সাপ্তাহিক শিল্পকলায় “বিষাদ বিলাসী মুকুটে গণেশ পাইন” – লিখেছেন আলবার্ট অশোক (পর্ব – ৫)
বাংলা তথা ভারতের আকাশে, এক স্বতন্ত্র গরিমায় উজ্জ্বল নক্ষত্র, গণেশ পাইন।
তাকে বাংলা মনে রাখবে, অবচেতনমনের, রোমান্টিক প্রকৃতির ছবির দ্রষ্টা হিসাবে। মানুষের মনে ঘোরে যে স্বপ্ন চাপা থাকে তাকে তিনি তুলে এনেছেন ক্যানভাস ও কাগজের পটে।মূলতঃ মোটা টেম্পেরায় একজন নকশাবাজ বা মুসাবিদাকারী (draughtsman)। তার ছোট ছোট পেইন্টিংয়ে মূর্তী ও প্রতীক থাকত। তিনি আনন্দবাজার / টেলিগ্রাফ পরিবারের নির্মাণ হলেও বাংলার এক শিল্প আন্দোলন, বেঙ্গল স্কুলের শেষ মাইল ফলক। যখন তার ছবি বাংলা তথা ভারতের মধ্যগগনে বিরাজ মান, তখন কিছু মানুষ তাকে ক্লোন করে বিখ্যাত হবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল ( টাইমস অব ইন্ডিয়া মার্চ১২, ২০১৩) কিন্তু ক্লোন তো উপরের আকৃতিটা, ভেতরটা তো নয়। আর হওয়াও সম্ভব নয়।
আমাদের ছোটবেলায়, আমাদের ঠাকুরমা বা দাদুরা নানা কল্প গল্প- যেমন, রাক্ষস খোক্কস, ভূত পেত্নী, নীতিমূলক বা পৌরাণিক অনেক গল্প বলত, জানিনা আজও সেইদিন আছে কিনা। গণেশ পাইনের দিদিমা নন্দরাণী, এরকম নানা গল্প শোনাতেন যার ফলে গণেশপাইনের ছোটবেলাতেই নানা অলীক কল্পজগতের সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে গণেশ পাইন তার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা ও নানা গল্প মিশিয়ে দৃশ্যজগতের কথকের মত বাঁদরকে রাজকুমার বানিয়ে, গঙ্গাফড়িং কথা বলছে, বালক যাদুকর, ইত্যাদির ছবি বানাতেন।। বাঁদরের নাম দিয়েছিলেন, ‘বীর বাহাদুর’।মানে সমস্ত কিছুর ওস্তাদ। বাঁদরকে, রাজার পারিষদদের মত পোষাক পরানো, আবার গলায় একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা, এসব কাল্পনিক বিষয়- যা আমাদের অবচেতন মনে ধাক্কা দেয়। সাধারণ মানুষকুল তো বাঁদরের মতনই, দামী দামী জামা পোশাক পরি। কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব কোথাও বাঁধা আছে,
ফলে মুক্ত নই যা কিছু করার বা স্বাধীনতার।
আরেকটা কাজ, যেখানে তিনি একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হচ্ছে। গণেশ পাইনের ছোটবেলায় তার পৈত্রিক ভিটে বাড়ি, কবিরাজ রো র উল্টোদিকে একটা মন্দির ভাঙ্গা ছিল। মন্দিরটায় তিনি এক সুন্দরতা খোঁজে পান। মন্দিরটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, গণেশ পাইন তার কল্পনার জালকে সুন্দর করে মন্দিরটাকে মহান ভাবে উদ্ভাসিত করতে চান। যেমন the shrine নামক ছবিটি।
উপরে প্রথম ছবির নাম ‘বীর বাহাদুর’, ২য় ছবির নাম ‘দ্য শ্রাইন’
কিন্তু তিনি যাই আঁকুন, তার ছবির যে মেজাজা ও চরিত্র তা হলো, নিঃসঙ্গতা, ভাবালুতা, ও বিষাদের আবহ।
তিনি বাস্তবিক নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলেন, মিডিয়াকে পরিহার করে চলতেন, এমনকি তার প্রদর্শনীর সময়েও। তিনি সাংঘাতিক দাম্ভিকও ছিলেন, আন্তর্জাতিক নীলাম ব্যবসায়ী সোথবী ও ক্রিস্টির থেকে তার ছবি তুলে নিয়েছিলেন।বিক্রী করতে দেননি।
গণেশ পাইন, বেঙ্গল স্কুলের অবন ঠাকুর ও গগন ঠাকুরের প্রভাব পেয়েছিলেন ছোটবেলায়। এবং অতি যত্নসহকারে নকশাকারীর মত তিনি রঙ লাগাতেন। প্রথম দিকে জল রঙ করতে ভালবাসতেন।পরে গুয়াশ এবং তারপর টেম্পেরা পদ্ধতিতে। পঞ্চদশ শতাব্দীর ইউরোপের জনপ্রিয় মাধ্যম। এইভাবে তার নিজস্ব স্টাইল তৈরি হয় ও স্টাইলের সাথে সাথে ছবিতে অন্ধকার ও নেমে আসে।
