সাপ্তাহিক শিল্পকলায় “আর্ট ব্রাটঃ একটা শিল্প দর্শন” – লিখেছেন আলবার্ট অশোক (পর্ব – ৬))
আর্ট ব্রাট কি? আর্ট মানে আপনারা জানেন, ব্রাট মানে ফরাসী শব্দ, যাকে বলা হয় অপরিশোধিত বা কাঁচা বা টাটকা। এই বিষয়টা বুঝতে গেলে আপনি নীচের ছবি গুলি দেখুন।
Alentour la maison, painted in June 1957. Oil on canvas. 35⅛ x 45⅝ in (89 x 116 cm). Sold for: £1,271,250 on 12 February 2020 at Christie’s in London
Panorama, executed on 20 January 1978. Acrylic and collage on paper mounted on canvas. 82¾ x 111⅝ in (210.2 x 283.4 cm). Sold for: £2,171,250 on 12 February 2020 at Christie’s in London
আমি অনেকদিন থেকেই বলছি, আমার গুরুজনদের কথা। দীক্ষিত হওয়া।
দীক্ষিত মানে কি? দীক্ষিত মানে আমরা সাধারণত বুঝি আত্মিক মাধ্যম, ঐশ্বরিক বিষয়ে কোন বিশেষ শিক্ষক বা গুরুর দেওয়া পথে চলা। এটা বিশেষ বিষয় ও বিশেষ মানুষ জড়িত। শিল্প সংস্কৃতি সবাই বুঝেনা। সবাই আগ্রহীও নয়। কেউ কেউ বুঝে, ও তার জন্য উন্মাদের মত প্রায় থাকে। শিল্প সংস্কৃতিতে উন্নতি লাভের জন্য বিশেষ শিক্ষক বা গুরুর অধীনে কম করেও এক যুগ কাল ছায়ার মত কাটালে উন্নতি আসে।একজন গুরুর অধীনেই বা একাধিক গুরুর অধীনে। শিল্প সংস্কৃতি হল কোন উন্নতস্তরে সামাজিক বস্তু সুন্দর বা সংস্কার করে নির্মাণ করা। এটা একটা সৃষ্টি শীল কাজ। মানে আগে এমন ছিলনা, কেউ এমন করে সমাজকে দেখিয়ে দিল। এই কাজ করতে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞানের যথেষ্ট দরকার। দরকার দক্ষতা, ও নানা উপাদানের যোগান। অনেকটা রহস্যময় ও যাদুকরের যাদুর মত। মানুষকে মোহিত ও মুগ্ধ করে তুলে।
শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতি অনেকেই পছন্দ করেনা। কারণ মানুষের রুটি রোজগারের পর তার আর সময় থাকেনা, বছরে একদিন শিল্প সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক কোন কাজে নিজেকে বিলাসিতা দিতে। শুধু নিম্ন বিত্তই নয়, একদম উচ্চবিত্ত লোকেদের মধ্যেও দেখা যায় তাদের সময় নেই কোন সাহিত্য পড়ার, বা কোন নাটক দেখার। তারা আগ্রহীও নয়।
তো কেউ আবার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির জন্য জীবনের সমস্ত কিছু ত্যাগ স্বীকার করে ভিখারী হয়ে যায়। এসব থেকে বোঝা যায়, শিল্প সাহিত্য কারু কারুর সহ্য হয়না , কারু কারুর কাছে প্রাণবায়ু। মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে ভাবুক ও (সামাজিক) অলস ব্যক্তিরাই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে আসে।
বর্তমান দিনকাল এমন সমস্ত কিছুরই পণ্যে পরিবর্তন সম্ভব , ফলে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি একদল পণ্যে উৎপাদন করতে পারে বলে তারা পেশা করে জীবিকা অর্জন করে। যেমন আপনি যদি ভাল ড্রয়িং করতে পারেন, কোন অ্যানিমেশান কোম্পানী, যারা অ্যানিমেশান ফিল্ম বানায়, বিজ্ঞাপন এজেন্সী, এসবে চাকরি করে অনেক টাকা রোজগার করতে পারেন। মাইনে তো কম নয় , মাসে লাখটাকাও আপনার হতে পারে। ফলে অনেকেই আর্ট কলেজে পরে চাকরি করতে চলে যায়। অনেকে নাটক মঞ্চস্থ করেন, যত দর্শক হবে তার তত লাভ হবে। মূলতঃ মানুষকে মনোরঞ্জনের মাধ্যমে আপনি টাকা আয় বা উপার্জন করছেন। সমাজে সম্মান পাচ্ছেন। শিল্পী সাহিত্যিক বলে খাতির পাচ্ছেন। সিনেমায় অভিনয় করলে অনেকেই ভাল টাকা রোজগার করেন। কিন্তু এগুলিতে আপনার অবদান বা সৃষ্টি কিছুই নেই। ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ারদের মত কিছু গৎবাঁধা কাজ। যেকেউ পড়াশুনা ও ট্রেনিং নিয়ে এসব অনায়াসেই করতে পারে।
