আজ সকাল থেকে ঝকঝকে উজ্জ্বল আলো সারা আকাশ জুড়ে। অন্যদিনের তুলনায় একটু ভোর-ভোরও উঠে পড়েছি। সদ্য-ফোটা ফুলের মতো অনুভব করলাম নিজেকে, যদিও এ-অনুভবের উপমা রবীন্দ্রনাথের থেকে ধার করা।
সারাদিনের কাজগুলো বেশ গুছিয়ে-গাছিয়ে হল। রাত্রিবেলা হঠাৎ মনে হল, এইভাবে প্রতিদিন যদি সব কাজই গুছিয়ে করতে পারতাম, তাহলে জীবনটা অনেকটা মূল্যবান করে তোলা যেত। ইদানীং আমি যেন আত্মবিশ্বাস প্রায় হারিয়েই ফেলতে বসেছিলাম। গত সপ্তাহখানেক হল ক্রমশ আবার নিজের দিকে ফিরতে পারছি।
কী করে জানো? স্বামীজী। স্বামী বিবেকানন্দ। ওনার সম্পর্কে কিছু স্মৃতিকথা পড়ছি, সেগুলোই আবার আমাকে আমার মেরুদন্ড ফিরিয়ে দিচ্ছে।
(১০)
অনেকদিন কিছু লিখিনি তোমায়। পৃথিবীর ভয়ঙ্কর অন্ধকার আমার মনেও ছায়াপাত করেছিল যে! ঐ নৃশংস উপসাগরীয় যুদ্ধ আমাকে, বিশ্বাস করো, ভীষণ, ভীষণ প্রভাবিত করেছে। আমাদের চোখের সামনে ইতিহাস সৃষ্টি হল, কিন্তু কী ভয়ঙ্কর এ-ইতিহাস! মানবতার এই অপমান কী করে সহ্য করবো বলতে পারো? যে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছড়িয়ে গেল সারা পৃথিবী জুড়ে, কী করে দুচোখ দিয়ে তা দেখবো বলতে পারো ?
অথচ আমি, তুমি, সে ইত্যাদি সব মানুষকে এইভাবেই বাঁচতে হবে। আমাদেরই নিজের হাতে পরের প্রজন্মকে ঠেলে দিতে হবে আগ্নেয়গিরির মুখে, যুদ্ধের পরাক্রান্ত সুরে গাইতে হবে সভ্যতার জয়গান।
তোমার তো টাইফয়েড হয়েছিল শুনলাম। তবু তুমি নাকি ঐ অবস্থাতেও এই যুদ্ধ নিয়ে স্যাটায়ারিক একটা কবিতা লিখেছ! অরিন্দম বললো। তাহলে তোমার মধ্যেও ক্রিয়া করেছে ঐ উপসাগরীয় হাওয়া! সাবাশ! আমিও দুটো কোলাজ করেছি দাঁতে দাঁত চেপে, যেখানে সমুদ্রের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সাদা পায়রার ডানা। বোধহয় আমাদের করার বলতে শুধু এইই, তাই না?
‘অর্জুন, অর্জুন আজ লক্ষ লক্ষ জনগণমন
দোর্দন্ড গান্ডীব তাই অতি প্রয়োজন!
