এই সময়ে দেশ নিয়ে ভাবনায় ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
শিল্পীরা ঘুমিও না, এসো গান বাঁধি
পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুরের পিংলা আর নয়াগ্রামের পটশিল্পীদের চিত্রকল্প অনবদ্য। জানেন তো মাননীয়রা? ওড়িশার রঘুরাজপুর, বিহারের মধুবনী কিম্বা ছত্তিশগড়েও অমন প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র পট শিল্পীরা আছেন যারা পটচিত্র এঁকে পেট চালান। জানেন তো?
তারা পয়সা পেলেই কাজ করে দেয় জানেন নিশ্চয়ই ? মুখিয়ে থাকে দুটো নতুন কাজের জন্য। জানেন তো?
আজ জেলায় জেলায়, রাজ্যে রাজ্যে ব্যাঙের ছাতার মত এনজিও। জানেন আশাকরি ? তারা প্রচুর সরকারী অনুদান নিয়ে কাজ করে ও বেসরকারী তকমা নিয়ে কাজ করে থাকেন। জানেন না?
তারাই তো এইসব পটশিল্পীদের দিয়ে সমাজ সচেতনতামূলক রঙীন ছবি আঁকিয়ে দেশ থেকে বিশ্বের দরবারে প্রশংসা কুড়িয়ে আনে। শিল্পীরাও বর্তে যায়। আলোয় আসে,ভালোর মুখ দেখে।
নয়াগ্রামের দুই পটশিল্পীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বছর দশেক আগে। ওরা শুনিয়েছিল তেমন সব গান, আর স্ক্রোল করে ছবি দেখিয়েছিল গানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পটচিত্রের। ওরা আমার আপনার চেয়ে অনেক ক্রিয়েটিভ, আপনি যাই বলুন। ওদের গ্রামেও ধর্ষণ হয়। সেগুলোর কথা আমরা কেউ জানতেও পারিনা। মিডিয়ার কাভারেজ হয়না। ওদের বুক ফাতে তো মুখ ফোটে না। ওরা তবুও মুখ বুজে, দু’হাত খুলে এঁকে দেবেই আপনাকে, গান বাঁধবেই আপনি যদি বলেন, মাননীয়, মাননীয়া।
সমাজ সচেতনতা প্রজেক্টে ওদের ভূমিকা আছে বিশাল, জানেন তো? পাবলিক খায় কিন্তু।
আজ নয়ত পালস পোলিও গ্রামে গ্রামে একটা জোরদার সচেতনতায় পরিণত? গ্রামের ওরা মনে করে ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে রাখে। পোলিও খাওয়াতে ভোলেনা বাড়ির শিশুটিকে।
এই ধরুন যেমন সেলিব্রিটি স্বপন বসুর গলায় পালস পোলিওর গান? রঙ্গন চক্রবর্তীর লেখায় ফিতা কৃমির গান? মাদল বাজে দ্রিমি দ্রিমি আর হবেনা ফিতা কৃমি? মনে পড়ে? সেটাও খুব পজিটিভ একটা এওয়ারনেস প্রোগ্রাম। ঠিক বলিনি বলুন?
পালস পোলিও, পরিবার পরিকল্পনায়, ওরা ছড়া কেটে সুর বসায়। সেই গান গায় পটচিত্র দেখানোর ফাঁকে। একটা শিশুর পর আর নয় কিম্বা দুটির পর মোটেও নয়, মায়ের স্বাস্থ্যে নয়ত ভয়…. এমন সোজা ভাষাতেই লিখবে ওরা রেপ নিয়ে ওরা।
মিড ডে মিল অথবা নিরক্ষরতা দূরীকরণে প্রাথমিক ইশকুলের ভূমিকা নিয়েও ওরা গান লেখে জানেন? আর গ্রামেগঞ্জে রঙিন ছবির ভূমিকা আছে যাই বলুন। ইশকুলের মাথায় পেনসিলের দুপাশে দুটি ছাত্রছাত্রীর ছবি সম্বলিত সর্বশিক্ষা অভিযানে সামিল হঅ্যা দেখে গ্রামের শিশু হাসিমুখে ইশকুলে ভর্তি হয় তাই আজ সর্বত্র স্বাক্ষরতার হারও বর্ধমান।
আগে আগে গ্রামে গ্রামে এইডস নিয়ে পটশিল্পীরাও এঁকেছে এমন পট। আজ সবাই এইডসের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। আবারিত যৌন সংসর্গের আগে ভাবে সব কটা পয়েন্টে টিক পড়েছে তো? না বাবা আর দরকার নেই এসবে…ইত্যাদি আরকি।
আগে যেমন পণ প্রথায় কথায় কথায় বলি হত এখন অতটা শোনেন কি? উত্তর হল না। কারণ এই সচেতনতা। আর এত বড় দেশে কোথাও না কোথাও একটা দুটো আন রিপোর্টেড দহেজ নেওয়া সেগুলোর কথা বলছি না। পাত্র, পাত্রী উভয় পক্ষের সায় না থাকলে কেন এযুগেও এমন হবে?
