• Uncategorized
  • 0

কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক স্মরণে: স্নেহাশীষ চক্রবর্তী

কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক

“হয়ত আমার এ পথে আর হবে না ক আসা
দুধারে যাই রোপণ করে বুকের ভালোবাসা ।
ধুলার এ পথ যাই ভিজায়ে
শ্যামল আসন যাই বিছায়ে
অমল করে যাই রেখে যাই ক্ষনিক কাঁদা হাসা ।
সরায়ে দিই পথের কাঁটা – ছড়ায়ে যাই ফুল,
নিকায়ে যাই স্নেহের বেদি ছায়াতরুর মূল ।
মমতা মোর পথের কীঁটও
পায় যেন হায় পায় যেন গো
বনবিহগের কণ্ঠে হউক অমর আমার ভাষা ।
ভক্তি-বিহীন সম্বল হীন দুঃখী অকপট,
শক্তি নাহি গড়তে দেউল, স্বান্তনারি মঠ ।
দরদী এই দিনের হিয়া
নিঝরে যাক প্রণয় দিয়া
হয়ত কোনো তৃষিতেরি মিটতে পারে তৃষা ।
জানিনে এ মানব জনম আবার পাবো কি না,
নিরুদ্দেশের যাত্রী রাখি প্রণয়রাখির চিনা ।
অনুভূতির ছিন্ন সূত্র
যাই রেখে যাই যত্রতত্র,
পারবে না যা করতে পরশ কালের কর্মনাশা ।”
শ্রীপূর্ণচন্দ্র মল্লিক ও শ্রীমতী সুরেশকুমারী দেবীর জ্যেষ্ঠ সন্তান ‘পদ্মশ্রী’ কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৩ সালের ১ লা মার্চ তার মাতুলালয় কোগ্রামে । তার পৈত্রিক নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার বৈষ্ণবতীর্থ শ্রীখণ্ড গ্রামে । এন্ট্রান্স ( ১৯০১, বর্ধমানের ডি এন দাস সেঞ্চুরি স্কুল ), এফ এ ( ১৯০৩, রিপন কলেজ ), বি এ( ১৯০৫, বঙ্গবাসী কলেজ ) শেষ করেন পড়াশুনা ।
মল্লিক পদবী তাদের বাংলার নবাবের কাছ থেকে প্রাপ্ত পদবী, কুমুদরঞ্জন মল্লিকদের আসল পদবী ছিল সেনশর্মা বা সেনগুপ্ত । ঊনবিংশ শতকের একদম শেষ বছর ( ১৮৯৯ /১৯০০ ) মাত্র ১৭ বছর বয়সে কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বিবাহ হয় তার পৈত্রিক গ্রাম নিবাসী শ্রীযুক্ত যুগলকিশোররায়ের দ্বিতীয়া কন্যা সিন্ধুবালা দেবীর সাথে ।
বি এ পাশ করার পরে পরেই কাশিমবাজারের শ্রীমনীন্দ্রচন্দ্র মহারাজের অনুরোধে তিনি মাথরুন নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশানে অস্থায়ী দ্বিতীয় শিক্ষকের পদে ১৯০৬ সালে যোগদান করেন । এক বছরের মধ্যেই কবি কুমুদরঞ্জন তার প্রতিভাবলেই ঐ স্কুলের হেড মাস্টার পদে উন্নীত হন । একটানা প্রায় ৩০ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব সামলে তিনি ১৯৩৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন ।
মাতুলালয়ে বসবাস ও স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি অজয় নদ ও সংলগ্ন কুনুর নদী তার জীবনের একটা বিরাট অংশ জুড়ে অবস্থান করেছে । একদিকে স্বীয় প্রতিভার বিকাশ অন্যদিকে কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কবিত্ব প্রতিভার স্ফুরণের সময়কাল কিন্তু এই কোগ্রাম বা অজয় নদ ও কুনুর নদী ।
কুমুদ-কাব্য
কুমুদ রঞ্জন-রশ্মি পশিছে হৃদয়ে
‘শতদল’ পদ্মে বিষ্ণু শয্যায় ঘুমায়ে
যেরূপ পবিত্র স্থানে তব বাস ছিল
বাংলাকে আলো দিতে উদয় হইল
‘উজানী’নগরে তব নিজের প্রকাশ
‘একতারা’য় বেজেছিল তোমার নিঃশ্বাস
বিষ্ণুর মস্তকে স্থান তুলসীর পাতা
‘বনতুলসী’তে তুমি আরাধনা ত্রাতা
কৌতুক ছড়ার মতো পল্লী গন্ধ মাখা
‘বীথি’ ‘চুন কালি’ আর ‘বনমল্লিকা’
‘দ্বারাবতী’ নামে তব লেখা কাব্য কথা
দ্বারকায় বাস কৃষ্ণ জগতের ত্রাতা
‘রজনীগন্ধা’র গন্ধে বঙ্গ আমোদিত
‘নূপুর’ বাজিয়েছিলে কাজের সহিত
‘অজয়’ নদের তীরে ‘তুণীর’ তোমার
বিজয়ী অর্জুনসম চিরসখা তার
‘স্বর্ণসন্ধ্যা’ জীবনের অস্তগামী ছবি
ছড়ায়ে পড়েছে তব অবয়ব কবি
তোমার সৃষ্টিতে তুমি থাকো চিরকাল
পশিমবঙ্গের তুমি কবিত্বে মশাল
তোমাকে প্রণমি আমি আজিকার স্রোতে
আশীর্বাদ কোরো যেন ভালোবাসা সাথে ।।
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বঙ্কিমচন্দ্র স্বর্ণপদক’ ( ১৯০৫ ) ও ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ পান, পরবর্তীতে ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবেও তাকে ভূষিত করা হয় ।
উল্লেখ্য, কবি যখন মাথরুন নবীনচন্দ্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তখন তারই ছাত্র ছিলেন পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ।
“নয়নে পড়েছে মৃত্যু কালিমা
দেরী নাই বেশি আর,
মোর পানে প্রিয়া তুলিল বারেক
করুণ নয়ন তার ।
বিদ্যুত-হানা বিশাল নয়ন
কালো টানা সেই ভুরু,
নামিয়া পড়েছে চির-নিদ্রায়
তন্দ্রা হয়েছে শুরু ।
অঞ্চলে বাঁধা চাবি রিং তার
দিল মোর পদতলে,
শুভদৃষ্টির দুইজোড়া আঁখি
ভরিয়া উঠিল জলে ।
সে চাবি তাহার বড় আদরের
ক্যাস-বাক্সের চাবি
কোনো ক্রমে মোর চলিতনা শুধু
তাহার উপরে দাবী ।
এ চক পুরীর চাবি মোর প্রিয়া
যতনে রাখিত কাছে,
চাহিলে কখনো পাই নাই আমি
ভাবিতাম কি যে আছে ।
আজ দিয়ে গেল শেষ সন্দেশ
সকলের শেষ দান,
দানের ভঙ্গি দাতার মিনতি
ব্যাকুল করিছে প্রাণ ।”
রবীন্দ্র সমসাময়িক যুগে রবীন্দ্রঅনুসারী কাব্যচয়নে পারদর্শিতা  ও জীবনের নিস্বর্গ প্রেম, পল্লিপ্রিয়তা তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট । ১৯৭০ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয় ।
হে কবি লহ প্রণাম ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।