• Uncategorized
  • 0

গদ্যে কৃষ্ণা মালিক 

কপালের তিনটি ভাঁজ আর আমরা 

 তাই কপালে উপর-নীচে পাশাপাশি তিনটে ভাঁজ নিত্য সঙ্গী। একেবারে অভেদ্য। সর্বদাই – যাকে বলে জ্বাজ্জল্যমান। এর কম বেশি নেই। নিত্যই প্রকট। শিবের তৃতীয় নেত্রের মতো অবশ্যম্ভাবী। অবশ্য শিবের মতো বিশ্বসংসারের ত্রাণ ও রক্ষণ নিয়ে ভাবতে হয় না। তবু জীবনে কোনো বলেরই ব্যাটের সঙ্গে  ব্যাজস্তুতির ঠোকাঠুকি কিংবা প্রেম হলো না।কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইটাতো করতেই হয়! সে-ও দেঁতো হাসি হাসতে হাসতে। সুতরাং কপাল কুঁচকেই থাকে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল তিনটি ভাঁজ। কম বেশি সব মনিষ্যিরই ওই ভাঁজ। শুধু প্রকট আর প্রচ্ছন্নের তারতম্য।
        হেঁজিপেঁজি জীবনে আমাদের গন্ডী বড়ই ছোট। সীতা বৌঠানের উদ্দেশ্যে লক্ষণের টানা গন্ডীর মতোই সংক্ষিপ্ত,  তবে জোরালো। বাইরে যাবার উপায়ই নেই। গেলে যে, কোনো দশমাথার রাবন পুষ্পকরথে তুলে ফেলবে – তেমনটা নয়। তবে মহিমময় সমাজের কিছু দারোগা  মাথায় প্লাস্টিকের দশখানা ভয়াল মুন্ডু আটকে রেখেছে, আর সবার উপরে আছে তার একান্ত নিজস্ব বশংবদসম মস্তকটি। সেই দশ, একুনে এগারো মাথাবিশিষ্ট দারোগাসম অক্টোপাস ক্রমাগত শুঁড়ের অ্যান্টেনায় গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। তা করুক, আমাকে তে বাঁচতেই হয় আমার বাঁচন! যেমন সকালে সংসার-সন্তানাদি সামলানো, তারপর বিকেল পর্যন্ত অন্নসংগ্রহ শর্তে শ্রেণিকক্ষে বাইফোকাল পরিহিত হয়ে পাঠদান ও সরকার নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ছিনে জোঁকের দংশনজাত চুলকানি। কর্ম ফেরৎ বাজার সরকারের দায়ভার গ্রহণ ও তা কার্যকর করা। বাড়ীতে পদার্পণ থেকে শুরু করে রাত এগারোটা পর্যন্ত পুনরপি সন্তান পালন ও সংসারের সং।
        ঢ্যাঁটা কি আমিও কম? ইত্যাকার কাজকম্মের ফাঁকে ফাঁকে মনটাকে উড়িয়ে দিই আকাশ চড়তে। নে! কত বাঁধবি বাঁধ! আষ্টেপৃষ্টে যত বাঁধবি তত বাঁধন খুলবে। দেখছেটা কে? বাইরে প্যাটপেটিয়ে যতই তাকিয়ে থাকো যে পালাতে জানে সে ঠিক পালাবে।
         তবু! এই “তবু”তেই একশো আাটটা গিঁট। অষ্টপ্রহর বিঁধে চলেছে এই ” তবু”। সবাই মিলিয়ে দেখে নিন, সবার একই কথা। এই “তবু” ঘাড় ধাক্কা দিচ্ছে, এই “তবু” চোখ রাঙাচ্ছে, এই “তবু” বেঁধে রামঠ্যাঙানো ঠ্যাঙাচ্ছে, এই “তবু” প্রতি মুহূর্তে মুখ কালো করে দিচ্ছে অপমানে, এই “তবু” হাতের কলম কেড়ে নিয়ে বেনাবন দেখিয়ে দিচ্ছে, পায়ে বেড়ি পরিয়ে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারে। আমার আকাশ ভর্তি চাঁদ-তারা আমি বিনে