• Uncategorized
  • 0

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সংখ্যায় তুষ্টি ভট্টাচার্য

ভাষা ও ভাষাহীনতা 

‘ড়ঢ়প – ড় ঢ় প
এই অনুচ্চারের ভিতর
গোটা একটা সূর্য জ্বলছে
আমাদের শরীর থেকে শুরু হয়েছে’
-(আতশ / সঙ্ঘমিত্রা হালদার)
অনুচ্চারের ভাষা নিয়ে ভাবতে গেলেই খেই হারিয়ে ফেলি যখন তখন। একজন বোবা মানুষ কীভাবে নিজেকে প্রকাশ করবে? চোখের ভাষায়, শরীরের ভাষায় নাকি আঙুলের ভাষায়? সে যদি অন্ধ হয়, সে যদি চলতশক্তিহীন হয়, সে যদি বধির হয়? তখন! তখন? প্রকাশ কি কেবল একটা উপায় মাত্র? এক একটা মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে সে প্রকাশিত হয় শুধু! আমি অন্ধ হলে দেখতে পাবো না সেই বোবা মানুষটি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কি বলতে চায়। আমি বধির হলে তো শুনতে পারবো না তার অস্ফুট মুখের গোঙানি!
ধরা যাক একজন বাঙালি, বাংলা ছাড়া আরও দুতিনটি ভাষা জানে বা বোঝে। এর বাইরে অন্য ভাষায় তার সামনে কেউ কথা বললে, সে নিশ্চই কিছুই বুঝবে না। আসলে কি তাই? কিছুই বুঝবে না? উল্টোদিকের মানুষটির কথা বলা দেখে, তার ঠোঁট নাড়া দেখে, তার প্রকাশ দেখে, তার আকুলতা দেখে কিচ্ছু কি আঁচ করবে না? এমন একেবারেই হয় না, যদি না সে অনুভূতিশূন্য হয়। আমার জানা একজন বয়স্ক অল্পশিক্ষিতা মহিলা, যিনি বাংলা ছাড়া বা বলা ভালো বাঙাল ভাষা ছাড়া কিছুই বলতে বা বুঝতে পারেন না। তাঁর ছেলে অ্যামেরিকা বাসী, গ্রিন কার্ড হোল্ডার, মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে অনেকবার। মা কিছুদিন থেকেই পালিয়ে এসেছে দেশে। অনর্গল কথা বলতে ভালোবাসে যে মা, সে ও-দেশে থেকে হাঁফিয়ে উঠেছে। তাই নিজের দেশে ফিরে এসে একা একা রুগ্ন শরীর নিয়ে পড়ে আছে, শুধু দুটো প্রাণ খুলে কথা বলার লোভে। আবার এই মহিলাই একা একা প্লেনে করে অ্যামেরিকা গেছেন এসেছেন, এবং এয়ারপোর্টে বা যাত্রাপথে বিদেশীদের সাথে তার নিজস্ব ভাষাতেই কথা বলে গেছেন। অন্যপক্ষ কি বুঝেছে তা জানা নেই অবশ্য।
প্রকল্প ভট্টাচার্যের লেখা থেকে জেনেছি, তামিলনাডুতে থাকাকালীন তাঁর মা ও পাশের ফ্ল্যাটের তামিল ভদ্রমহিলার ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। প্রতি দুপুরে সেই তামিলিনী যাঁতায় চাল গুড়ো করতে করতে নিজের ভাষায় কথা বলতেন আর ওনার মা বাংলায় কথা বলে যেতেন। নিশ্চই তাঁরা এভাবেই ভাবের আদানপ্রদান করতে পেরেছেন, নইলে আর বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে কেন! এখন যদি ভাবের প্রসঙ্গ আনি, অনেক কথাই এসে যাবে। ভাষা তো মনের ভাব প্রকাশই করে। এখন যদি ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা না থাকে, সেই আদিম যুগের মত, তখনও তো ভাব প্রকাশ করত মানুষ। আর এই মানুষই আবার ভাব প্রকাশের সুবিধের জন্য ভাষা তৈরি করেছে। প্রতিটি ভাষাই একটা নিয়ম অর্থাৎ ব্যকরণ মেনে চলবে , এমন হওয়াই স্বাভাবিক। নইলে ভাষার বাঁধুনি নষ্ট হয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে ভাষা কিন্তু একই ভাবে চলে না, তার ব্যকরণ বদলে যায় আপনা আপনি। কতগুলো উপাদান থাকে অবশ্য এই বদলের পিছনে। যেমন সংস্কৃতর থেকে দূরে সরতে গিয়ে আরও সরল হয়ে যাওয়া, অন্য ভাষার শব্দের ঠাঁই নেওয়া, নতুন নতুন কথ্য শব্দের জন্ম নেওয়া… এরকম অনেক কিছুই হতে পারে। ভাষা বদলালেও ভাব কিন্তু একই থাকে। ভাব প্রকাশের রূপ বদলায় মাত্র।
আর ভাষার ব্যবধান যেখানে থাকে, সেখানে কেবল চোখের ভাষা আর শরীরের ভাষাই ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম। আবার এমনও হয়, হয়ত একই ভাষাভাষী, কিন্তু রাগ, অভিমান বা আনন্দ যাই হোক না কেন, মুখ ফুটে বলে ফেলল না একজন। অপরজন তা বলে কি সেই মনের ভাব ধরতে পারে না? নিশ্চই পারে। যদি একে অপরের কাছের মানুষ হন, বোঝাপড়া ঠিক থাকে নিজেদের মধ্যে, তাহলে সেই অনুচ্চারিত ভাষা বুঝতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হয়। একে অন্যকে আমরা এই অনুচ্চারেই প্রায়শ ভুল বুঝি। আর এখানেই ভাষার সার্থকতা। ভাষা সহায়ক মাত্র। যেন মনের মানেবই এক! এই মানেবই মুখস্থ করলে পরীক্ষায় পাশ করা যাবে ঠিকই, কিন্তু ভালো নম্বর পেতে গেলে মুখ ও মনের ভাষার ব্যবহার একসাথে করা দরকার।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।