একটা পাতলা কুয়াশার পর্দা আমার চোখের সামনে কাঁপতে কাঁপতে দুলছে…. একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে….যেন একটা আবছা আলোআঁধারির খেলা খেলছে আমার সঙ্গে…..বলছে…আয় তো দেখি আমার কাছে…দেখ্ তো…. কিছু দেখতে পাচ্ছিস কি না….
দেখতে পাচ্ছি আমি….সময়ের ওপার থেকে… দেখতে পাচ্ছি….একটা ছোট্ট মেয়েকে….ঐ তো….
মেয়েটার মধ্যে কোন মন্ত্রবলে আজকের আমি ঢুকে পড়েছি….নাকি ঐ ছোট্ট মেয়েটাই আমার বুকের মধ্যে সবসময় থাকে…আজ সুযোগ বুঝে বেরিয়ে এসেছে…
একটা হাল্কা পিংক কালারের স্লিভলেস পার্টিফ্রক পরা…. চোখদুটোর তলায় জলের দাগ এখনো মিলিয়ে যায়নি… একটু শুকিয়ে গেছে মাত্র….সদ্য ঘুম ভাঙা কিন্তু ঘুমে ভরা চোখ দুটো কে হাতের পিছনটা দিয়ে ডলে ডলে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করছে…বুকে জড়িয়ে রাখা একটা সদ্য পাওয়া উপহার…..দিম্মার দেওয়া একটা টেডিবিয়ার…
ওহহ্……আজ তো পুচকি টার পাঁচ বছরের বার্থডে ছিল…. উপহার পেয়েছে অনেক…. কিন্তু সেগুলো একটাও খোলেনি সে…. হাজার বার বোঝানো সত্ত্বেও কেক টাও কাটেনি কিছুতেই… এমনিতে দিম্মার সব কথা শুনলেও আজ এই কথাটা সে কিছুতেই শোনেনি… শুধু তাই নয়… ঘরভর্তি তার পছন্দের খাবার থাকা সত্ত্বেও দিম্মা হাজার চেষ্টা করেও একটা টুকরো ও তাকে খাওয়াতে পারে নি।
সন্ধে থেকে সব গেস্টদের সামনে সে সমানে একটাই কথা বলে গেছে…” মামমাম্ আসবে , আমার সাথে কেক কাটবে, ডিনার করবে বলেছে “… ফলস্বরূপ তিনপাউন্ডের রেড ভেলভেট বার্বি কেকটা এখনো না কাটা অবস্থায় টেবিলের উপর শোভা পাচ্ছে…
কাঁদতে কাঁদতেই….মামমাম্ কেন আসছে না…মামমাম্ কে ডাকো…করতে করতেই ,ড্রেস চেন্জ না করেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল…. কিন্তু খালি পেটের ঠুনকো ঘুম…. প্রত্যাশার ঘুম… প্রত্যাশিত গলার আওয়াজে ই ভেঙে গেছে….
বাই হনি……ব্ বাই লীনি ডার্লিং….সি ইয়াহ্ টুমরো…মুউউউআআহ্ …..তার সঙ্গে গাড়ির চলে যাওয়ার অস্পষ্ট আওয়াজেই ঘুম ভেঙে গেছে আমার….আর লন্ডনের এই ভয়ঙ্কর ঠান্ডায়ও, খালি পায়ে কোনো গরমজামা গায়ে না দিয়েই ডুভেটের তলা থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছি আমি…
এখন কটা বাজে…কত রাত… সেটা একটা পাঁচ বছরের মেয়ের পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়…. বিশেষ করে যে বাচ্ছাটার সমস্ত মন জুড়ে শুধু একজনের ই অপেক্ষা….সেই প্রিয় গলার আওয়াজ টাই তাকে এক অমোঘ আকর্ষণে টেনে নিয়ে এসেছে সেই আওয়াজের উৎস…যেটা কিনা ড্রয়িংরূম ….সেই দিকে… আর… সেখানে ঢোকার আগেই বাসনকোসন পড়ে ভেঙে যাওয়ার মতো ঝনঝনে্ সেই গলার আওয়াজ তাকে থামিয়ে দিয়েছে….তার গাট্ ফিলিং তাকে বলে দিয়েছে…এখন ওখানে তোমার যেতে নেই… কিন্তু পাদুটো কথা শুনছে কই…. সে দুটো তো ওখানেই আটকে গেছে…আর চোখ দুটোও….
