প্রবন্ধ্ – আলোক মণ্ডল

বিদ্যাসাগর২০০/বিশেষ সংখ্যা
বিদ্যাসাগরঃ নাস্তুিকতা ও ধর্ম প্রসঙ্গে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বি-শতবার্ষিকীতেই তাঁর মূর্তি ভাঙা হোল,পুনরায় সারা দেশে ধর্মীয় উন্মাদনার যুগে বিদ্যাসাগরকে হেয় করার কু-চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু কেন? তিনি মানবতাবাদী সমাজ সংস্কারক ছিলেন বলেই , না কি মানুষকে ধর্মীয় অন্ধত্বের মধ্যে ডুবিয়ে না রেখে যুক্তিবাদী করতে চেয়েছিলেন বলে?
“বিদ্যাসাগর” তাঁর প্রাপ্ত উপাধি, আসল নামটি ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু তিনি কি ঈশ্বরবিশ্বাসী? না নাস্তিক? নাস্তিক তিনিই যিনি বেদকে ভ্রান্ত মনে করেন , যেমন বৌদ্ধপন্থীরা চতুর্বেদে অবিশ্বাসী, তারা নাস্তিক । তাহলে এই ঈশ্বরচন্দ্র কি নিরীশ্বরবাদী? অন্তত তাঁর জীবন যাপনে ও নিত্যকর্ম সম্পাদনে ঈশ্বর বিশ্বাসের কখনোই কোন প্রকাশ পায় নি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত পত্রে,” শ্রী শ্রী হরি শরণম্” উল্লেখটুকুই যা। বরং তাঁর চরিত্রের নির্যাস নিয়ে বনফুল যে ঈশ্বরচন্দ্র চরিত্রটি তাঁর,”বিদ্যাসাগর” নাটকে সৃষ্টি করেছেন সেখানে দেখি তিনি এই কুৎসিত লোকাচারে ভরা সমাজ ও পৃথিবী সম্পর্কে তীব্র বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলছেন যে তিনি যদি একবার এই পৃথিবীর বাইরে পা রাখতে পারেন তাহলে একলাথ মেরে পৃথিবীটাকে উল্টে ফেলে দেন!এই ছিল তাঁর বিতৃষ্ণা ও ক্ষোভ ধর্ম লোকাচার ও তৎকালীন বৌদ্ধিক সমাজ সম্পর্কে। তাই তিনিই বলতে পারেন,”চোখের সামনে মানুষ অনাহারে মরবে, ব্যাধি,জরা, মহামারিতে উজাড় হয়ে যাবে আর দেশের মানুষ ‘ভগবান’, ‘ভগবান’ করবে- এমন ভগবৎ প্রেম আমার নেই।”
বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও,
“তাঁহার নিত্য জীবনের আচার-ব্যবহারে,ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন আচরণ হিন্দুর অনুরূপ ছিল না অন্যদিকে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মের লক্ষণেরও পরিচয় কখনও পাওয়া যায় নাই।” লিখছেন,চণ্ডীচরণ বন্দোপাধ্যায় ১৮৯৫ সালে লেখা “বিদ্যাসাগর” গ্রন্থে। আসলে বিদ্যাসাগর ছিলেন ঘোর যুক্তিবাদী এবং মানবতাবাদী।পুজোআর্চায় তাঁর মন কখনই ব্রতী ছিল না বরং তিনি আর্তের সেবা,অসহায় নারীর দুঃখ দূরীকরণ, নারী শিক্ষা, মানুষকে যুক্তিবাদী সংস্কারমুক্ত ভাবে গড়ে তোলাতেই একনিষ্ঠ ছিলেন আজীবন।
ধর্ম সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্রের কোন স্পৃহা ছিল না কোনদিন তাই স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর কাছে এসে তাঁকে ঈশ্বর সম্পর্কে কোন রূপ আগ্রহী করতে না পেরে তাঁর শাণিত যুক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে ও তাঁর ধর্ম ও লোকাচারে ঔদাসিন্য দেখে তাঁর গুনগান গেয়ে বলেছিলেন,” এই সাগরের কাছে না এলে আসল সাগর দেখা হোত নি! “
