সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব – ১০)

স্রোতের কথা
পর্ব ১০
[আমি আর আমার আশ্চর্য রা]
মোবাইল টা এই নিয়ে ছ থেকে সাতবার বাজলো… কিন্তু আমি ধরতে পারছি না কিছুতেই…… আমি জানি দিম্মা ভীষন ভীষন উদ্বেগে আছে… নাহলে সব সময় অন্যের প্রিভেসি কে সম্মান করে চলা দিম্মা পরপর এতবার ফোন করার মানুষ ই না… কিন্তু এই মানুষ টার কাছে আমি তো কিচ্ছু লুকিয়ে রাখতে পারবো না।…. যে আমার চোখের পাতার নড়াচড়া দেখেই আমার মনের কথা সঅঅব বুঝে যায়…সে যদি বুঝতে পারে যে…. তার প্রাণের সার্সী আসলে একটা রক্তলোলুপ ভ্যাম্পায়ার….. যে হয়তো সুযোগ পেলে… তার দিম্মার ও….. ওঃ ভগবান….
দেবলীনা বসুমল্লিক ঠিকই বলেছিল….আমাকে হয়তো জন্মের পর ই… বহুদিন পরে দেবলীনা বসুমল্লিকের কথা মনে হতে আমার চোখ টা কড়কড়্ করে উঠলো….। মানুষের আর কেউ না থাকুক অন্ততঃ মা থাকে… আমার বন্ধু দের তো দেখেছি কোনো সমস্যা হলেই “মা” … আর আমার ???? নাঃ আমি কিছুতেই দেবলীনা বসুমল্লিকের কথা ভেবে দুর্বল হবো না… কিছুতেই না…
অবশ্য আমার দিম্মা আমার মা বাবা দুটোই…, তবুও আমার সব বোঝা ই তা বলে সারাজীবন দিম্মা ই বয়ে বেড়াবে…. এটা কেমন কথা !!!
আমার সাথে যে কি কি অদ্ভুত সব ব্যাপার হয়ে চলেছে… সেটা আমি কিভাবে দিম্মাকে বলি !! মিরান্ডা ম্যাম ,প্রফেসর হাসান ,আমার কান্ডকারখানা , আর শৌনক… আবার একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা টা…. সব মিলিয়ে আমি যে কতটা ঘেঁটে আছি সে আমি দিম্মাকে কি করে বোঝাই…
সত্যি…একটু আগে প্রিন্সি ম্যামের অফিসেই যে ঘটনাটা ঘটলো সেটাই কি কিছু কম অদ্ভুত ?!
প্রিন্সি ম্যামের অফিসে ওনার টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারটায় চুপ করেই বসেছিলাম আমি। উনি খুব উচ্ছসিত হয়ে ঘুরেফিরে একটাই কথা বলছিলেন যে উনি আমার জন্য কত গর্বিত। কথা বলতে বলতেই রিলিজ সার্টিফিকেট টা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন উনি।
“বুঝলে স্রোতস্বিনী…. আমি চাইছিলাম তোমাকে একটা গ্র্যান্ড ফেয়ারওয়েল দিতে…. কিন্তু ইসপ্যামার রুল… ব্যাপার টা সিক্রেট রাখতে হবে” উনি একটু হতাশ গলায়ই বললেন….
আমি জীবনে প্রথমবার ইসপ্যামার রুল কে থামস্ আপ জানিয়ে , সার্টিফিকেট টা নিয়ে , ওনাকে থ্যাংকস্ দিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়েও ভাবলাম দিম্মা যে ভাবে বড়দের গ্রিট করতে শিখিয়েছে…..পায়ে হাত দিয়ে…প্র….প্র…প্রণাম ( তাই ই তো বলে মনে হয় ) করা….. শেষবারের মত ওনাকে সেটাই করে যাই। এতদিন অনেক স্নেহ ই পেয়েছি ওনার থেকে।….. আমি যখন ঘুরে গিয়ে ওনার টেবিলের নীচে মাথা নিচু করে ওনার পা স্পর্শ করতে গেলাম…. উনি হঠাৎ অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠলেন…জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে, উনি লজ্জা পেয়ে বললেন….