বৃহন্নলা, ছিন্ন করো ক্লীব ছদ্মসজ্জার ব্যসন।’
(১১)
আচ্ছা কৃষ্ণেন্দু,
মনে পড়ে একদিন টিকিয়াপাড়া স্টেশনে এক গভীর রাত্রে তুমি ডায়রী খুলে শোনাচ্ছিলে তোমার কবিতা! আজ কেন জানি না সেই নিঃঝুম স্টেশনের ঠান্ডা স্মৃতি ভেসে আসছে মনে। এক ফাঁকা ট্রেন রঙ্গিনীর মতো ঝমঝম নূপুর বাজিয়ে ছুটে চলে যেতে যেতে নিয়ে গেল তোমার সেদিনের শেষ কবিতার রেশ —
তবুও তো কাক ডাকে ।
গুটি ভেঙে জীবনের সরল সত্য উড়ে যায় —
আর আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে, ঠিক তারপরেই একটা পুলিশ এসে তাড়া করতে, পালিয়ে আসতে আসতে তুমি চেঁচিয়ে বলে উঠেছিলে — ‘তবুও তো কাক ডাকে’।
ওঃ! তারপর সে যে কী হাসি দুজনের। জীবনকে তীব্রভাবে উপভোগ করতে করতে আমরা সেদিন শেষ সিগারেটটা ধরিয়েছিলাম।
(১২)
প্রিয় কৃষ্ণেন্দু,
কিছুদিন খুব ভুগে উঠলাম। মাঝে মাঝে কেমন মনে হয় না, যে, বেশ ভালোভাবে শরীর খারাপ করুক, শুয়েবসে বিশ্রাম নিই ক’দিন? এ-ও আমার সেই ইচ্ছাকৃত অসুখ বলে মনে হল।
হ্যাঁ, তার মধ্যেই তোমার চিঠি পেয়েছি। সেদিন খুব বৃষ্টির জল ঝরছিল — মাটির বুকে, মনের বুকেও। তোমার চিঠিটা যেন তার মধ্যে বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো মনকে চমকে দিয়ে গেল।
তুমি লিখেছো তোমার সৌন্দর্যবোধের ধারণা নিয়ে। হ্যাঁ, তোমার মতোই আমিও সুন্দরের জন্য ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দাঁড়াতে রাজী সর্বদা । জীবনের কাছে, সুন্দরের কাছে এই নতজানু শুদ্ধিভিক্ষা — এ আমার সারাজীবনের সাধনা । হয়তো তীব্র চিৎকারে ‘সুন্দর’, ‘সুন্দর’ বলে হাঁকাহাঁকি করতে পারি না, বাইরে তাই কোন তোলপাড় নেই, আলোড়ন নেই, কিন্তু বিশ্বাস করো, আকাশ নিথর হলেও, আমার সূর্য চলছেই — উত্তরায়ণ থেকে দক্ষিণায়ন।
(১৩)
‘আকাশ জুড়ে তীব্র নীল বৃষ্টি।
আমার হৃদয় জুড়ে মুষলধারে নীল অভিমান।’
কিছুদিন ধরেই মনটা ভাল যাচ্ছে না। অফিসেও কাজের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি, খুব অসহায় আর নিঃসঙ্গ লাগছে হঠাৎ, কেন জানি না। যেন কারুর কাছে প্রাণ খুলে সব কথা বলতে পারলে, আমার সকল সুখ-দুঃখ সঠিক আবেগ দিয়ে উজাড় করতে পারলে খুব ভাল লাগতো, কিন্তু সবাই তো আর রবীন্দ্রনাথের মতো ভাগ্যবান নয়, যে, প্রত্যেক অনুভবের নিখুঁত শব্দটি প্রয়োগ করে ফেলতে পারবে? তাছাড়া আমার এ সুখ-দুঃখ কি মানুষের মহত্তর সুখ-দুঃখকে স্পর্শ করতে পারে? ঠিক জানি না। বেদনারা চলে-যাওয়া বছরটার মতই পুরনো বলে মনে হয় । অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দেশলাই খুঁজি। আলো বলে, টু-কি।
কত কী যে করার আছে। কিছুই করা হচ্ছে না। পঁচিশ পেরিয়েও যদি কোন কাজের কাজ শুরু না করতে পারি, তবে কবে আর করবো? এইসব ভেবেই মাঝে মাঝে বড়ো নিরাশ হয়ে পড়ি, জানো? আবার তখনই পৃথিবীর অনেক বড়ো বড়ো হতাশার কাঁটাবেড়ায় সৃষ্টির ফুল ফুটে উঠতে দেখে শান্ত, সংযত হই। স্তব্ধ হয়ে হাতজোড় করে বসি আমার জীবনদেবতার সামনে — আরো পথ, আরো পথ, বুঝি হয় লাল ও-পূর্ব কোণ।
(১৪)
‘আবার আকাশপারে ভেসে উঠবার
প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবার
অমর্ত্য আনন্দে আমি ভুলে যেতে চাই
জীবনের কোন মানে আছে কিংবা নাই —’
(১৫)
আমার ভেতরে সুর খেলা করে। আমি তাই বাঁশি বাজাই। আমার ভেতরে কথা খেলা করে। আমি তাই লিখি। জানো, সুদূরপিয়াসী হবার ইচ্ছা ছিল দারুণ। হতে পারিনি। হতে দেয়নি।
আমার নীলাঞ্জনারা আমায় উদাস করে দেয় গভীর। সেই উদাসতা থেকে উঠে আসে বোধ। হয়তো প্রচ্ছন্ন কিছুটা অভিমানও। বাস্তবতা না থাকার অপরাধে আমার হয়তো যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর! কই, কোন প্রখ্যাত শিল্পীকেও তো তার ছবির এই অবাস্তবতার অপরাধে এতটা শাস্তি পেতে হয়নি? তাহলে কেন একা আমার এই অপরাধবোধ? আমি কি সত্যিই কিছুটা অন্যরকম? এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ থেকে এতটাই বিচ্যুত?
