন থাকে সেই আগুনে পোড়ার চান্স থাকে অনেক বেশি, তাই মেগাপিক্সেল খিদে শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজিয়ে নেওয়াটাও জরুরি। হতে পারে এটা শুধুমাত্র সাবধানতার জন্যেই বলা, এমন কী, এই সাবধানতা মেনে চললে গোলাপের সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত হবারও যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকতে পারে। কারণ, কবিতা অত্যন্তই অভিমানিনী, তার প্রতিনিয়ত দরকার সাহসী চুম্বন। সুতরাং অযথা পোড়ার ভয়ে পিছিয়ে আসা ভিত্তিহীন। অতএব, ডাকবাক্স এখন ধীরে ধীরে ইনবক্স হয়ে চেতনার বারান্দায় ক্রমশ স্মার্ট সানগ্লাস, প্যাভিলিয়ন সম্পূর্ণ গাছের মতো সশরীরী শিরশিরানি, পাতার মতো ভরাট যুবতি পথে নীল জ্যোৎস্না, আলসেমিতে বহুগামি কার্টুনিস্ট ঠোঁট, চেতনায় তোমার ভ্রুপল্লবের টোরাকোটা, নিশ্বাসের শামিয়ানায় বিচক্ষণ জলের পরকীয়া আর কৌশলী আঙুলের রিসার্চ, হার্লেকুইন টুপির নিচে পাতলা হয়ে আসা ভবিষ্যতের প্রথম সন্ন্যাস। আসলে শ্বেতপাথরের ফলকে অচেতন আত্মসুখ যখন একাধিক প্রেমিকার মতো পরস্পর মুখোমুখি হয়ে সূর্যাস্তকে চেটেপুটে খেয়ে নেয় তখনই তার শঙ্খ লাগা শব্দের ব্লুপ্রিন্ট অনুভূতিশীল জঠরের হেডলাইটে জন্ম দেয় আসল কবিতার…