“আর বোলোনা স্রোতস্বিনী.. আসলে বয়স হচ্ছে তো….একটু আগে ওয়াশরুমে যেতে গিয়ে পা মচকে পড়ে গেলাম… তুমি আসছো বলে আর মেডিক্যাল রুমে যাওয়া হয়নি…. এই বার আমান্ডা কে বলবো আমাকে মেডিক্যাল রুমে নিয়ে যেতে… ” …
হঠাৎ আমার মধ্যে সেই অন্য “আমি” টা জেগে উঠলো…আমি শুনলাম আমি বলছি…’দেখি তো ম্যাম আপনার পা টা… বলে…উনি কিছু বলবার আগেই ওনার পা টা টেনে নিলাম….আর আস্তে করে আমার হাত টা ওনার পায়ের ফুলে থাকা অংশ টাতে তে বুলিয়ে দিলাম… আমার ভিতর থেকে যেন কেউ আমাকে বলে দিচ্ছিল… আমাকে কি করতে হবে… ঠিক কি ভাবে করতে হবে…
প্রিন্সি ম্যাম প্রথমে চমকে উঠেছিলেন…আরে আরে কি করছো!!! এই বলে পা টেনে নিতে গিয়েই অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন…”স্রোতস্বিনী এটা কি করে পসিবল্?? আমার… আমার….পেইন তো একদম সেরে গেল !!! সোয়েলিং টাও একদম ভ্যানিশ হয়ে গেল… তুমি…. তুমি এটা করলে!! তুমি রিয়্যালি চোজেন্… আমি…আমি…ভাবতেই পারছিনা এটা সম্ভব!!”
উনি আরো কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন…. কিন্তু ওনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ‘গুডবাই ম্যাম ‘ বলে…স্তম্ভিত শেইলা ম্যাম কে ঐ ভাবেই রেখে আমি বেরিয়ে এলাম….দরজা টা টেনে বন্ধ করে…
কোনোমতে হোস্টেলে ফিরে সেই থেকে যে চুপ করে আমার বেডের উপর বসে আছি…দিম্মার বারবার করতে থাকা ফোনের উত্তর দেওয়ার সাহস ও শক্তিটুকু ও এই মুহূর্তে আমার নেই…
“স্রোতস্বিনী তোমার গ্র্যানি ফোন করেছেন… তুমি ওনার ফোনের রিপ্লাই দিচ্ছো না….সী ইজ ভেরি ওয়ারিড…”
আজ দ্বিতীয় বার আমার ঘরে হোস্টেল ওয়ার্ডেন পদার্পণ করলেন…
‘স্যরি ম্যাম, আমার ফোন টা সাইলেন্ট ছিল… আমি এক্ষুনি ওনার সাথে কথা বলে নিচ্ছি…আ্যান্ড থ্যাংক ইউ ম্যাম ‘
নাঃ আর উপায় নেই… ওয়ার্ডেন চলে গেলে কিছুক্ষণ ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইলাম…যে ভাবে আমার অদ্ভুত কান্ডকারখানার নমুনা দেখছি…কি জানি হয়তো এখান থেকে চেঁচিয়েই দিম্মার সাথে কথা বলতে পারবো…ভ্যাম্পায়ার কাম উইচ্ যখন…
ভাবতেই আজ সারাদিনে প্রথম বার হাসি পেল…
ফোন টা নিয়ে দিম্মাকে কল্ করলাম… রিং হতে না হতেই ও প্রান্তে দিম্মার উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এল…
“সার্সী…তুই ঠিক আছিস??? তোর কিছু হয়নি তো?আমি এইমাত্র তোর কাছে যাবো বলে রেডি হচ্ছিলাম”
গলার স্বর স্বাভাবিক করে জোরে হেসে উঠলাম
‘আরে দিয়া আর বোলো না প্রিন্সি ম্যামের অফিসে যাওয়ার ছিল…ফোন টা সাইলেন্ট ছিল… মানে নিতে ভুলে গিয়েছিলাম…’
ও প্রান্তে দিম্মা চুপচাপ….এই মানুষ টা আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শুনেই মনে হয় বুঝতে পারে আমি সত্যি না মিথ্যে…..
“সার্সী তুই কাল ই আমার কাছে আসছিস…….. দুটো কারণে….এক নম্বর…ইসপ্যামা থেকে তোর জয়েনিং লেটার আর কবে কিভাবে যাওয়া…তার ডিটেইল পাঠিয়েছে…আর সেখানে বলা আছে তুই ইচ্ছে করলে বাকী দিন কটা তোর ফ্যামিলির সাথে কাটাতে পারিস…কি দারুন বল ??? তুই আর আমি একসাথে কতক্ষন থাকবো…কিইই মজা…”দিম্মা বাচ্ছা মেয়েদের মতো খুশি খুশি গলায় বললো…
“আর দুই নম্বর….তুই প্রতিবারের মতো ভূলে গেছিস তো? আর চারদিন পরে কি? তোর বার্থ ডে না?”
