• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়

গীত অঞ্জলি

(১)

সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে ফেলেছিল অনুপূর্বা, আজ একতলায় নেমে প্রথমেই রান্নাঘরে ঢুকে কাল রাতের এঁটো বাসনগুলো মাজবে না। এক মাসের ওপর হয়ে গেল এখনও লকডাউন ওঠার নাম নেই আর তার সাথেই কাজে আসার নামগন্ধ নেই কাজের মাসির। পরিবারের বাকি চার সদস্যের কাজে ঢিলেমি দেওয়ার সুযোগ থাকলেও অনুপূর্বার তা নেই, কারন ও যে বাড়ির বউ; গৃহবধূ- গৃহ পালিত বধূ।
তবে বাকিদের কাছে গুরুত্বপূর্ন না হলেও আজকের দিনটা ওর কাছে একটু অন্যরকম। আজ যে পঁচিশে বৈশাখ, কবিগুরুর জন্মদিন। ছোটবেলা থেকেই এই রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনটাতে হয় গানের স্কুলে নয়তো পাড়ার ফাংশনে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে এসেছে ও। বিয়ের পর অবশ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে সব। তবে গত বছর সরস্বতী পুজোর সময় যখন একতলার ছোট্ট স্টোররুমটাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে ‘গীত অঞ্জলি’ নাম দিয়ে বাচ্চাদের জন্য গানের স্কুল খুলল তখন থেকে আবার একটু একটু করে পালটাতে শুরু করল সবকিছু।
তবে এই পরিবর্তন আনার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল অনুপূর্বাকে। গানের স্কুল খুলবে শুনে প্রথমেই আপত্তি জানিয়েছিল শাশুড়িমা; সারা বিকেল সেজেগুজে বসে থাকলে ওঁর ফাইফরমাশ খাটবে কে ? আর কেই বা সামলাবে অনুপূর্বার আট বছরের মেয়ে শাল্মলী-কে ? মায়ের সাথে কোনো বিরোধিতা করবে না বলে চুপচাপ থেকে গিয়েছিল শ্যামল। সে সময় শ্বসুরমশাই পাশে না দাঁড়ালে গান শেখানোর স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যেতো অনুপূর্বার।
বিপত্তি ছিল বাইরেও। এই রিয়েলিটি শ্যো-এর যুগে বাজারচলতি চটকদার গানের কদরদানের সংখ্যাই বেশি; ওদের ভাষায় রবীন্দ্রসংগীত হল প্যানপ্যানে গান। তবে সবাই তো আর ওদের মতো নয়, কিছু সুশিক্ষিত মানুষ এখনও আছে, তাই একটু সময় লাগলেও ধীরে ধীরে ছাত্রছাত্রী আসতে শুরু করল ‘গীত অঞ্জলি’-তে। তাদের নিয়েই গত বছর রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান করেছিল অনুপূর্বা। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ভিডিওটা শেয়ার করার পর প্রশংসা করেছিল চেনাজানা সবাই। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল অনুপূর্বা; এ বছর আর সে সুযোগ নেই, করোনা ভাইরাসের ভয়ে ছেলেমেয়েদের বাড়ির বাইরে বের হতে দিচ্ছে না কেউই।

(২)

নিজের প্রিয় ঘরটাতে ঢুকতেই মনটা আনন্দে ভরে গেল অনুপূর্বার। পরম যত্নে তানপুরাটার গায়ে হাত বুলোতে লাগল ও। ইস, কতো ধুলো জমেছে; ঘরকন্নার কাজ সারতে সারতে এ কদিন একেবারেই নজর দেওয়া হয়নি এদিকটাতে। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে শাড়ির আঁচল দিয়েই সরিয়ে দিতে লাগল হারমোনিয়াম আর তবলার গায়ে লেগে থাকা ধুলোর পরত।
ছোটবেলা থেকেই অনুপূর্বার শখ ছিল রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন শান্তিনিকেতনে গিয়ে উপাসনা গৃহের অনুষ্ঠান দেখার। তাই গত বছরের আগের বছর ভরা গরমে শাশুড়িমা যখন তারাপীঠ যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তখন শ্বসুরমশাই আর শ্যামল নারাজ থাকলেও এককথায় রাজি হয়ে গেল অনুপূর্বা। যাওয়ার জন্য বুদ্ধি করে বেছে নিল পঁচিশে বৈশাখের আগের দিনটাকে। তারাপীঠে পুজো দিয়ে সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই চলে এল বোলপুরে। পরদিন সকাল সকাল মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। অনিচ্ছাসত্বেও সঙ্গ দিল শ্যামল তবে সারাক্ষন গজগজ করতে লাগল বেড়াতে এসে সাতসকালে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য।
শাল্মলীকে নিয়ে সাদা পোষাক পরিহিত নারী-পুরুষের ভিড়ে মিশে গেল অনুপূর্বা। একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে জায়গা করে নিল একেবারে সামনের সারিতে। ওর ইচ্ছা ছিল পুরো অনুষ্ঠান দেখার কিন্তু আধঘণ্টা যেতে না যেতেই বেজে উঠল ব্যাগে রাখা মোবাইল ফোন। বিরক্ত হয়ে শ্যামল জানতে চাইছে, আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। অনুপূর্বা জানতো এখনই উঠে না পড়লে কপালে দুঃখ আছে।
ধীর পায়ে বেরিয়ে আসতেই চোখ চলে গেল উল্টোদিকের সবুজ বেড়াটার দিকে। যারা ভেরতে যাওয়ার সুযোগ পায়নি তারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক সৌম্যদর্শন প্রৌড় ভদ্রলোককে দেখে খুব চেনা লাগল অনুপূর্বার কিন্তু কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারলো না। তারপর একটু ভালো করে দেখতেই মনে পড়ল, ইনিই তো সেই দক্ষিণ ভারতীয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী যিনি অনেক নামী বাঙালী প্ল্যে-ব্যাক সিঙ্গারের থেকে অনেক ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন। অনুপূর্বার খুব ইচ্ছা হল ওঁর সাথে একবার কথা বলার কিন্তু ঠিক তখনই তাড়া লাগালো শ্যামল; বেশি দেরী হলে শাশুড়িমা রাগ করবেন, অনুপূর্বার মনে রাখা উচিত ও দুজন বয়স্ক মানুষের সাথে এখানে এসেছে। অনেক চেষ্টা করেও অনুপূর্বা কিছুতেই বুঝতে পারল না ওর একটু দেরী হলে হোটেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমন্ত ওই বয়স্ক দম্পতির ঠিক কি অসুবিধা হবে।
বাস্তবে ফিরে এল অনুপূর্বা। সকালে উঠে চা না পেলে কেউ কথা শোনাতে ছাড়বে না। অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে এখানে, এবার কাল রাতের খাওয়া বাসনগুলো মাজতে হবে। তবে যতই কাজ থাকুক না কেন আজ বিকেলের প্ল্যানটা ও কিছুতেই চেঞ্জ করবে না। সবকিছু আগে থেকে ঠিক করাই আছে; যেমনভাবে শাল্মলীর অনলাইন ক্লাস হোতো ঠিক তেমন করেই আজ বিকেল পাঁচটার সময় ভিডিও কলিং করে স্টুডেন্টদের সাথে যোগাযোগ করবে অনুপূর্বা। এ বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করবে ভার্চুয়ালি। গাইবে ওর ছোটবেলার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত, “বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।