বিদ্যাসাগর ভারতীয় বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শনকে ভ্রান্ত বলেছিলেন, সে হিসাবে তিনি অবশ্যই নাস্তিক। বলেছেন, হিন্দু দর্শনে ঈশ্বর সম্পর্কে যা বলা আছে তাতে কিছুই বোঝা যায় না তাছাড়া যে ঈশ্বর ” অবাঙমানসগোচর” তাঁকে খোঁজারই বা কি দরকার! শম্ভুচন্দ্রের লেখা থেকে জানতে পাই, বিদ্যাসাগর তাঁর কাছে আসা কিছু বিদ্বৎজনকে একাধিক বার বলেছিলেন,” ধর্ম যে কি তাহা মানুষের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোন প্রয়োজন নাই” বরং সবার উচিত সারাজীবন আর্তের সেবা ও সমাজকে লোকাচার মুক্ত করা।বিদ্যাসাগরের পৈতা বা উপনয়ন হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তিনি কখনও গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতেন না কিংবা সান্ধ্য আহ্নিকও করতেন না,এ নিয়ে আপশোস করেছেন তাঁর বাল্যবন্ধু। ঘরের কোণে ঈশ্বরের আরাধনা না করে প্রবল যুক্তি ও হাস্যব্যঙ্গের মধ্য দিয়ে সমাজের কু-প্রথা দূর করতেই ব্যস্ত থাকতেন।যেমন,”কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য” ছদ্মনামে তারানাথ তর্ক বাচস্পতির সঙ্গে তর্কে অবতীর্ণ হয়েছেন (১৮২০) সালে হিন্দু কুলীনের বহুবিবাহ রোধ করার জন্য দু’টি বই লিখলেন, রঙ্গ রসিকতা সহকারে,” অতি অল্প হইল”, “আবার অতি অল্প হইল” । বই লিখলেন জনমনে বিজ্ঞান ও যুক্তি-পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞানোদয়ের জন্য, “বোধোদয়”, এখানেও তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে উদাসীন থাকলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র নীতিনিষ্ঠ এবং করুণার সাগর ছিলেন,সে কাহিনি নিঃস্ব রিক্ত মধুসূদনকে বিলেত থেকে ফিরিয়ে আনার পর মধুকবির বিখ্যাত কবিতার মাধ্যমে সবাই তা জানি। তিনি হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ও দর্শন অধ্যয়ন করেছিলেন মানুষকে ও সমাজকে সংস্কার মুক্ত ও জীর্ণ লোকাচার মুক্ত করার জন্যই।ধর্ম শাস্ত্র থেকেই ধর্মীয় কুশাসন থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে ছিলেন তাই বিধবাবিবাহ প্রচলন করার জন্য বিধবা দের পুনর্বিবাহ যে শাস্ত্র সম্মত তা প্রমাণ করার জন্য “পরাশর সংহিতা” থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন,”নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চা পতিতে পতৌ / পঞ্চ স্বাপৎসু নারীনাং পতিবরণ্যে “। তাঁর তীব্র যুক্তিজালে তৎকালীন বিদ্বৎসমাজ পরাস্ত হয় এবং সরকার বাধ্য হন “বিধবাবিবাহ” আইন প্রচলন করতে,১৮৬২ সালে। কথায় ও কাজে এক নিষ্ঠা প্রমাণ করার জন্যই তিনি নিজের সন্তানেকে এক বিধবার সঙ্গে বিবাহ দেন এতে তাঁকে অপমানিতও লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল এমনকি গ্রামছাড়াও হতে হয়েছিল। তৎকালে হিন্দুসমাজের সব মাতব্বররাই তার বিরোধীতা করেছিলেন তবু তিনি দমেন নি বরং বিধবাদের পুনঃবিবাহের পক্ষে শাণিত যুক্তি ও হিন্দু পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের বিরুদ্ধ যুক্তিগুলি সাধারণের বোধগম্য করে খণ্ডন করে ছিলেন “ব্রজবিলাস” ও “রত্নপরীক্ষা” গ্রন্থে। বিশেষত “ব্রজবিলাস” গ্রন্থটি পড়লে আমরা দেখতে পাই বিদ্যাসাগর কী ভাবে স্বর্গ ও নরক বিষয়টিকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে হাস্যকর করে তুলেছেন ঐ দুটি দীর্ঘ লালিত বিশ্বাস। ২১ জানুয়ারী ১৮৫১ তে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন হয়েই নির্দেশ দেন সংস্কৃত কলেজে শুধু মাত্র ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ছাত্ররাই পড়বে না, পড়তে পারেন যে-কোন সম্প্রদায়ের মানুষ।