বধূ নির্যাতন বা কন্যা ভ্রূণ হত্যা? সেটা হয়। তবে এই পুরুষতান্ত্রিকতার অভিশাপ একদিন ঠিক ঘুচবেই দেখবেন। তবে সবাইকে টেক্কা দিয়ে ধর্ষণ এখন মিডিয়ার লেটেষ্ট হিট। আমাদের পক্ষে লজ্জার সেটাই। না না মেয়েদের পক্ষে না ছেলেদের পক্ষেও সমানভাবে লজ্জার।
ঐ দেখুন আবারো মনে পড়ল সচেতনতার কথা।
রক্তদান? একটু রক্ত, একটু প্রাণ? সেটা তো পাড়ায় পাড়ায়, ক্লাবে ক্লাবে কাউকে মনে করিয়ে দিতে হয়না। ব্লাড ব্যাংকে রক্তের বন্যা এখন। চাইলেই পাওয়া যায়।রক্তের জন্য রুগীর মৃত্যু হয় বলে শুনিনা আজকাল। ছুটির ভোরে অটোয় চড়ে, মাইক হাতে চেঁচিয়ে মরে, রক্তদান করুন, রক্তদান করুন বলে।
আরও আছে।
বাসে, ট্রামের গায়ে লাল ত্রিভুজের বিজ্ঞাপন মনে পড়ে? নিরোধ ব্যাবহার করুন আর মালা ডি খান মনে করে, মনে পড়ে? হয়েছে তো এই করেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ। আজ গ্রামে গঞ্জে এবং শহরের বস্তি অঞ্চলে অনেক মেয়েরা যেচে দুটি বাচ্চার পরেই “নাসবন্দী” করিয়ে নেয় মনে করে। অথবা পুরুষ করায় ভ্যাসেক্টমি। সেবার এইসব বিষয় ছাড়াও পটশিল্পীদের দেখেছিলাম কন্যাশ্রী নিয়ে আর কন্যাভ্রূণ হত্যা নিয়ে গান লিখে ছবি আঁকতে।
আর এই তামাক ক্যানসারের কারণ? এ নিয়ে পটশিল্পীরাও সোচ্চার জানেন? সিনেমা হল তো বলে বলে মাথায় ঢুকিয়েই ছাড়ছে। ছবির আগে এই সব তথ্যচিত্র দেখালে সরকারি অনুদানও পায় তারা।
তাহলে? তাহলে আর কি? যে জন্য এই লেখা শুরু করা সেই ধর্ষণ নিয়ে কেন পারব না আমরা তথ্যচিত্র বানাতে? বিজ্ঞাপন তৈরী করতে? প্লাসটিক নিয়ে চিক চিক চিক চিক প্ল্যাস্টিক চিকনা করে সেলেব দ্বারা পরিবেশিত সুমধুর গান, অভিনেতার তেলা মাথায় তেল দিয়ে দিয়ে বারেবারে স্বচ্ছ দেশ বা নির্মল রাজ্য বানাতে যদি সচেষ্ট হই তাহলে কেন রেপ নিয়ে গান লিখব না?
পটশিল্পীদের দিয়ে পটচিত্র আঁকিয়ে গান বাঁধব না, সিনেমা শুরুর আগে “রেপ” নিয়ে পাঁচ মিনিট সেলেবদের প্রতিক্রিয়া শুনব না?
বাড়ির মেয়েদের না, ছেলেদের বারেবারে বলবনাই বা কেন? রেপ করলে কি হতে পারে জানিস? রেপ তোর জীবনটাকে পঙ্গু করে দিতে পারে। সমাজে একঘরে হয়ে যাব আমরা। জীবন একটাই। সেখানে ছেলে আর মেয়ে সমান। মেয়েদের সম্মান দিতে শেখ। আর নিজের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকাটাই আসল, এসব ছোট থেকেই মগজে ঢোকাব না?
এই মুঠোফোনের দুনিয়ায় কামদুনি থেকে কামাখ্যা, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী প্রতিঘন্টায় রেপের খবর ঠিক যেমন ভাইরাল হতে এক সেকেন্ডও লাগেনা। ঠিক তেমনি ডিজিটাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হোক রেপের আউটকাম নিয়ে কি ভয়ংকর কান্ড হতে পারে। গ্রাম থেকে শহর সবার হাতেই এখন স্মার্ট ফোন। বস্তিবাসী থেকে বড়লোক, মিস্ত্রী থেকে মধ্যবিত্ত, ট্রাক ড্রাইভার থেকে টেক স্যাভি সবাই এক আকাশের নীচে দেখুক এই ভিডিও। সঙ্গে চলুক সিনেমা হলে রেপ নিয়ে উদ্দাম ডক্যু। শিল্পমেলায় রাজ্যে রাজ্যে পটশিল্পীরা রেপ নিয়ে গান বেঁধে ছবি আঁকুক ধর্ষণের বীভৎসতা নিয়ে । বাউল, ঝুমুর শিল্পীদের একতারায় রেপ রেপ রেপ, আমাদের দেশ আজ হোক বড় সেফ… করে বারেবারে ঝড় উঠুক।মুখে মুখে ফিরুক, হিন্দি আর বাংলায়। এগুলোর পাশাপাশি চলুক ডিজিটাল বিজ্ঞাপন।
আমি নিশ্চিত যে ধর্ষকামেরা এন্ড্রয়েড ইউজার তাদেরই, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দ্বারা গুগ্ল হ্যাঁ, তাদেরি ঠিক সেই ভিডিওগুলো বারেবারেই দেখাবে যে মাংসাশীগুলোর পর্ণ ভিডিও দেখবার আঙ্গুল নিশপিশ করে । আর তাই বারেবারে সেগুলিতে ক্লিক করে কামতাড়না ঘোচায়। আর হাতের কাছে কাউকে না পেলে আশেপাশের মেয়েগুলোকে খুবলে খায়। প্রযুক্তি তো সমাজের কল্যাণে আসুক।