• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৮)

কু ঝিক ঝিক দিন

৮.

ছোটোবেলায় বুঝতে পারতাম না আমরা কোন ক্লাসে বাস করি।ক্লাস বলতে পড়াশোনার ক্লাস নয়।আমি বলতে চাইছি সোস্যাল ক্লাস।মানে আমরা গরীব না বড়লোক নাকি মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত।সেই সময় স্কুলে বাবা মার মাসিক বা বাৎসরিক আয় কত বলে কোনো ফর্ম ফিল আপ করতে হতো বলে আমি জানতাম না।আমার প্রথম স্কুল শিশুতীর্থ। বাবা একদিন সকালে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরে আমাদের দুই বোনকে নিয়ে স্কুলে ভরতি করতে গেলেন।আমার তখন তিন আর বোনের ১বছর নয় মাস।আমার বোন আমার থেকে এইটুকু বয়সেরই ছোটো ছিল।স্কুলে ভরতির বয়স তার হয়নি।কিন্তু বিশাল সংসারের জোয়াল টানার মাঝে নিজের পড়াশোনা,বিএড পড়তে যাওয়া আমার মা হয়তো সকাল এগারোটা থেকে তিনটে অবধি মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে একটু নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছিল।আর ওই সময় টুকুর মধ্যেই কলেজ গিয়ে ফিরেও আসত।সেই সময় কিন্তু এত গাড়িঘোড়া ছিল না।মা বিএড করতে যেত নিউ ব্যারাকপুরে।সেটা অবশ্য আমাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে ছিল না।
যাহোক, আমি তো ভরতি হয়ে গেলাম।কারন আমার হাতে খড়ি হয়ে গেছে, অ আ অল্প বিস্তর লিখতে পারি।চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে বলতেও পারি।না,আমার মা তখনো আমাকে এ বি সি ডি কিংবা জ্যাক এন্ড জিল মুখস্থ করায় নি।তবে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় তিন বছরের বাচ্চার এতটুকু শিক্ষাই যথেষ্ট ছিল।
কিন্তু বোন!তার মুখে ভালো করে কথাই ফোটেনি।অল্পবিস্তর যাও বলে তাও মুড হলে।বাকিটা ইশারায়।তাকে কী করে ভরতি করা যাবে একই ক্লাসে!আমাদের বড়দি রত্নাদি মহা বিপদে পড়লেন।অথচ বাবার মুখের উপর নাও বলতে পারছেন না।যতই হোক, একজন স্বনামধন্য ব্যক্তির মেয়ে আমরা!
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল,বোনও পড়বে,তবে তাকে হাতে লিখতে হবে না।শুধু শুনে শুনে যতটুকু শেখার শিখবে।
বাবা মা তাতেই রাজি।খানিকক্ষণের জন্য তো স্বস্তি।
এই বোনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক একদিকে দিদি,আবার মা আবার বন্ধু। মা কারন তখন শুনতাম বড় দিদি মানেই মাতৃতুল্য।আমার উপরেই তার দেখভালের ভার। সে তো ছোটো।স্কুলে অবশ্য একমাত্র টিফিন পিরিয়ড ছাড়া সে মোটেই আমার কাছে আসত না।তার ঠাঁই ছিল দিদিমনিদের কোলে।
সেই বয়সেই সে ছিল খুবই রোগা আর ডানা কাটা পরীর মতো সুন্দর। আমি তাকে চোখে চোখে রাখতাম।কারন যতই হোক, সে আমার বোন।আমি তার মায়ের মতো বড় দিদি।এই টিপিক্যাল বড় দিদি মায়ের সমার্থক বাক্যটি তখন সবার মুখেই শোনা যেত।সম্ভবত শরৎচন্দ্রের প্রভাব।সেটা বুঝেছিলাম ক্লাস ফোরে বইয়ের সামনে লুকিয়ে শরৎরচনাবলী পড়ার সময়।
একদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিধান শিশু উদ্যানে। সেখানে স্লিপ চড়তে গিয়ে একটা দিদির পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেছিল।আমি সে দৃশ্য দেখে ছুট্টে গিয়ে আগে বোনকে নিজের কাছে নিয়ে নিয়েছিলাম।
