বাবার প্রৌঢ় বয়সের ঝর্ণাকলম আমাকে দিয়েছিলেন। উপহার দিয়েছিলেন গান্ধীজীর লাঠি, নেতাজীর টুপী, আম্বেদকরের চশমা, বিদ্যাসাগরের তালপাতার চটির ছবি। ঝর্ণাকলম আজ অচল। উপহারের ছবিগুলির স্থানে এখন আমার মানপত্র ঝোলানো সারি দিয়ে। ছবিগুলো পুরনো জিনিসের সাথে কোনখানে গাদা করে রেখেছি একদিন। বোধহয় সেদিন থেকেই প্রতিবাদ করতে ভুলেছি। চারপাশ ঘিরে আছে দোষ, অন্যায় – আমি অদৃশ্য যাদুবলে পিছলে যাই, বাগিয়ে আনি মানপত্র, স্মারক। যেগুলির দিকে তাকিয়ে ছাতি চওড়া, হাসি লম্বা। একদিন সন্তানকে বলেছিলাম, ‘দ্যাখ, এমনি করে আঁকতে হয় গান্ধীর লাঠি, গান্ধীর চশমা’। দেখি লাঠি আর সোজা হয় না, কেমন বেঁকে বেঁকে যায়। অবোধ সন্তান হেসে কুটোপাটি, বোকামতোন আমি রেগে গিয়ে আরেকটি আস্ত লাঠি ভাঙ্গি। অনেকদিন মায়ের বলিরেখাগুলির দিকে তাকাতে পারিনি ব্যস্ততায়। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি রেখাগুলি অনেক গভীর হয়েছে – মা এখনো হাসলে সততার চ্ছটা চুঁইয়ে পড়ে রেখাগুলি থেকে। তখন কি সুন্দর মা! আমি মায়ের ছবিও আঁকতে পারি না, কেমন যেন নিষ্ঠুর মুখ আঁকা হয়ে যায়। আমি কি খুব খারাপ হয়ে গেছি? অথচ আমি কবিতা লিখি। যারা কবিতা লেখে তারা কি খারাপ হয়? বড় বড় কবিরা বলেছেন – যা সত্য, তাই সুন্দর, তাই কবিতা। কবির সত্যতা গান্ধী থেকে মুখ ফিরিয়ে কেন? লিখতে বসলেই এ প্রশ্ন মাথায় ঘোরে। উত্তর দিতে কেউ এগিয়ে আসে না, যারা উত্তর দিতে পারে, তারাও না। তাহলে কি তারা নকল করে অক্ষর সাজায়! যেমন অনেকেই নকল করে করে পরীক্ষায় পাশ করে! মার্কশীটে লেখা থাকে ‘পাশ’। কিশোরবেলায় তোমার সাথে দার্জিলিং গিয়েছিলাম প্রথমবার। ঠান্ডা ঠান্ডা ভোরে টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখেছিলাম। ফেরার পথে রাস্তায় চা খেয়েছিলাম চা বিক্রী করছিলো কতগুলি সুন্দরী কিশোরী। হেসে হেসে চা পরিবেশন – তাদের মুখেও ভোর ভোর সততা। তারা তখন যাদবপুরের ছাত্রী। বাড়ী এলে ট্যুরিস্টদের চা বিক্রী করে। তারা কোথায় কে জানে! তারা কি জানে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার কথা? তারা কি জানে ডাক্তারদের হরতালের কথা? তারা কি জানে রোজ দেশান্তরি হবার ভয়ে মানুষের সিঁটিয়ে থাকার কথা? তাদের সন্তানদের কলকাতার কথা বলে কি! সেই কলকাতা — যেখানে কলমচি, শিল্পীরা অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নামে! না বলাই শ্রেয়। সাধ করে সন্তানেরা দেখতে এলে হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের কুল কুল ঘরে কবিদের উন্মাদ হওয়া দেখবে, সবাই হাতড়ে খুঁজে চলেছে আম্বেদকরের চশমা – পার্সের মধ্যে সকলের একটি করে আবেদনপত্র – ‘আমাকে সম্বর্ধিত করুন, সাহিত্য সংস্থার উচ্চপদে আসীন করুন – দয়া করুন’। আমিও এদের কাছেই শিখেছি, কিভাবে চার করতে হয়, কিভাবে টোপ ফেলতে হয়, কিভাবে ছিপে গাঁথতে হয়। বাবা, তুনি কেন বঁড়শির ছবি আমাকে দাওনি! কত কত পরে বঁড়শির রূপ জেনেছি তাদের কাছে। তাদের সেলাম, তাদের দাসানুদাস আমি। ফেসবুকে বিষ্ঠা ত্যাগ করলেও গদগদ হয়ে ‘লাইক’ দি – যে বুড়ো আঙুলের ব্যবহারটাই তুমি কোনদিন জানতে না।