দিম্মার খুশি টা নষ্ট করতে মন চাইলো না…আমিও গলায় বাড়তি খুশি আনার চেষ্টা করলাম
‘ওসব ছাড়ো…. তোমার কাছে থাকবো….ভালো ভালো খাবার আর রূপচর্চা…হয়তো এই শেষ…তাই এবার একদম জমিয়ে…’
” সার্সীইইই !!!!” আবার ???? বলেছি না ?? আমি আর তুই এক… তোকে আমার থেকে কেউ কোনোদিন আলাদা করতে পারবে না…তাই এসব কথা বললে কিন্তু আমি এমন হাউমাউ করে কাঁদবো না…তোর মিরিন্ডা ম্যাম ভয় পেয়ে যাবে….”
‘ উফ্ দিয়া… তুমি না !!!! উনি মিরিন্ডা না মিরান্ডা….’ আমি সত্যি সত্যিই হেসে ফেললাম!
” শুনবো… সব শুনবো… তোদের মিটিং কেমন হোলো…. তার আগে তোকে আর একটা কথা বলার আছে আমার…..”
দিম্মা খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো….
‘ কি হয়েছে গো দিয়া???’ আমি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম…’ তোমার শরীর ঠিক আছে তো???’
” শরীর ঠিক ই আছে…ওসব না … আসলে…দেবী…দেবী ফোন করেছিল…তোর বার্থডে তে আসবে বলছে… আমি কিন্তু কিছু বলি নি…ও নিজে থেকেই আসতে চাইলো…বললো ইসপ্যামা থেকে নাকি ওর কাছেও একটা লেটার গেছে… এমন ভাবে আসতে চাইলো…যে আমি…আমার উপর রাগ করিস না সার্সী… প্লিইজ্ “
আমি যে রাগ করি নি, …দেবলীনা বসুমল্লিক কে নিয়ে যে আমার কোনো অসুবিধে নেই…. দিম্মাকে সেটা বুঝিয়ে বলে ( আর কতো উদ্বেগ আর কষ্ট দেবো এই মানুষ টাকে )….কাল ই আমি দিম্মার কাছে যাচ্ছি সেটা কনফার্ম করে ফোন টা রেখে দিলাম…
যতো অদ্ভুত জিনিস তোলা আছে আমার লাইফে, সব মনে হয় একসঙ্গেই ঘটবে বলে স্থির করেছে… না হলে আমার সেই পাঁচ বছরের জন্মদিনের পরে আর কোনো বার্থডে তে ই তো দেবলীনা বসুমল্লিক ওরফে দেবী ওরফে্ লীনা ওরফে্ আমার মা আসার কথা ভাবেন নি… হঠাৎ কি হলো ওনার ? মাতৃত্ব জেগে উঠলো নাকি?
নাকি ইসপ্যামা তে আমার নির্বাচন অনেক কিছু পাল্টে দিল???
যাই হোক, কাল যে দিম্মার কাছে যাবো….সেটা ভাবতেই আমার টানটান স্নায়ু গুলো একটু শিথিল হলো
আমি বিছানায় শুয়ে চোখ বুজলাম……টের পেলাম…আসছে…আমার ঘুম আসছে…
ভুলিনি দিম্মা…আমার বার্থডে আমি কোনোদিন ই ভূলি না… শুধু পাঁচ বছরের সেই অভিশপ্ত জন্মদিনের পর আর মনে করতেই চাইনা…
ঘুমিয়ে পড়ার আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম…আমার দিম্মাকে সব কিছু জানাতে হবে
আমি সব বলবো দিম্মাকে …কিচ্ছু বাদ দেবো না
সব বলবো দিম্মা কে … সঅঅব।
পাশের রুমে আন্দ্রিয়া ,এমিল রা গান চালিয়ে নাচছে মনে হয়.. শুনতে শুনতে আমার চোখের পাতা জুড়ে এল…আর সেই ঘুমন্ত চোখের পাতায় অনেক মুখের ভীড়ে একটা মুখ সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠলো…
দেবলীনা বসুমল্লিক…”মা”