না, এত সব ডিটেইল ঘটনা হয়তো মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।কিন্তু তা স্বত্বেও স্পষ্ট মনে আছে,তার কারণ দুটো,রোজ যা যা ঘটনা ঘটত ওই বয়স থেকেই রুল পেন্সিল দিয়ে বড় বড় অক্ষরে একটা লাইন টানা খাতায় মা লিখে রাখতে বলত।ওটাই ছিল আমার হোম ওয়ার্ক।যেমন পড়তে শেখা মাত্র নানা বই এনে দিয়ে রিডিং পড়তে বলত।আজ বুঝি বই পড়ার সূচনা ওভাবেই হয়েছিল।
মনে রাখার দ্বিতীয় কারনটা ছিল,শিশুতীর্থ স্কুলের দুই দিদিমনি-বেবীদি আর কৃষ্ণা দি আমরা ক্লাস ওয়ানে যে স্কুলে ভরতি হয়েছিলাম সেখানে পড়াতে এলেন।তখন আমি ক্লাস ফোর।মাও তখন আমাদের সিঁথি রামকৃষ্ণ সারদা বালিকা বিদ্যামন্দিরে পড়াতে শুরু করেছে।এই দুই দিদি বারবার আমাদের ছোটোবেলার নানা গল্প মা ও অন্যান্য টিচার এমনকি আমাদের ক্লাসে এসেও বলতেন।
এই নতুন স্কুলে ভরতির সময় একটা মজা হয়েছিল। আমাদের লিখতে দেওয়া হয়েছিল বাবার নাম।আমি বাবার নাম লিখলেও বোন বাবার নামের জায়গায় লিখেছিল তপন।দিদিমনিরা নিশ্চিত ভাবেই বাবার নাম জানতেন।কিন্তু বোনের নাম্বার কাটতে পারেনি,কারন তারা ভেবেছিল এটা হয়তো বাবার ডাক নাম।
না,আমার বাবার নাম কখনো কোন জন্মেই তপন ছিল না।বোন বাবার নামের বানান মুখস্থ করতে পারেনি কোনোভাবেই।তাই সে সোজা বানান তপন লিখে দিয়েছিল।এ কথা মা জানতে পেরেছিল নিজে স্কুলে পড়াতে ঢুকে।দিদিমনিরা মার কাছে বাবার তপন নাম আছে কিনা জানতে চাইলে মার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল বোধহয়।কিন্তু দিদিমনিরা মাকে স্বান্তনা দিয়েছিল এই বলে যে ওইটুকু বাচ্চার মাথায় কত বুদ্ধি! একটা নাম তো লিখেছে।
তা আমার বোনের মাথায় নানা বুদ্ধি গিজগিজ করত।সে কখনো স্কুলের খাতায় পড়া লিখত না,এমনকি পরীক্ষার খাতাতেও অধিকাংশ সময় না লিখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত।দিদিমনিরা লিখতে বললে সে অনেকক্ষণ বাদে খাতা জুড়ে নানান ছবি আকঁত।অনেক বড় বয়স অবধি সে এভাবেই খাতা জমা দিত।আমি তার দিদি,তাই বারবার নিজের লেখা ছেড়ে উঠে গিয়ে বোঝাতাম বোন কিছু লেখ।নইলে তো ক্লাসে উঠতে পারবি না।সে তখন আমার প্রতি দয়া পরবশ হয়ে ঠিক যত নম্বর পেলে পাস করা যায় ততটাই লিখত।আর তারপর বাকি সময়টা ছবি এঁকে খাতার একদম নিচে বিয়াস নামে সই করে দিত।সে বিশাল শিল্পী কিনা!তার সই না থাকলে তো যে কেউ এই ছবিগুলোকে নিজের বলে চালিয়ে দিতে পারে! এ বুদ্ধি তার হয়েছিল বাবার ব্যাঙ্কের চেক বই সই করা দেখে। কেন সই করতে হয় তার উত্তরে বাবা বলেছিল,নইলে আমার টাকা যে কেউ নিজের বলে তুলে নিতে পারে।
টাকা না হোক,ছবি তো তার নিজের আঁকা।কাজেই সই থাকতেই হবে।
আমি কিন্তু বোনের সঙ্গে ঠিক কি সম্পর্ক আমার তা নিয়ে রীতিমতো কনফিউজড ছিলাম।আমি কে তার?দিদি,বন্ধু না মা?আমার ঠিক চার বছর পর ছোটো বোন হলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছিলাম আমি আসলে মাতৃতুল্য বড় দিদি।