বেঙ্গল স্কুল হল একটা শিল্প আন্দোলন, তখনকার দিনে এক জাতীয়তাবাদী ভাবনা থেকে সৃষ্ট, ভারতীয় ঐতিহ্যের শিকর ধরে,নান্দনিক ভাবনায়, মুঘল মিনিয়েচা্র, অজন্তা ইলোরার ঘরাণায় এবং ভারতীয় ম্যূরাল থেকে অনুপ্রাণিত, অবন ঠাকুরের নেতৃত্বে আধুনিক ভারতীয় ছবি নির্মাণের জন্য।
তার ছবিতে কঙ্কাল নেমে আসে, দেখা যায় নৌকা, আর এক ক্ষয়িষ্ণু জগত। মনে হয় কোন পৌরাণিক কাহিণীর অবতারণা।
একবার তিনি বলেছিলেন, অন্ধকার হয়ত কাউকে নিরাপত্তাহীন করে দেয়, ভয় জাগায়, কিন্তু এটারও সৌন্দর্যতা আছে, গভীর রহস্যময় এক অলৌকিক পরীর দেশে নিয়ে যায়।
এই ছায়াময় জগতে, গণেশ পাইন এক আকৃতির প্রতিকী ভাষা তৈরি করেছেন, যা মানুষের অস্তিত্ববাদের আতঙ্ক বা অবস্থা। তিনি যে আলো ছায়ার জগত তৈরি করেছেন তাতে এক অদ্ভুত আলো তার ছবির চরিত্রগুলিতে পড়ে, তাতে এক মায়াজাল বিস্তৃত হয়, এক রহস্যের চাদরে ঢাকা থাকে অনেক গভীর কৌতূহলের কথা।
গণেশ পাইন উত্তর কোলকাতার কবিরাজ রো তে জন্মগ্রহন করেন ১৯৩৭ সালের ১১ই জুন।চার বছর বয়েসে সিটি কলজিয়েট স্কুলে (City Collegiate School ) ইনফ্যান্ট ক্লাশে ভর্তি হন।সেখান থেকেই মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করেন। তার ছোট বেলায় শিশু পত্রিকা মৌচাকে অবন ঠাকুরের ড্রয়িং দেখে উদবুদ্ধ হন। কালো স্লেটে খড়ি দিয়ে সেই ছবি মন দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আঁকতেন। ১৯৪৬ সালে তার বাবা মারা যান, ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা, ইত্যাদি তার মনে দাগ কাটে। তখন তার বয়েস ৯ বছর। দাঙ্গায় গণেশ পাইনদের পৈত্রিক ভিটে উৎখাত হয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছিল। সেই সময় শহরে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে দাঙ্গার অনেক মৃতদেহের স্তুপ দেখেন। একটা স্তুপের উপরে এক মহিলার নগ্ন শরীর ছিল, তার স্তনে আঘাতের চিহ্ন,ইত্যাদি। সেই ভঙ্কর দৃশ্য তাকে সারা জীবন তারিয়ে গেছে। তিনি মৃত্যুর ছবি আঁকার রসদ পান।
১৯৫২ সালে, ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে , অবন ঠাকুরের এক বড় প্রদর্শনী হয়, গণেশ পাইনের তখন বয়েস ১৫, তিনি সে প্রদর্শনী দেখে ভীষণ অনুপ্রাণিত হন। গণেশ পাইনের জীবনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ছাড়াও রেমবান্ড ও পল ক্লের (Rembrandt and Paul Klee. ) প্রভাব ছিল।
তিনি স্থির করেন, তিনি বড় হয়ে ছবি আঁকবেন। বাদ সাধল বাড়ীর লোকেরা। তারা চান গণেশ, অন্য কোন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করে চাকরি করুক। বাড়ির উপর তিনি খুব রেগে যান, শেষে তার কাকা, মনোহর পাইন, গভর্ণমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দেন। গণেশ পাইন আর্ট কলেজে ওয়েস্টার্ন আর্ট নিয়ে পড়াশুনা করেন, যদিও ওরিয়েন্টাল আর্টের প্রতি তার অনুরাগ ছিল। ১৯৫৫ সালে , তখন তিনি জলরংগে ছবি আঁকতেন, তিনি ‘Winter’s Morning’ নামে একটি সুন্দর জলরঙ্গের ছবি আঁকেন। সেটিতে অবন ঠাকুরের পরিষ্কার ছাপ ছিল। ছবিটা এত সুন্দর হয়েছিল তখনই বোঝা গেছিল, গণেশ পাইনের দক্ষতা ও তার ভবিষ্যত। পেইন্টিং হিসাবে এটাই ছিল গণেশ পাইনের প্রথম পেইন্টিং। ১৯৫৯ সালে, তিনি গভর্ণমেন্ট আর্ট