“কেন??? কেন?? কেন তোমার কথা আমাকে শুনে চলতে হবে সারাক্ষণ?? আমার নিজের কোনো লাইফ নেই ?? যত্তসব রাবিশের জন্য আমার নিজের দরকারি কাজ আমাকে স্যাক্রিফাইস করতে হবে কেন??”
“গলা নামিয়ে কথা বলো দেবী…সার্সী অনেক কষ্টে ঘুমিয়েছে “…..দিম্মার এরকম হিমশীতল কঠিন গলার স্বর আমি কখনো শুনিনি এর আগে….সেই স্বরের কাঠিন্য আমাকে যেন ঠান্ডার থেকেও বেশি কাঁপিয়ে দিল….
” তোমার লজ্জা করে না?? নিজের প্রতি ঘৃণা হয় না?? কি চেয়েছিল মেয়ে টা?? জন্মদিনে নিজের মা’র সাথে একটু সময় কাটাতে চেয়েছিল… মা’র সাথে কেক কাটা টা সেলিব্রেট করতে চেয়েছিল….শুধু এই টুকু….আর তুমি ? তুমি এটুকু ও তাকে দিতে পারলে না!!!…. তোমার জন্য আজকের দিনটাতে মেয়েটাকে না খেয়ে, কেঁদে ঘুমিয়ে পড়তে হলো…বেচারী কেকটাও কাটতে পারলো না… ছিঃ….তোমায় তো কোনোদিন ওর কোনো দায়িত্ব নিতে হয়নি… আজকের দিনটা তে খানিকটা সময় ও তুমি ওকে দিতে পারলে না??? কেমন মা তুমি??!!!”
” মা মা মা… উফ্ ডিসগাস্টিং…শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল…..দেখো মাম্মি…একটা কথা তোমাকে বহুবার বলেছি… আবার বলছি… আমি ঐ মেয়েকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করি না…ওকে দেখলে আমার মাতৃত্ব জাগে না… কোনো ভালোবাসা আসে না…কোনোদিন সেই অনূভূতি আমার হয় নি… তো আমি কি করবো?? নাটক করবো?? মাদারহুডের??”
বিদ্রূপে সুন্দর লিপস্টিক রাঙানো ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল দেবলীনা বসুমল্লিকের
” কিন্তু কেন??”..দিম্মার গলার স্বর হতাশ শোনালো…
” দেবী…তুই কোনোদিন মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস?? ওর তোর সাথে কতটা মিল?? ও তোকে কতটা ভালোবাসে!!! তোকে ঘিরে ঘিরে ও ঘুরে বেড়ায়… তুই তাহলে ওকে আজ প্রমিস করেছিলি কেন যে আজ ওর সাথে ওর জন্মদিন টা সেলিব্রেট করবি ? তোর বিন্দুমাত্র রেসপনসিবিলিটি নেই ?? জন্মদিনের দিন বাচ্ছাটা না খেয়ে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়লো তোর জন্য !!!”
” আমি কি ওটাকে গিলতে বারণ করেছিলাম??গিলে গিলে মরুক না… হ্যাঁ আমি বলেছিলাম…কারণ আপদ টা আমার পিছন পিছন ঘুরঘুর করছিল ,ঘ্যানঘ্যান করছিল তাই…ওর পিছন ছাড়ানোর জন্য বলতে বাধ্য হয়েছিলাম ”
দেবলীনা বসুমল্লিকের প্রতিটা কথা থেকে ঝরে পড়া ঘৃণা তীরের মতো গিয়ে আমার ভিতরে বিঁধে যাচ্ছিল… আর আমি প্রতিটা উচ্চারিত শব্দের সাথে একটু একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছিলাম…
“ওটাকে জন্মই তো দিতে চাইনি আমি….এই তুমি.. তুমি আমায় বাধ্য করেছিলে…. তুমি বলো নি? সব দায়িত্ব তুমি নেবে??? তোমার জন্য….শুধু তোমার জন্য আমার এমন প্রমিসিং মডেলিং কেরিয়ার কে বাজি রেখে ঐ আপদ টাকে জন্ম দিতে হয়েছিল আমায়….তাহলে আজ আমার থেকে এক্সপেক্ট করছো কেন যে আমি একেবারে ওটার আদর্শ মা হয়ে উঠবো…?”
“আদর্শ মা হতে বলছি না তোকে… কিন্তু সামান্য মানবিকতা বোধ ও কি থাকতে নেই… আজকের দিনটা ওর সাথে কাটালে কি এমন ক্ষতি হোতো তোর?? রোজ ই তো যা খুশি করিস…আজকে অন্ততঃ এই রাত তিনটের সময় এভাবে ড্রিংক করে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে বাড়ি না ফিরলেই কি চলছিল না??”