শিল্প সাহিত্য অ সংস্কৃতির মধ্যে দুটি ধারা আছে, একটা হল ফলিত বিদ্যা (applied Arts) আরেকটা হল সৃজন ধারা (Creative Arts) ফলিত বিদ্যা হল যে ধারাটা চলছে বর্তমানে, সেটাকেই নাড়িয়ে চাড়িয়ে আপনি কিছু করলেন কেননা এটা বিক্রী যোগ্য, আর বিক্রী হবে বা টাকা পাওয়া যাবে বলেই করেছেন। এতে আপনার নিজস্ব ভাবনা মৌলিকতা নেই। যেমন মধুবনী পট। ক্যানভাসে শহরে শিল্পীদের দেবদেবী বুদ্ধ, দৃশ্যচিত্র ইত্যাদি একই রকম হাজার হাজার শিল্পীর তৈরি পাবেন। এগুলি বিত্তশালী লোকেরা ঘর সাজাবে বলে কিনে নিয়ে যায়। এগুলি আপনার থেকে কোন সংগ্রাহক বা মিউজিয়াম কোনদিন কিনবেনা। এগুলি তে নতুনত্ব কিছুই নেই।
নতনত্বের সন্ধানে আপনাকে দীক্ষিত হতে হবে। দীক্ষিত হলে আপনার মর্জি মতে চললে হবেনা। কোন ভাবনাকে দৃশ্যায়ত করতে গিয়ে আপনার অনেক ক্ষতি স্বীকার বা অনিশ্চিত ভবিষৎ মেনে চলতে হবে। আপনি যা ভাবছেন একেবারে দুর্দান্ত ভাবনা, তা লোকের কাছে একপয়সাও দাম না হতে পারে। এবং সত্যিই হয়ত তা কোনদিন কাজে আসলনা। কিন্তু আপনার ভাবনার তৈরি জিনিস আপনার সন্তানের মত আশা নিয়ে বড় করে তোলা, একমাত্র দীক্ষিতদের কাছেই সম্ভব।
যারা তান্ত্রিক, তন্ত্র সাধনা করে, যন্ত্র সাধনা করে, তারা এক চর্চার মাধ্যমে তাদের লক্ষ্যে পৌছায় আপনি সেই অভিষ্টলক্ষ্যে পৌছাতে পারবেননা যদি না আপনি দীক্ষিত হয়ে থাকেন অ চর্চা বা সাধনা অবিরাম করে যান। আপনি আপনার মল আপনার মুখে তুলতে পারবেননা, নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া একটি মৃত দেহের গলিত শরীর খেতে পারবেননা। আপনি একজন রমণীর সাথে লগ্ন হয়ে দীর্ঘক্ষণ শান্তভাবে কাল কাটাতে পারবেননা। কিন্তু যারা সাধক তারা পারেন। যেমন সাধক ত্রৈলঙ্গ স্বামী করতেন। সাধারণ সুস্থ মানুষ তাদের অসুস্থ বলে অভিহিত করেন। এখন কথা হল কে অসুস্থ বা কে সুস্থ? সুস্থ অসুস্থ তো আপেক্ষিক কথা। এর কোন মানে স্থা, কাল , পাত্র হিসাবে সমাজ স্থির করে। তান্ত্রিক সমাজ বলে সাধারণ মানুষ অসুস্থ, তাদের কল্যাণ আনতে তারা এই সাধনা করেন। আবার সাধারণ মানুষ বলবেন, তান্ত্রিকরা অসুস্থ মস্তিষ্কের।
সাধারণ মানুষ, যারা তান্ত্রিক হতে আগ্রহী, তারা দীক্ষা নেয় গুরুর কাছে, এবং আজীবন গুরুকে শিরোধার্য করে চলে।ফলে তারা যা পারে আপনি তা দীক্ষিত না হয়ে পারবেননা।
ধরুন, বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাশোর কথা।
পিকাশোর ছবি সাধারণ লোকের কাছে কোন মূল্য আছে? নেই। একজন রিক্সা ওয়ালা , বা মুদী ওয়ালা তার ঘরে এর প্রিন্ট, কেই বিনা পয়সায় দিলেও রাখবেনা। তাকে যদি একটা দূর্গা, বা গণেশ বা রাধাকৃষ্ণের ছবি দেওয়া হয়, তিনি ভক্তি ভরে দুবেলা পূজা দেবেন, আর অনেক খুশী হবেন।
সবাই সব কিছু বুঝেনা, বা দরকারও নেই। পিকাশোর ছবি বোঝার জন্য বা ভালবাসার জন্য তেমন শিক্ষিত রুচী চাই। বা তেমন কিছু আঁকতে হলে দীক্ষিত হওয়া চাই। যারা দীক্ষিত নন তারা অন্য সম্প্রদায়।
