আজ ভাষা নিয়ে দু চার কথা ৷ না, গুরুগম্ভীর আলোচনা নয় , নেহাতই একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টি থেকে অল্পকিছু বলার চেষ্টা ৷ শুনেছি বাংলায় নাকি জেলা পেরোলেই ভাষা বদলায় , কথার সুর , টান বদলায় ৷ আমরা ছোট সময় বাড়িতে কথা বলতাম উত্তরবাংলার কথ্য ভাষায় ৷ যেমন – “আরে , কালকে বিকালবেলায় মার্কেট যাওয়ার সময় সেই বৃষ্টি নামছিল ! পুরা ভিজে গেছিলাম ৷ তখন ছয়টা হবে ৷” আমাদের উত্তরবঙ্গের ভাষা একটু অন্যরকম ৷ বাংলাদেশের ছ এর টান মিশে আছে তাতে ৷ আমরা বলি ‘গেছিলাম’ , গিয়েছিলাম নয় ৷ ‘ বলে দিয়েছি ‘ কে আমরা বলি ‘বইলে দিছি’ ৷ আবার যারা কামতাপুরের মানুষ তাঁরা আপনি তুমি বলেন না, তাঁদের সম্বোধনে সবাই ‘তুই ‘ ৷ এখানকার ভূমিপুত্রদের ভাষা একদমই অন্যরকম ৷ বাচ্চারা, যারা প্রথম জেনারেশন স্কুলে আসছে তারা বাংলা এবং ইংরেজি দুটি নতুন ভাষা একসাথে শিখছে , বলছে ৷ তবে মাষ্টারমশাই দিদিমণিদের সাথে তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ৷ “বুঝপা পাছু, তুই কি কবা চাহাছিস। ” “মোর কাথা কবার মন নি ছে, মুই যাছু “…কচি গলায় এমন কলকলানি মাটির গন্ধ মনে পড়ায় ৷ উত্তরবঙ্গেই কিন্তু দার্জিলিং , দুই দিনাজপুর এবং মালদা জেলার কথ্যভাষা , কথার টান ভিন্ন ভিন্ন ৷
আমাকে প্রাথমিক স্কুলে যাবার আগে মা শিখিয়েছিলেন , বাবা, স্কুলে কিন্তু ভাল করে কথা বলবি, “দিছিলাম’ , ‘খাইছিলাম’ বলবি না ৷ শিশু বয়সে মাথায় ঢুকে গিয়েছিল এগুলো হয়তো বাজে ভাষা ৷ স্কুলেও দেখতাম সবাই বই-এর ভাষায়, লেখ্য ভাষায় কথা বলতো ৷ তখন বুঝিনি এসব আঞ্চলিক কথ্যভাষার মাধুর্য্য ৷
আবার গ্রামের বাড়ি থেকে দিদা , ঠাকুমা আসলে তাঁরা আবার অন্য ভাষায় বলতেন ৷ যেমন – “দাদায় দেহি কত্ত বড় হইয়া গ্যাসো !” আমার মনে হতো ইশ্ , কিরকম ভাষায় কথা বলছে ! বন্ধুরা কেউ শুনে নেয় না যেন ! মামার বাড়ি নদীয়া জেলায় ৷ মামা মাসিরা বলত , নদীয়ার ভাষা সবচেয়ে শুদ্ধ , নিমাই পন্ডিতের নিবাসস্থল বলে কথা !
দুপুর বিকেলে মায়েদের আড্ডায় শোনা যেত বিচিত্র ভাষা…. “হ্যাঁ দিদি ! আমারে এট্টু ভালো করে কইলে কী হইতো ? আমার শাউড়ির কতাবার্তা ভালো না একদম ! ভালো করে কইলে কি আমি শুনিনা ?” এ হলো মিষ্টি কথা শোনার চাহিদা ৷ মিষ্টি কথায় নাকি চিঁড়ে ভেজে ? আবার , “আমাদের সুন্দরীর এইবার ক্লাস ফাইভ হবে ৷” বলাই বাহুল্য সব ছোট মেয়েদেরই একচেটিয়া ডাকনাম সুন্দরী…তা সে যতই টাকমুন্ডি পোঁটা নাকে হোক না কেন !
পরে বড় হয়ে পাড়ার লাইব্রেরী থেকে বই পড়া শুরু করলাম যখন এক নতুন জগতে প্রবেশ করলাম যেন ৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষা,শরৎচন্দ্রের ভাষা , বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা আবার অন্যদিকে মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায়ের , তারাশঙ্করের সহজবোধ্য বাংলা ৷ কবিতার ভাষা অনন্য , তা বুঝতে মস্তিষ্ক নয় হৃদয় প্রয়োজন ৷ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পড়লাম ভাষার ইতিবৃত্ত এবং বিবর্তন ৷ পড়লাম, কিন্তু শিখলাম কই ? এখনও কত পড়া বাকি !
পরবর্তীকালে পরিচিত হলাম রাঢ় বাংলার উপভাষার সাথে ৷ একদিন শুনলাম রান্না হয়েছে ডিংলির ঝোল ৷ খেতে বসে পাতে পড়ল কুমড়ো ! কুমড়ো যে ডিংলি সে জানতে অর্ধেক জীবন কেটে গেল! বাঁকুড়ায় এই ডিংলিই হয়ে যায় ‘ডিংলা’ ৷ স্কুলে ছেলেরা নালিশ করতে আসত , “মেডাম , উ আমার খাতা ভালছে ” , ‘ভালছে’ অর্থ “দেখছে’ ৷ আবার , “মিস্ , পরীক্ষায় ডেট টো জানায়েন দিছে ৷” কত মিষ্টি ভাষা সব !
