কবিতা-ল্যাবে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

জন্ম ১৯৬৭ সালের ২ জানুয়ারি হুগলী জেলার ধনিয়াখালি গ্রামে। লেখালিখির শুরু খুব ছোটবেলা থেকেই। ছাপার অক্ষরে স্কুল ম্যাগাজিনে চিরাচরিত নিয়ম ভেঙেই প্রথম প্রকাশিত হয় "কেয়া" নামের একটি প্রেমের কবিতা। সাহিত্য নিয়েই পড়াশোনা। পেশায় গৃহশিক্ষক হলেও সাহিত্যই চব্বিশ ঘণ্টার ধ্যানজ্ঞান। মাসিক কৃত্তিবাস, একুশ শতক, ভাষাবন্ধন, প্রমা, কথাসাহিত্য প্রভৃতি পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তুমি অনন্ত জলধি (কবিতা), বিমূর্ততার অনন্ত প্রবাহে (কবিতা সংক্রান্ত গদ্য)। সম্পাদিত পত্রিকা : ছায়াবৃত্ত এবং কাটুম কুটুম।

অন্ধকারের উষ্ণতা

সকালেরও একটা শুরুর শুরু থাকে। কতদিন এমনও হয়েছে মাঝরাত থেকে উঠে বসে আছি। সে আসছে। সারা দেহ মন জুড়ে সে কি আনন্দ! বারবার জানলা খুলে দেখি আর কতক্ষণ। দেখি গভীর অন্ধকার। মনে হয় এ অন্ধকার আমার কতো নিজের। অথচ আমাকে তো শেখানো হয়েছে, অন্ধকারের অন্য এক বর্ণপরিচয়। সেখানে তো প্রত্যেকটা অক্ষর জুড়ে গভীর অন্ধকার। আমাদের চোখ তো বোজা। কখনও তো অন্ধকারকে হাতে তুলে নিয়ে দেখিনি, সে কতটা আমাকে পথ ভুলিয়ে দিতে চায় মনে মনে।
আমি তো চিনেছি তাকে অন্য রূপে। ভালোবেসে অন্ধকারের শরীরে তাকিয়ে দেখেছি সেও যেন আমাকে চেনাতে চায়। দেখেছি তার গা থেকে খসে খসে পড়েছে কত কত গলি পথের অচেনা অজানা সংজ্ঞা। পথের ভুল তো এভাবেই হয়। কোনো দিন তো কেউ তার মেঠোপথে পা রাখে নি। আমি দেখেছি অন্ধকার নিজেও কতটা একা। তাই সে তার গা থেকে ঝেড়ে ফেলছে চোরাগলির গোলকধাঁধা।
কতক্ষণ তাকিয়ে আছি অন্ধকারের দিকে চেয়ে। আর তো সে আমায় অন্ধ করে না। এখন সে যেন আমার বন্ধু। আজ বুঝতে পারি, প্রথম যেদিন তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন আমার চোখে আলো ছিল। সেই চোখের আলোতেই দেখেছিলাম অন্ধকারের আলো। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, কেউ একজন আসছে। সে আসার খুব বেশি দেরি আর নেই। কিন্তু সে অন্য কেউ নয়। এতক্ষণ তো এটাই ভেবে এসেছি, অন্ধকার ভেঙে গিয়ে চোখের সামনে উদ্ভাসিত হবে আলোর নতুন বর্ণমালা। ছড়িয়ে পড়বে নতুন এক পরিবেশের গন্ধময় উদাত্ত রূপ।
আজ তো চোখের সামনে খুলে গেল অন্ধকারের এক নতুন দরজা। আলো বলে এতদিন যাকে চিনে এসেছি সে আসলে অন্ধকারের অন্য এক উষ্ণতা। অন্ধকার ভেঙে ভেঙে অন্ধকারের শরীর নিঃসৃত রেণুকণায় আলো হয়ে উঠল চারপাশ। সারাটা সময় কি উদগ্র ইচ্ছায় অন্ধকার নিজেকে উজ্জ্বল করে তুলতে চেয়েছে। সেই প্রচেষ্টায় আজ সে সম্পূর্ণ সফল।
জানলার ওপারে আমি দেখছি উজ্জ্বলতার সেই দারুণ প্রতিশ্রুতি। আস্তে আস্তে নিজেকে সে ক্রমশ স্পষ্ট করে তুলছে। আমিও যেন আমার মধ্যে অন্য এক আমিকে দেখতে পাই। অন্ধকারের রূপ আবিষ্কারে আমি মত্ত হয়ে উঠলাম কেন? আমার মধ্যে এখন কতটা আমি আছি? অন্ধকারকে আবিষ্কার করতে গিয়ে নিজেকে আমি হারিয়ে ফেলি নি তো?
একদিন অন্ধকারের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলাম মুক্তির আস্বাদ। সেদিন অন্ধকার আমার শ্বাসরোধ করে নি। আমি যেন অন্ধকারকে পড়তে পারছিলাম। তখনই তো অনুভব করেছিলাম আমার চোখ বদলে যাচ্ছে। যেদিকেই তাকাই চোখ আমাকে আমার কল্পনার ছবি দেখাচ্ছে। এতদিন যা ভেবেছিলাম তা যেন এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। সকাল ভেঙে ভেঙে একটু একটু করে দুপুরের শরীর গঠনে আমিও থেকেছি। কিন্তু আজ আমি যেখানে দুপুর সেখানে কোথায়। আমার সময়ের হাত ধরে আমি চলে এসেছি অনেকদূর। দুপুরের মধ্যে থেকে দুপুরের উষ্ণতা আমি এখন আর অনুভব করি না। এতদিনের চেনা আমি কোথায়? সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমার আমি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ———-
” সময়ের সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে সে
নিজেকে কখন পিছনে ফেলে এসেছিল
তা খেয়ালই করেনি “
সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ। চোখের সামনে আলো। আমি কি তাহলে এতক্ষণ অন্ধকারে ছিলাম? তা তো নয়। আমি তো অন্ধকারের সঙ্গে এতক্ষণ আলোর গল্প করছিলাম। তাহলে চোখের ওপর আলোকে আমার নতুন কিছু মনে হচ্ছে না কেন? আমি তো আলোতেই। অনেকটা সময় অপেক্ষার পর যখন দুপুরে এসে দাঁড়াতাম তখন মনের সে কি প্রশান্তি! আজ তো আমার আর কোনো অপেক্ষা নেই। আজ মনে হয় আমার চারপাশে চলছে আলোর খেলা। আমি যখন যেটা চাইছি আমার চোখের ওপর সেটাই খেলা করে যায়। আমি এখন সময়হীন এক চির-আলোর বাসিন্দা ——–
” যখন খেয়াল হল তখন
সময় তাকে একলা ফেলে চলে গেছে । “

( গদ্যে ব্যবহৃত কবিতাটি টেড হিউজের লেখা  )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।