এতবড়ো মাঠটায় ইতিউতি মোটে কয়েকজন। সারা মহল্লায় আর বিশেষ কেউ নেই বোধহয়! ঝুপড়ি অট্টালিকা, এলআইজি থেকে হাইরাইজ সব ফাঁকা, মহামারির দাপটে খাঁ-খাঁ। চারপাশে কেবল গা-গোলানো পচা দুর্গন্ধ। এদের নাকে ওই গন্ধটা সয়ে গেছে। এরা এখনও বেঁচে আছে। এদের কারও কোনো নাম-পদবি নেই। ‘ইগো’ও নেই।
মাঠের মধ্যে গাছতলায় গতকালও একজন মরেছে। ওরা সেই গাছতলা ছেড়ে এই গাছতলায় এসেছে। এরা কেউ কারও পূর্ব-পরিচিত নয়, কিন্তু এখন সবাই মিলে একটা বলয়ের মতো।
দমবন্ধ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় যে যা পেরেছে চালডাল মুড়ি-বিস্কুট সঙ্গে এনেছে। মিলেমিশে একটাই ভাঁড়ার। সারাদিনে একবার কোনোমতে সেদ্ধ।
বেঁচে থাকার কী প্রবল আগ্রহ ! বাঁচিয়ে রাখার আগ্রহ আরও বেশি। ওই যে শিরিষগাছের নীচে শুয়ে আছে মেয়েটি, ওর দিকে সবার বাড়তি নজর। কদিন আগে এই মাঠে এসেছে মেয়েটি।
কে কীভাবে কোথা থেকে এসেছে, কেউ জানতে চায় না। কারোরই যেন ফেলে-আসা অতীত নেই। সবাই জাস্ট ‘বেঁচে-থাকা’ মানুষ।
মেয়েটির পেটে বাচ্চা আছে, প্রসব হতে আরও মাসখানেক লাগবে। দলে আর যে-দুজন মহিলা আছে, তাদের কারোরই গর্ভধারণের মতো যৌবন নেই। এখনও কোনো বালিকা এসে জোটেনি। নেতিয়ে-পড়া একটিই বালক, দেখে মনে হয় শৈশব কাটেনি।
শাকবাছা শেষ হলে ফরসা লোকটি জিগ্যেস করল, এগুলো কুলেখাড়া তো ? ঠিক চিনেছ ?
খেঁকুরে বলল, জি। ভালো পথ্যি। পোয়াতি বল পাবে।
বাটি ফাইবার-প্লেট থালা ননস্টিক কড়াই সেগুনপাতা। গোল হয়ে খেতে বসেছে সবাই। ঢলে-পড়া বিকেল। লকলকে কচিপাতার শিরিষ আর অশথ গাছের ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। চিকন পাতাগুলিতে রোদের ঝিলিক।
মুখে গরাস তুলতে গিয়ে প্রৌঢ়া মহিলাটি আনমনে বলে ফেলল, আজ গাজনসংক্রান্তি।
আবার ! ধমক গিলে ফেলতে গিয়ে বিষম খেল উল্টোদিকে বসা মাঝবয়সী পুরুষটি।
সেই শীর্ণ বালকটির বাটিতে একটু শাকসেদ্ধ তুলে দিচ্ছিল পোয়াতি মেয়েটি। হঠাৎ ধমকে তার হাত কেঁপে উঠল, শাকটুকু পড়ে গেল মাটিতে। পাশের একটি হাত পড়ে-যাওয়া শাকের ওপরটুকু চেঁছে ছেলেটির মুখে দিল।
শাক চিবোতে চিবোতে একটু আহ্লাদ নিয়ে ছেলেটি জিগ্যেস করল, ভাই হবে, না বোন?
অমনি দুম করে একজন বলল, মেয়ে হোক, মেয়ে।
খেঁকুরে লোকটি কোঁত করে ভাতের দলাটা গিলে বলল, ভাইবোন আবার কী, অ্যাঁ? মানুষ হোক, মানুষের ছানা!