সেই কবে এক বৈশাখের পঁচিশে এক বালক আবির্ভূত হলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে আর অমনি চারপাশে সবটুকু আলো হয়ে গেল ।
রবীন্দ্রনাথের লেখালেখি, চিন্তাশীলতা , নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, সমাজ চেতনা , তাঁর ছোট গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, প্রভৃতি সম্ভার একেকটি মহাবিশ্বের সমান। এবং সেইসব ছাপিয়ে তাঁর ‘আইডিয়া ‘ হচ্ছে মস্ত একটা ব্যাপার ।
আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের বিদেশ যাত্রা, রাশিয়ার চিঠি, য়ূরোপ যাত্রার ডায়েরি, তাঁর জাপান ভ্রমণ , সারাজীবন এই ভ্রমণ , এই যাত্রা আসলে এক অনুপম ছায়াপথ রচনা করে গেছে রবীন্দ্রনাথের অন্তর শক্তিকে। এমনকী তাঁর সারাজীবনের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনে। ‘সেন্স অব অ্যাস্থেটিক’ এইটাই যেন কবেকার একটা মস্ত বিস্ময় যা আজ-ও প্রবহমান, যা দশকের পর দশক ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের সুকুমার মন , আমাদের কৌম চেতনা। আমাদের জীবন দর্শনের সমস্ত টুকুই যেন তাঁর দান।
স্বাধীনতা যুদ্ধের লড়াইয়ে তাঁর অবদান মনে রাখব । দ্য ভাইসরয় অব ইন্ডিয়া লর্ড কার্জন এর নেতৃত্বে বেঙ্গল পার্টিশান, বাঙলা ভাগের ঐতিহাসিক ট্যাজেডির বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, পূণ্য হোউক পূণ্য হউক হে ভগবান ‘ লিখলেন যা দুই বাংলার মানুষের মনে নির্মাণ করল এক অদৃশ্যত দৃশ্যমান সেতু। অসম্ভবের সম্ভব, রাখি বন্ধন উৎসব শুরু করলেন 1911 এ। হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এক পরম আত্মীয়ের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠত করলেন। উদ্বুদ্ধ করলেন এক যৌথ চেতনার।
ব্যতিক্রমী রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমসাময়িক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের থেকে বহুদূর এগিয়ে থাকলেন নিজের বজ্রসম কলমের ধারে। নিজের বিবিধ প্রবন্ধ, সাহিত্যে নোবেল জয়ী এই মহান মানুষটি তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি সরব হয়েছেন । বরাবরই । প্রত্যাখান করেছেন জালিয়ানওয়ালার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি। এই ‘ত্যাগ ‘ এর বিষয়টাও ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি , এক নির্লোভ , নির্মোহ চরিত্র চেতনা তাঁকে এই সিদ্ধান্ত নিতে যোগ্য সঙ্গত করেছে।
তাঁর সাথে গান্ধীজীর সান্নিধ্য কালীন যে পারস্পরিক চিন্তাভাবনার আদান-প্রদান, তা আমরা মনে রাখব। চিন্তার স্থানিক আধিপত্য কাটিয়ে উঠে চিন্তার বিশ্বজনীন নৈকট্যের সমাদর কে গ্রহণযোগ্য করে তোলার আহ্বানে রবীন্দ্রনাথের লেখালেখি, চিন্তাশীলতা, কর্মযজ্ঞ আমরা মনে রাখব ।
‘ চার অধ্যায়’ , ‘রক্তকরবী ‘, ‘গোরা’, ‘ঘরে-বাইরে ‘প্রভৃতি উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার সুদূর প্রসারি ফসল ।
তেমনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর শুধু স্বপ্নের নয় , আদর্শ -ও। যে আদর্শ কাজ করতে চেয়েছে এক গ্রামীন বাংলার বুক থেকে ঘুরে ঘুরে ভেসে ভেসে সারা বিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে দিয়ে । থট অব ইউনিভার্সাল আইডিয়া অ্যাবাউট টু লার্ন লার্জার দ্যান সো কলড ন্যাশনাল এডুকেশনাল কনসেপ্ট এন্ড কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজ । প্রকৃতির সঙ্গে শিশুমনের সাজুয্য রেখেই চেয়েছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি ‘মডেল ‘ প্রতিষ্ঠিত করতে ।
সমবায় ব্যাঙ্ক, রাস্তাঘাট, ইদারা তৈরির মতোই এক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাকে বিশুদ্ধ আনন্দের মোড়কে উপস্থাপনা করতে পেরেছেন । সাহিত্য দিয়ে নির্মাণ করে গেছেন চিন্তার বৈচি ত্র্য, কাজ দিয়ে, সমগ্র জীবন , সাধনা , চিন্তাশীলতা, কর্মযজ্ঞ সমস্ত যাপন ও চর্যা দিয়ে রেখে গেছেন ভাবীকালের জন্য এক অমূল্য বৈভব। শুধু জন্মদিন পালন দিয়ে নয় , তাঁকে ও তাঁর আইডিয়া কে আমাদের সমগ্র জাতির ঘুরে দাঁড়াবার জন্য আজ পুনরায় ফিরে দেখা দরকার ।
তিনি জানতেন কোনটা হীরে আর কোনটা তার দ্যুতি। কোনটা প্রদীপের পিলসুজ আর কোনটা প্রদীপের জ্বলে থাকা। জীবনের ধ্রুবতারা রবীন্দ্রনাথ, প্রাণের নাথ রবীন্দ্রনাথ ।