কিন্তু এসবের মধ্যে ক্লাসের কথা কিভাবে এলো!এলো বইকি!সবাই বলত আমরা নাকি বড়লোক!আমার বাবার গাড়ি আছে,ফ্লাইটে করে সে হিল্লি দিল্লি করে।কিন্তু আমার তো কখনো নিজেকে বড়লোক মনে হত না।কারন আমার মা বাড়িতে যথেষ্ট পরিমান রান্না করলেও,মাছ,মাংস,লুচি,পরোটা বা অন্যান্য রান্নার কোনো খামতি না রাখলেও,এমনকি প্রতিদিনই প্রচুর পরিমানে লোক বাড়িতে খেলেও,তাকে পাড়ার লোক মোচ্ছব চলছে বলে অভিহিত করলেও কখনো আমাদের গোটা ডিম খেতে দেয় নি।সবসময় পাতে হাফ ডিম।সেই ডিম আমরা শেষে খেতাম পরম তৃপ্তি নিয়ে।কারন দ্রৌপদীর হাতের রান্না না খেয়েও বলতে পারি আমার মা রান্নায় তার থেকে কিছু কম ছিল না।
কিন্তু মা কেন ডিম হাফ দিত আজ অবধি জানি না।তখন কি ডিমের দাম খুব বেশি ছিল?মায়ের খেরোর খাতায় দেখতাম সব জিনিসের দাম লেখা। খাসীর মাংস ২৫টাকা কিলো।তারপর ৫০টাকা হল।মাছের দামও ১০/১৫এর আশেপাশেই থাকত।তাহলে ডিমের দাম!সেখানে দেখতাম লেখা ২৫পয়সা।সেটা কি খুব বেশি ছিল তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে! কে জানে!
অথচ মামার বাড়িতে অনেক মুরগী থাকার কারনে গেলেই ডিমের একাধিক পদ খেতাম।সেখানে হাফের কোন কনসেপ্ট ছিল না।পুরোটাই ফুল।একটা আস্ত ডিম আমাদের পাতে।
অবশ্য মা অনেক ক্ষেত্রেই এমন করত।যেমন বন্ধুরা যখন নানা শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুচ্ছে,আমাদের তখন বরাদ্দ রিঠে।মা সারারাত গরম জলে রিঠে ভিজিয়ে সকালে তার মাড়ি বের করে তা দিয়ে চুল ঘসে দিত।তাতে চোখ জ্বলে গেলেও রেহাই নেই। চুল নাকি এতে উজ্জ্বল ও পরিস্কার হয়।তাছাড়া কেশুটি পাতা ও জবা পাতা বেটে মাথায় লাগানো তো আছেই। তাতে এক ঢাল কালো চুল ঠিক বিদ্যা বালান যেমন ভাবে বিজ্ঞাপন দেয় নিহার তেলের তেমনি। আমাদের অবশ্য সত্যিই তেমনি চুলই ছিল,এক ঢাল মাথা ভরতি কোমর পর্যন্ত বিস্তারিত কালো ঘন চুল।যাকে যতখুশি টানো,ছিড়ঁবে না,একটা বিজ্ঞাপন হয় চুল দিয়ে গাড়ি বেঁধে মাটিতে বসে যাওয়া গাড়ি টেনে তোলা হচ্ছে, আমাদের চুলও ছিল তেমনি শক্ত মজবুত।শুধু গাড়িতে বেঁধে টেনে দেখা হয়নি এই যা আফসোস।
এ ছাড়াও আমাদের বাড়িতে স্নো, পাউডার, পারফিউম,ক্রিম কিছুই আসত না।মা বোধ হয় শীতকালে বসন্ত মালতি বলে একটা ক্রিম মাখত,তাও এক ক্রিমে বোধহয় দুই শীত পার হয়ে যেত।আর ছিল একটা খয়েরী লিপস্টিপ যা বোন রোজ মায়ের তাক থেকে নামিয়ে ঠোঁটে বুলিয়ে নিত।ফলে কিছু দিন বাদ থেকে লিপস্টিপ টাও ভ্যানিস হয়ে গেল।
এত কিছুর পরেও লোকে কেন আমাদের বড়লোক বলত জানি না।তবে বাবাকে একদিন হাফ ডিম হাতে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম,আমরা কী গরীব?বাবা কেন এমন বলছি জানতে চাইলে ডিমটা দেখিয়ে বলেছিলাম,পাশের বাড়ির সকলে আস্ত ডিম খায়।
বাবা বলেছিল,ডিম বা খাওয়া দিয়ে গরীব বড়লোক হয় না।বড়লোক হতে হয় মনে আর শিক্ষায়।এরপর আর কখনো এই প্রশ্ন করিনি।কারন সেদিন থেকে এটাই জেনেছিলাম পড়াশোনা ভালোভাবে করতে হবে ও মনটা বড় করতে হবে।তবেই বড়লোক হতে পারব।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।