” না চলছিলো না… আমি চাইনি ফিরতে….আই হেট দ্যাট লিটল্ বিচ্…ওটার জন্য আমি কেন আমার প্রোগ্রাম আপসেট করতে যাবো??..পেটে তো মেরে ফেলতে দাও নি…জন্মাবার পরও যখন বলেছিলাম ফস্টার হোমে দিয়ে দিতে…এই তুমি… তুমিই আমাকে দিতে দাও নি…বলেছিলে ও নাকি তোমার… তুমিই ওর সব দায়িত্ব নেবে…তাহলে আজ কেন আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছো?? সব বুঝি আমি… তুমি আসলে ওই আপদটাকে সারাক্ষণ আমার সামনে রেখে দিয়ে আমাকে জব্দ করতে চাও… আমি বাপি বা তোমার প্রফেশন নিইনি বলেই আমার উপর এত রাগ তোমার…”.. দেবলীনা বসুমল্লিক নিজের হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নিজের নাক আর জ্বলতে থাকা চোখ দুটো একবার মুছে নিল….
( আর ঐ অবস্থায় ও আমার মনে হোলো আমার মামমাম্…. আমার মামমাম্ কে কি সুন্দর দেখতে…)
” তবে আর না… যথেষ্ট হয়েছে…আজ থেকে ছ’বছর আগে যা আমি করতে পারিনি আজ আমি সেটাই করবো…ওই অভিশাপ টাকে আমার লাইফ থেকে আজ চিরদিনের মতো সরিয়ে দেবো… ও মরুক মরুক মরুক ” বলতে বলতেই কেকের পাশে রাখা ছুরি টা তুলে নিয়ে দেবলীনা বসুমল্লিক নিমেষে আমার দিকে তেড়ে আসতে গেল….কয়েক মূহুর্ত মাত্র…তার পরই একটা বিকট আওয়াজ …দিম্মার হাত টা দেবলীনা বসুমল্লিকের গালে এত জোরে আছড়ে পরেছে যে টাল সামলাতে না পেরে কেক আর টেবিল সমেত দেবলীনা বসুমল্লিক হুড়মুড়িয়ে ছিটকে পড়েছে…
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না… চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম…আর দিম্মার চোখ আমার দিকে পড়লো…নিমেষে দৌড়ে এসে দিম্মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো…” ওলে আমার সোনা টা…ঘুমু ভেঙে গেছে…খিদে পেয়েছে সোনা মা আমার…চলো মা আমি তোমাকে কত্তো ভালো ভালো খাবার… তুমি তো খেলেই না মা গো… একটুখানি খাইয়ে দিই..চলো তো এখান থেকে আমার সোনা সার্সী…”
বলতে বলতে দিম্মা একবারও পড়ে থাকা দেবলীনা বসুমল্লিকের দিকে ফিরে না তাকিয়ে পিছন ফিরে আমাকে নিয়ে ঘরের দিকে এগোতে লাগলো…..আর দিম্মার কাঁধে মুখ গুঁজে যেতে যেতে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম…গাল চেপে বসে থাকা দেবলীনা বসুমল্লিক…..না না মামমাম্ কিভাবে আগুন ঝরা দৃষ্টিতে আমার দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে রয়েছে………
ক্রিং ক্রিং ক্রিং…..আ্যালার্মের আওয়াজ আমার চেতনা ভেদ করে আমার সুপ্তি কে জাগিয়ে তুললো…. আমি ধড়মড়িয়ে বিছানার উপর উঠে বসলাম….এখনও যেন আমার সামনে সেই আগুন ঝরা… ঘৃণা ভরা টানা টানা সুন্দর চোখ দুটো ভাসছে…. যে দুটো চিরকাল আমার অস্তিত্ব কে আচ্ছন্ন করে রেখেছে…আর আমার ভিতরে কে যেন সমানে বলে চলেছে ….ও মরুক মরুক মরুক….
অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল টা মুছে নিলাম… আর হাজার বার নিজেকে করা প্রমিস টাই আবার একবার করলাম….নাঃ এসব আমি ভাববো না…কিছুতেই না….
আজ আমি দিম্মার কাছে যাবো…কিইইই মজা… আমি খুব খুব ভালো আছি…
ভালো থাকবো…থাকবোই।