আপনি একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর গবেষণা, বা কোন জীববিজ্ঞানীর বিবর্তনের সমীকরণ বললে আপনি বুঝবেননা। বা কোন অর্থনীতির কোন অংক, আপনি পারবেননা। না পারলেও ক্ষতি নেই। কেননা যারা পারে, তা কেবল তাদের জন্যেই। আপনি আগ্রহী হলে আপনাকে দীক্ষিত হতে হবে, তবেই আপনি বুঝবেন।
এত কথা বলার উদ্দ্যেশ্য হল আজকের ছবি নিয়ে বলতে এসেছি, তাকে অনেকেই বুঝবেননা। বা ভাল লাগবেনা। কিন্তু তিনিও বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী। ফলে যারা আর্ট নিয়ে পড়াশুনা করেন, কেবল তারাই আজকের গল্প গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবেন।
জাঁ ফিলিপ আর্থার ডুবেফে, একজন ফরাসী পেইন্টার ও ভাস্কর। জন্ম ১৯০১ সালে মারা যান ১৯৮৫ সালে। জীবদ্দশায় ফ্রান্সে ও আমেরিকায় তিনি খ্যাতি পান। ইউরোপের শিল্প জগতে তার একটা অবদান আছে। অবদানটির জন্য তিনি শিল্প রসিকদের কাছে বেঁচে আছেন। পেইন্টিং অ্যানাটমিক্যালি কারেক্ট, বা সুন্দর ছবি আঁকার একটা পরাম্পরা ছিল, যারা ছবির ইতিহাস পড়েছেন , জানেন। কিন্তু সেগুলিতে আপনি বাস্তবের ছোঁয়া পান? বড় বড় ল্যান্ডস্কেপ, বিশাল ক্যানভাসে, কি উলংগ মডেল ডিভানে শুয়ে আছে, কনেস্টেবল, দেলাক্রোয়া, ডুরার, মাইকেল এঞ্জেলো। সবই সুন্দর নির্মান ও শিল্পের নমূনা। কিন্তু সবই মৃতবৎ। আপনি ছবির মতন দেখেন। আপনার বাস্তব জীবনের, প্রতিদিনকার বস্তু তারা নয়। ঠিক কিনা, বলুন? ওগুলো ওই মিউজিয়ামেই শোভা পায়, কিংবা রাজা জমিদারের বাড়িতে । শিল্পীরা জীবনের সাথে সম্পৃক্ত কি আছে তার অনুসন্ধান করেছেন। এমন একজন শিল্পী ডুবেফে। বলা বাহুল্য তার ছবিও মিউজিয়ামে এখন দর্শকের ভাবনাকে উত্তেজিত করছে। আগেরগুলি চোখকে খুশী করত পরের ছবি ভাবনাকে নাড়াতে শুরু করল। ডুবেফে বললেন, ছবি হবে কাঁচা ছবি “low art”
১৮ বছর বয়সে প্যারিসে এসে বিখ্যাত আর্ট স্কুলে Académie Julian ভর্তি হন। তাদের পারিবারিক মদের ব্যবসা ছিল। ধরে নিন পয়সাওয়ালা ঘরের। আর্ট স্কুলের পড়াশুনায় তার মনে হল এসব রুচীতে লাগছেনা। ছয়মাস পরে পড়াশুনা ছেড়ে চলে গেলেন।ওই সময় গান বাজনা কবিতা এসবও আসক্ত হলেন কোনটাই মনে শান্তি দিচ্ছিলনা। ইতালী ব্রাজিল প্রভৃতি দেশও ঘুরলেন। ১৯৩৪ সালে আবার আঁকতে এলেন। তিনি কিন্তু খারাপ আঁকতেননা। কারন ২১ বছরে একটি আঁকা আমরা দেখি মাদাম আর্থার ডুবেফে Mme Arthur Dubuffet. 1921।
বা নিজে নিজে ২৪ বছরে যে ছবি এঁকেছেন Trois personnages dans un paysage de montagne ৩৪ বছর বয়সে অনেক পোর্ট্রেট আঁকেন। তার ব্যবসা দেখে সময় বার করে ছবি আঁকা। তিনি ছবি এঁকে রোজগার করেননি। করতে হয়নি। ৪০ বছরের কাছে গিয়ে তিনি ছবিতে একটু মন দেন। ৪৩ বছর বয়সে প্রথম তিনি আত্মপ্রকাশ করেন ছবি নিয়ে।1944, at the Galerie Rene Drouin in Paris শিল্পী হওয়ার এটা
তার ৩নং প্রচেষ্টা। পরের বছর প্যারিসে তিনি জাঁ ফট্রিয়ের Jean Fautrier’s paintings কিছু ছবি দেখে উদ্বুদ্ধ হন, যে তিনি তার মত ছবি আঁকবেন। তার মনে হয়েছে তিনি জীবনের কাছে এসে ছবি আঁকছেন।
Mme Arthur Dubuffet. 1921
Trois personnages dans un paysage de montagne [1924 – 1925] Huile sur toile 90 x 67,8 cm