এবার কথার মাঝে অপভাষায় আসা যাক ৷ তা- ও ভাষাকে সমৃদ্ধ করে বৈ কি ৷ মাতালের মুখের ভাষা নিশ্চয়ই দেবভাষায় গ্রহণযোগ্য হবেনা ! কলতলায় জলের লাইনে খিস্তি খেউর সহযোগে ঝগড়াই স্বাভাবিক , রসালাপ নয় ! প্রেমিকার মুখের ভাষা আর বউএর মুখঝামটি , দুটোর শব্দচয়ন ভিন্ন ভিন্ন ৷ ‘হ্যাঁগো’ শুনছো তে যে গোপন প্রেম সে নাম ধরে ডাকার মধ্যে কোথায় পাই ? নামের পরে দা , দি লাগিয়ে তো দুনিয়ার লোককে ডাকাই হয় ! যাইহোক , আবার অপভাষায় ফিরি ৷এই অপভাষা, অপশব্দ বা গালাগাল প্রথম স্কুল থেকেই কর্ণগোচর হয় বলাই বাহুল্য ! স্কুলের দেওয়ালে কারা কখন যে এই ‘নামকরণের ‘ মহান দায়িত্ব পালন করে তা স্কুলে থাকাকালীনও জানতে পারিনি এখনও না ! যখন কথার তোড়ে মুখ ফস্কে দু একটা ‘কানে আঙুল দেওয়া’ শব্দ বেরিয়ে যায় , মা বাবা বোঝেন , ছেলে লায়েক হতে শুরু করেছে ৷ ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে অপশব্দ ব্যবহারের প্রতিযোগীতা ইদানীং একটু বেশীই যেন ! স্ল্যাং আর স্মার্টনেস সমার্থক কি এদের কাছে ? ছোট ছোট স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা একে অপরকে সম্বোধন করে ‘ এই বাঁ…’ ! শুনে কানে আঙুল অথচ তারা নির্বিকার ভাবে হেঁটে চলে যায় ৷ বাংলা ভাষায় এসেছে হিন্দি ইংরেজীর মিশেল ৷ আমরা বলি , ” তঙ্ করিস্ না তো!” …. ” দিমাগ খেয়ে দিল মাইরি !” ……” না, ইয়েসটারডে করা হয়নি, আমি এক্ষুনি মেইল টা সেন্ড করে দিচ্ছি “….এও তো বাংলাই বটে !
চলতে ফিরতে শিখি আরো কত অদ্ভুত ভাষা ৷ সে না জানলে আমি আপনি বোকা ৷ শুনলাম সেদিন বইমেলায়, ‘মাথানষ্ট দাম” ! বুঝলাম জিনিসের দাম শুনে মাথাখারাপের যোগাড় তাই মাথানষ্ট ৷ আবার ফোনে একজন আর একজনকে বলছে , ‘মেরে চামড়া বাদামী করে দেব !’ শুনে ভাবি , বাবা! মেরে বাদামী করে দেবে! এমন ধমক দিতেও তো ভাষাজ্ঞানের প্রয়োজন ৷ আজ বাড়ি ফেরার সময় শুনি পেছন থেকে কে চিৎকার করছে , ” এই কে যায় , কে যায় ! হ্যাট হ্যাট হ্যাট ” , চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি এক ভ্যানওয়ালা প্রচুর মালপত্র নিয়ে আসছে, ভ্যানের পেছনে দুজন কমবয়সী ছেলে দৌড়ুচ্ছে….সম্ভবত ভ্যানটিতে হর্ণ ছিলনা তাই এই অভিনব শব্দচয়নে সকলকে সাবধান করা !
আমরা প্রাথমিকে প্রেয়ার লাইনে শিখেছিলাম ‘খারাপ কথা বলব না ,খারাপ কথা শুনব না, খারাপ জিনিস দেখব না ৷’ সে মণ্ত্র মাথায় ঢুকে আজ ভাল ভাষা, খারাপ ভাষার লড়ালড়ি ৷ তার চেয়ে এটা জানাই ভালো , আলোর পাশে অন্ধকারের মতো ভাষার নানান রকম আছে , কু কথা না বলে কাঁকর পাথরের মতো তা আলগোছে সরিয়ে রাখলেই হলো ৷ অথবা এভাবেও ভাবা যায় খারাপ ভাষা বলে কিছু হয়না, সুশব্দেও অনেক হৃদয়বিদারক কথা বলা যায় আবার বহুদিন পরে দেখা হওয়া বন্ধুটিকে একটা গাল না দিলে আনন্দ সম্পূর্ণ হয়না যেন !
মোটের ওপর যা বোঝা গেল , সুভাষা , কুভাষা , কথ্যভাষা, লেখ্যভাষা, উপভাষা,অপভাষা যা -ই হোক না কেন বেশী কথা কখনই ভালো নয় ৷ এইযে এতক্ষণ বকবক করে পাঠকের মাথানষ্ট করার আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস, তাতে কি আমি সফল না আর একটু শুনবেন ?