কলেজ এন্ড ক্রাফট থেকে ডিপ্লোমা নিয়ে স্নাতক হন। এরপর কিছুদিন তিনি বিজ্ঞাপন জগতে অ্যানিমেশনের স্কেচ করেন পেশার জন্য। ১৯৬০ সাল থেকে তিনি বইয়ের অলঙ্কারিক হিসাবে কাজ শুরু করেন। সেইসময় তার আর্থিক অবস্থা এত খারাপ ছিল তিনি রঙ কেনার পয়সাও পেতেননা। ফলে কালি কলমে স্কেচ জাতীয় ছবি আঁকতেন। ১৯৬৩ সালে সোসাইটি অব কন্টেমপোরারি আর্টিস্টস’ গ্রুপে যোগদান করেন। সেখানে শ্যামল দত্ত রায়, বিকাশ ভট্টাচার্য,ধর্মনারায়ন দাশ গুপ্ত ও গণেশ হালুই প্রমুখ সেই গ্রুপের সদস্য ছিলেন। Paris Biennale in 1969 তে তিনি অংশ নেন, এছাড়াও উত্তর আমেরিকায় এবং ইউরোপে তার অনেক প্রদর্শনী হয়েছে।
গণেশ পাইন আজীবন অন্তর্মূখী ও লাজুক স্বভাবের। একবার গ্রুপে তার প্রদর্শনী হয়েছিল, সেই প্রদর্শনীতে প্রধান মন্ত্রী জহরলাল নেহেরু এসেছিলেন। তিনি গণেশ পাইনের ছবি মন দিয়ে দেখছিলেন, লেডি রাণূ মুখার্জী দেখলেন গণেশ পাইন আড়ালে লুকাচ্ছে, তিনি গণেশ পাইনকে ডেকে জহরলালের সাথে পরিচয় করে দেন। জহরলাল তার সাথে করমর্দন করেন। এবং ছবি সম্পর্কে কিছু সাহস যুগিয়ে গণেশের ছবি প্রশংসা করে যান। সেই ছবি প্রথম পুরস্কার পেল।
গণেশ পাইন খুব কবিতা পড়তেন পাঠ করতেন। তিনি কবি ও শিল্পীদের একটা সেতু রচনা করেছিলেন।
ছবি এঁকে রোজগার করা খুব কঠিন। গণেশ পাইন বেশ কিছু কর্মখালিতে চাকরির আবেদন করেন। দুঃখের বিষয় কোথাও তার চাকরি হয়নি। শেষে Kesoram Cotton Mills এর ডিজাইনার পদ চেয়ে দরখাস্ত করেন, ইন্টার ভিঊ দিতে গিয়ে শুনেন তাদের বড় কোন শিল্পীর দরকার নেই। ভগ্ন মনোরথে বাড়ি ফিরছেন, হঠাৎ দেখেন একটি ভিখারী প্রায় বাচ্চা ছেলে একটা ঠোঙায় কিছু খাবার নিয়ে যাচ্ছে। সে ঠোংগা/প্যাকেট টা এমন করে ধরেছে যাতে তার এই খাবারটা যাতে না পড়ে যায় মাটিতে। এই ঘটনাটা গণেশ পাইনের জীবনের দর্শন পালটে দেয়। তিনি ভাবলেন তার কাছে যেই মূল্যবান বস্তু আছে, শিল্প, তাকে আঁকড়েই তিনি বাঁচবেন। তার আর চাকরির দরকার নেই। এরপর তিনি আর কোনদিন চাকরির দরখাস্ত লেখেন নি।
গণেশ পাইন খুব একটা প্রদর্শনী করতে পছন্দ করতেননা। গ্রুপে দুটো তিনটে ছবি দিতেন ও ছবির উপর নিরাপত্তা পেতেননা। কেননা ছবি তেমন বিক্রী হয়না। ছবি এঁকে রোজগার করা ঝুঁকি পূর্ণ।
তিনি প্রথম একক প্রদর্শনী করেন ১৯৯০ সালে। গোটা ৭ কিংবা ৮ টি একক প্রদর্শনী করেছিলেন, তার মধ্যে বড় করে করা ১৯৯৮ সালে সিমা আর্ট গ্যালারীতে (‘Ganesh Pyne : A Retrospective 1952-1998’, Centre for International Modern Art (CIMA), Kolkata )।
জীবনের শেষ দিকে তিনি মহাভারতের চরিত্রের উপর কিছু ছবি আঁকেন।
জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেনঃ • 2004 Abainindra Purashkar, Government of West Bengal • 2003 D. Lit (Honoris Causa), Kalyani University
-
1997 Gagan Abani Puroskar, Visva Bharati • 1985 Shiromani Puroskar, Asian Paints, Kolkata • 1978 Artist of the Year, Sangeet Shyamala, Kolkata • 1973 Academy of Fine Arts, Kolkata • 1957 Academy of Fine Arts, Kolkata • 1956 Calcutta Art Society, Kolkata • 1955 Government College of Arts and Craft, Kolkata এবং Raja Ravi Varma award by the Government of Kerala, and in 2011, the lifetime achievement award by the Indian Chamber of Commerce