(১৬)
জানো কৃষ্ণেন্দু,
কাল একটা স্বপ্ন দেখলাম। আজ পর্যন্ত হুবহু মনে আছে। সাধারণত স্বপ্নের একটা আবছা ভাব ছাড়া আর কিছু মনে থাকে না। কিন্তু এটা এত স্পষ্ট, তোমায় কি বলবো? আমি তোমায় স্বপ্নটা শোনাই, দ্যাখো তো এর কোন তাৎপর্য খুঁজে পাও কিনা।
পথ দিয়ে চলছিলাম। একা একা । সেরকম কোন গাঢ় বন্ধু নেই আমার। আমিও হয়তো রঙ মেশাতে পারিনি সেভাবে। ততটা অন্তরঙ্গতার সঙ্গে আবীর মাখিয়ে দিতে পারিনি চোখেমুখে, কপালে, চুলে । আমার তাই একতা নেই, একাত্মতা। অনেক উপকারও হয়তো অলক্ষ্যে পাই। কিন্তু সঙ্গহীনতার বেদনা? তাকে কিভাবে এড়িয়ে যাবো, বলতে পারো?
যদি খুঁজে পাই আবার উৎসমুখ, এই আশ্বাসে চলছিলাম। কোন সাড় নেই। পায়ে রবারের চটি, হয়তো ছিঁড়ে যাবে না আমি না থামা পর্যন্ত। আমার এখনো চশমার দরকার হয় না অন্তত বন্ধু চিনতে বা কবিতা পড়তে। আর ব্যাগ একটা থাকেই, যদি যা পাই, চোখভরে বা মনভরে নিতে না পারি? সবটা তো নিতেই হবে, ফেলে গেলে চলবে না। মধ্যবিত্তের এই স্বভাবটা অন্তত পেয়েছি।
এসব ভাবতে ভাবতে হেঁটে চলেছি। দেখিনি, কখন আকাশে মেঘ করে এসেছে। অথচ চারপাশ তখনও রঙীন ঝলমলে, অনেক আলো। অনভ্যাসের চোখটা একটু ওপরে তুললেই আচ্ছন্ন করে এগিয়ে আসা অন্ধকার। এই সেই বৈপরীত্য, আমায় যা চিরকাল মুগ্ধ করে রাখে।
হঠাৎ ইঁটের ঠোক্করে ছিটকে পড়লাম ফুটপাথে। আর সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম এক খিদে, দুর্দান্ত, জান্তব খিদে। চোখের সামনে অনেক পা, কোন হাত নেই। তারা দাঁড়িয়ে আছে স্টিল পোজে। আমি কষ্ট করে বললাম — ‘ভাত’। পরক্ষণেই একটা হাত আমার সামনে এগিয়ে এল। দেখলাম, সে হাতের কড়ে আঙুলে বড়ো নখ আর কব্জীতে দুটো চুড়ি। সেই হাত সামনে মেলে ধরলো একটা ফুল।
ভাতের বদলে ফুল! ঐ হাতও জেনে গেছে আমি এক শিল্পপূজারী?