অনাথ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশে আকাশে। কোন্ বেত্রবতী স্বচ্ছতোয়া বয়ে চলেছে কোথায়, তার কলধ্বনি পাঠাচ্ছে লাগাতার। জাহাজের ভোঁ, ট্রেনের হুইসেল, দূরপাল্লার বাসের সমুদ্রধ্বনি জলবাতাসার রেকাবি নিয়ে অপেক্ষমাণ। কোন্ মান্ধাতা আমলের ক্যাঁচকোঁচের গরুর গাড়ির গাড়োয়ান শেতলদাদাদের হেট-হেট তাড়া লাগায়। পাহাড় ডিঙিয়ে – সমুদ্র পেরিয়ে চাঁদতারার সঙ্গে ভ্রমণে যেতে ভিসা আর টিকিটের বাক্স বিলীয়মান হতে হতেও পানের তবকে মুড়ে রাখছে অবসরের জোয়ান-মৌরী।
        তবু সব “তবু”কে মেনে নেওয়া দীর্ঘশ্বাসের তরবারিতে কচুকাটা করে ফর্মালিনে ডুবে জ্যান্ত রয়েছি। জ্যান্ত রয়েছি বলেই কপালে তিনটে ভাঁজ আর আমি। আমি’র আমি। যার ছায়া পড়ে না। সে চষে ফ্যালে ব্রহ্মান্ড। আর যত আয়ুধ দশদিক থেকে বিশ্বজুড়ে ছুটে আসছে ক্রমাগত, আর সেই আমি-র গায়ে হৃৎপিন্ডে মগজে গেঁথে যাচ্ছে। আসলে একটা ভুল জন্ম। নিজেকে টেনে টেনে মুখ ভেটকে দাঁত ছরকুটে প্যাভিলিয়নের দিকে “সব ঠিক হ্যায়” বলতে বলতে এগিয়ে যাওয়া। প্রতিদিনের জীবনে চাল- ডাল-তেল-পেঁয়াজের দামের গোড়ায় হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে তোলা হচ্ছে। কারও ঘরকরুনি মেপে মেপে জল সেদ্ধ করে ম্যানেজ দিচ্ছে। কারও আবার হাঁড়িই নেই। তাই স্যাটায়ারে স্যাটায়ারে জমে যাচ্ছে জীবন।
      অথচ তোমার শোবার ঘরেও উঁকি দিচ্ছে এই রাষ্ট্র। তোমার মাটি আর মায়ের পরিচয় পত্র সম্পর্কিত নির্দেশসমূহের কাগজ পাকিয়ে পাকিয়ে কানখোরকে বানিয়ে ছাড়ছে। তোমার জন্মটাতেই কপাল কুঁচকে পেনের খোঁচায় ঘা করবার জন্য শান দিচ্ছে চৌকিদাররা। আর নারীকে চোদ্দপুরুষ বংশলতিকার রসটুবো লবঙ্গলতিকা বানিয়ে গিলে খাবে বলে বসে আছে বিরাটাকৃতির হাঁ-মুখ।
       অথচ তোমার শিক্ষা নেই, তোমার কাজ নেই, তোমার খাদ্য নেই, পানীয় জল নেই, বিশুদ্ধ অক্সিজেন নেই, তুমি খাবি খাবি খাচ্ছ – কারণ তোমার চারপাশে – নেই নেই নেই। যদি তুমি নারী হও,  তোমার নারী শরীরের রক্ষণ নেই – । তোমার মনেরও বলাৎকার ঘটায় লিঙ্গসর্বস্ব না-মানুষ।
       অবিশ্বাস্য এই মানুষ বাঁচন। এত হালুমহুলুম সামলেও বেঁচে আছি ক্যায়সে? প্রশ্নের উত্তর যেন “ঠোঙাভরা বাদামভাজা খাচ্ছি, কিন্তু গিলছি না”! বদহজমে চোঁয়া ঢেকুরে “ছায়ার আমি”র নড়নচড়ন। সর্বদাই ইতস্তত, সর্বদাই হতবাক। বাকে লাগাম লাগানো। দেওয়ালে ভয়াল ছায়া দেখে আতঙ্ক আর আতঙ্কে স্কিজোফ্রেনিক এই আমি। আমার কপালে তিনটে ভাঁজ। আছে, যাবৎ জীবন – থাকবে। মঝঝিম অবস্থান থেকেই তলাতল পাতালমুখী বা ঊর্ধ্বগামী হবো একদিন ওই তিন ভাঁজের সঙ্গে আমি, এবং আমি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।