ঈশ্বরচন্দ্র বস্তুতপক্ষে তথাকথিত নিরীশ্বরবাদী হয়তো ছিলেন না তবে ঈশ্বর সম্পর্কে ঘোরতর সংশয়বাদী ছিলেন এবং ঈশ্বর সম্পর্কে আলোচনা পণ্ডশ্রম বলেই মনে করতেন তাই ঈশ্বরে তাঁর ভক্তি বা আনুগত্যের কোন পরিচয় তাঁর জীবন ও কর্মপদ্ধতির মধ্যে খুঁজে পাওয়াও যায় না,তিনি ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী,আত্মমর্যাদা সম্পন্ন,নীতিনিষ্ঠ এবং আত্মঅভিমানী ব্যক্তিত্ব। তিনি এমনই এক ব্য্যক্তিত্ব যাঁর প্রতিকৃতি তাঁর জীবনদশাতেই বিক্রি হোত, সর্বতোমুখী বিরোধীতা সত্ত্বেও তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। তাঁর জীবিত অবস্থাতেই তাঁর ঈশ্বর বিশ্বাস নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে বারবার এ সম্পর্কে সে যুগের পণ্ডিতেরা তাঁকে কখনও খৃষ্টান বলে নিন্দা করেছেন, কখনওবা ব্রাহ্ম বলে। বিহারীলাল সরকার সরাসরি অভিযোগ করেছেন,” অধ্যাপকের বংশে জন্ম লইয়াও, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়াও হৃদয়ে অসাধারণ দয়া ও পরদুঃখকাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া হিন্দু শাস্ত্রের প্রতি, হিন্দু ধর্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন? ” এই কেন-র উত্তর বিদ্যাসাগরের ধর্মে বি-ভক্তি,কর্মে আসক্তি। তাঁর কাছে মানুষ ও সংস্কারমুক্ত সমাজ গড়াই মূল লক্ষ্য ও আরাধ্য ছিল।
সারাজীবনে তিনি সম্পাদনা সহ মোট ৪৫ টি গ্রন্থ লিখেছেন কোথাও তাঁর ঈশ্বর বিশ্বাসের কথা পাওয়া যায় না।নারী শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন,দাতব্য চিকিৎসালয়,বাংলা গদ্য প্রসারে গ্রন্থ রচনা,মানুষের মনে নৈতিকতা জাগরণে পুস্তিকা রচনা,বহু বিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠা, বিধবাবিবাহ চালু করা,বিপন্ন মানুষকে ও সদ্য বিধববাদের আর্থিক সাহায্য দান,সমাজ জীবনে নবজাগরণের ঢেউ এনেছেন বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। তাঁকে গালাগাল দিয়েছে সমাজপতিরা,তাঁর বিরুদ্ধে তৎকালে প্রকাশিত সাময়িক পত্রে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে, তীক্ষ বিদ্রুপ বর্ষিত হয়েছে, পচাডিম ছুড়েছে গায়ে,আত্মীয়- বন্ধুরা তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেছে,আর্থিক দিক দিয়ে তিনি কপর্দকশূন্য হয়েছেন তবু কোন অলৌকিক শক্তি বা দেবতার শরণাপন্ন হননি বরং কোলকাতা ছেড়ে, ঘরবাড়ি ত্যাগ করে, নিজের প্রতিষ্ঠিত কলেজ-বিদ্যালয়ের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন ভিনরাজ্যের কারমাটাঁড়ে, সাঁওতাল পল্লিতে। সেখানকার অতি সাধারণ অশিক্ষিত মানুষই তাঁর শেষ আশ্রয়,এই মানসিক বিপর্যয়েও তিনি ঈশ্বর নয় মানুষকেই আঁকড়ে ধরেছেন। তাদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন ও মায়ের নামে হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে তুলেছেন তবু ঈশ্বর বা ধর্মীয় অনুশাসনের কাছে মাথানত করেন নি। এমন কি শেষ জীবনে ঘোড়ার গাড়ি থেকে পড়ে গুরুতর আহত হয়ে পেটে আঘাতজনিত কারণে সম্ভবত ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যু পথযাত্রী হলেও ঈশ্বরের শরণাপন্ন হন নি।
আজ যখন জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে রাজনীতি মুখর যখন সমাজ অযৌক্তিক লোকাচার ও বিশ্বাসে মগ্ন তখন দ্বি-শতবর্ষে বিদ্যাসাগরের ফটোতে ফুলমালা না চাপিয়ে বরং তাঁর মানবতা ও যুক্তিনিষ্ঠা ও সমাজসেবার দিকটি আলোকিত করা খুবই জরুরী।