• Uncategorized
  • 0

উৎসব সংখ্যায় গদ্য – সুপর্না ভট্টাচার্য্য

উৎসব

কী ভিড়!কী ভিড়!
সমস্ত রাস্তা মানুষ ঠাসা। বাতাসীর এই প্রথম কলকাতায় আসা। ছেলেমেয়েদুটোকে আলোর রোশনাই দেখাতে বড়ো সাধ জেগেছিলো। এমন উৎসব দেখার জন্য দূর দূর গ্রাম থেকে লোক আসে। তারা তো তবু  ক্যানিং থেকে এসেছে। খুব বেশি দূর নয়।
সে তো রোজ রোজ আসে আঁধার থাকতে থাকতেই।ট্রেনে করে। আজও এলো সেভাবেই।  সন্ধ্যা বেলা ঝাঁকায় মুরগির  মতো গাদাগাদি করে  ফেরে। ভাগ্যিস মাধবীদি বাচ্চাদুটোকে দেখে। কখনো সখনো দরজায় ঝুলে ঝুলেও যায়।
কোনদিন যে হাত ফসকে টুকুস ক’রে পড়ে যাবে ,কে জানে!!
শরীর দুর্বল লাগে এই টানাপোড়েনে। তবু,,,
বাপরে লাইনে দাঁড়িয়ে কোমর পা টনটন করছে। দুহাতে  শক্ত ক’রে হাসি আর শুভর রোগাপাতলা হাতদুটো ধ’রে আছে। ধুররর,,,নাএলেই হতো মনে হয়।
বাতাসী সামনের বউটাকে দেখে। কি সুন্দর মখমলের মতো শাড়ী পরেছে।
তিনবাড়ি তোলাকাজ করে বাতাসী। একবাড়ি রান্না। সব বাড়ি থেকে টাকা নিয়েছে বাতাসী। ছেলেমেয়েদুটোকে জামাজুতো কিনে দিয়েছে। মাধবীদিকে একখানা ছাপা শাড়ী। বাকিটা রেখে দিয়েছে লক্ষ্মীর ভাঁড়ে।
উফফ,,,ঢুকলো প্যাণ্ডেলের ভিতরে শেষঅবধি।
জায়গাটা চেনা বলে রক্ষে!!
এখানেই আসে রোজ সে। ঘেমে নেয়ে একশা তিনজন। বড়ো ফ্যান টার পাশে দাঁড়ায়। চুল উড়ে মুখে পড়ছে,,পড়ুক।
দুগ্গা মায়ের নাকে কতবড় নথ।
বাতাসীর আঙুল নিজের অজান্তে চলে যায়,নাকের ফুলে।
নরোত্তম দিয়েছিলো বিয়ের রাতে।
বলেছিলো,’বোঁচা নাকে কেমন সুন্দর মানিয়েছে। ’
বাতাসীর বুকে তখন যেন নদীর শব্দ,,,ধীর ,কিন্তু উচ্ছল,,,
আজও চোখ বুজলেই সে শব্দ শুনতে পায় বাতাসী।
’মা,পায়ে ফোস্কা পড়েছে,আর হাঁটতে পারছি না, করুণ সুরে বলে হাসি।
বাড়ি যাবো মা,ক্ষিদে পেয়েছে’ শুভ ভিড় ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বলে।
ইস্টিশনে যাবার জন্য অটোয় ওঠে বাতাসী।
হঠাৎ  ঝড় উঠলো। কি ধুলো,,,
এমন করেই হঠাৎ ঝড় উঠেছিলো সেদিন রাতে। যে রাতে নরোত্তম ফিরলো না ঘরে।
পুলিশ এলো ভোর রাত্তিরে। বাতাসী তখন খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাওয়ায় বসে।
’নরোত্তম দাসের বৌ তুমি?’
’হ্যাঁ বাবু’
’সে কোথায় ?’
’কাল রাত থেকে বাড়ি ফেরেনি। এই প্রথমবার  । বিয়ের পর থেকে। ’
’কোথায় আর পালাবে,আমাদের হাত থেকে?ঠিক ধ’রে ফেলবো। ’
’কেন?কি হয়েছে!!?’আর্তনাদ করে উঠেছিলো কি!’
’খুন করতে গেছিলো’
বাতাসী পড়ে যেতে যেতে খুঁটিটা ধরে ফেলেছিলো।
অমন শান্ত নির্বিরোধী মানুষ খুন করতে যাবে কি করে!!?কাকে?কেন?
কোনরকমে উচ্চারণ করতে পেরেছিলো বাতাসী।’ব্রজেন আচার্য কে। কাস্তে চালিয়ে দিয়েছে গলায়। বেঁচে গেছে বরাতজোরে। কেন,সে নরোত্তমই জানে’
অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো বাতাসী। উঠানে।
ইস্টিশনে তিনজন মিলে ঘুঘনি,মুড়ি খেলো।
ট্রেনে জানলার ধারেই বসতে পেলো।
এখন ফিরতি পথে লোক নেই বেশী। রাত হলে লোক বাড়বে।
হাসি,শুভ ঘুমিয়ে ন্যাতা। টেনে টেনে ঘরে নিয়ে যেতে কষ্ট হবে।
শহর ছাড়াতেই সব আলো এক ফুৎকারে নিভে গেলো।
বাইরের গাঢ় অন্ধকারে তাকিয়ে রোজকার মতোই ভাবে,কেন খুন করতে গেছিলো মানুষটা,অমন শিক্ষিত ব্রজেন আচার্যকে?’
পুলিশ দুদিনেই ধরে ফেলেছিলো নরোত্তমকে। মামলা লড়ার মতো জোর কী আর ছিলো বাতাসীর!?
সাত বছরের জেল হয়ে গেলো।
কেমন পাথর হয়ে গেছিলো মানুষটা। একটা কথার প্রতিবাদ করেনি। শুধু ব্রজেন আচার্য যখন আদালতে বলছিলেন,’হয়তো টাকা পয়সা হাতানোর জন্যই কাস্তের কোপ দিয়েছিলো গলায়। সামনেই তো পুজো,তাই…বোধহয়…তখন মুখ তুলে হেসেছিলো মানুষটা।
বাতাসী দেখেছে স্পষ্ট ,ব্রজেন আচার্য চোখের পাতা ফেলে, মুখ নামিয়ে নিয়েছিলো।
বাতাসীকে শুধু বলেছিলো, নরোত্তম,’আমার উপর বিশ্বাস রাখিস বাতাসী। পাপ কিছু করিনি। “
তারপর দ্রুত উঠে গিয়েছিল জাল ঘেরা কালো গড়িটায়।
ব্রজেনবাবূ এগিয়ে এসে বলেছিলেন,’ অসুবিধা হলে বোলো, সংকোচ কোরোনা’
বাতাসী তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে একদলা থুতু ফেলেছিল রাস্তার ধুলোয়।তারপর  মিশে গিয়েছিল ভীড়ে।
তিনবছর হয়ে গেলো।
বাতাসী নাকের ফুলে আদর করে।
ছেলেমেয়েদুটোকে আরো একটু আঁকড়ে ধরে বলে,মনে মনে,“হে মা দুগ্গা,আর চারটে বছর মানুষটাকে ভালো রেখো,মাগো,তারপর আমি তাকে দেখবো,ভালো রাখবো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।