• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৩)

কু ঝিক ঝিক দিন

৩.

খুব ভোরে আমাদের ঘুম ভাঙত ঠাকুমার গলায় রাই জাগো রাই জাগো গান শুনে।ঠাম্মা অসাধারণ গাইতেন।প্রথাগত তালিম কারোর কাছে নেননি।বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেছিল প্রখ্যাত জমিদার বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে। ঠাকুরদা শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছেন।ঠাম্মাও বিয়ের পর সে অর্থে সবদিক থেকেই ঘর আলো করে ছিলেন।কিন্তু ঠাম্মার গান তখনি শুনতাম যখন আজিমগঞ্জ মানে পৈত্রিক বাড়ি যেতাম।বাকি সময় ঘুম ভাঙত বাহাদুরদার সুবা হো গয়া,আব উঠো… আওয়াজে।
রাতে শুতেও যেতাম তার গলার আওয়াজ শুনেই।লোহার গেটে কাঠের লাঠির আঘাতের আর্তনাদ, তার সঙ্গে হুইসেল।আমরা জেনে যেতাম বাহাদুর দা এসে গেছে।এবার শোবার পালা।বাহাদুর দা আসত রাত একটায়।তার খানিক আগেই আমার বাবা সরু গলি ধরে নিশুতি রাতের স্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে উচ্চ স্বরে গান করতে করতে বাড়ি ফিরত।গানদুটো ছিল, ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময় এবং প্রলয় নাচন নাচলে যখন জটার ভুলে…
আর খুব উত্তেজিত থাকলে চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল…
বাবার সঙ্গে সঙ্গে আসত পাড়ার যত কুকুরের দল।সে এক দেখার দৃশ্য। যেন মার্চ ফাস্ট। প্রথমে ক্যাপ্টেন তারপর পুরো দল।সেই মুহূর্তে সারা পাড়া জেনে যেত ঘড়িতে বারোটা তিরিশ বাজে।ঘোষালবাবু বাড়ি ফিরলেন।
বাবা এসে স্নান পুজো সেরে খেতে বসা মাত্রই বাহাদুরের হুশিয়ারি শুরু হয়ে যেত।শো যাও।নহি তো ডাকু আ যায়েগা…না আমাদের পাড়ায় কখনো ডাকাত আসেনি।কিন্তু বাহাদুরদা এটাই বলত।
একবার সাহস করে জানতে চেয়েছিলাম,না ঘুমলেই তো ভালো,ডাকাত এলে দেখতে পাবো।তুমি ঘুমতে বলো কেন?
তার উত্তরে নিজের কোমড়ে গোঁজা কুফরী বের করে বলেছিল,না ঘুমালে ডাকাতের সঙ্গে আমার যে লড়াই,তাতে লোক জমা হয়ে যাবে।তখন আমার আর নোকরি থাকবে না।
লোক জড়ো হওয়ার সঙ্গে নোকরি না থাকার কি সম্পর্ক তা বুঝতে পারিনি।তবে এটা জানতাম বাহাদুরদাকে বাবা এনেছিল।শেয়ালদা স্টেসনে সে কারোর সঙ্গে মারপিট করছিল।কারন কেউ তাকে নেপালি নেপালি বলে খুব জ্বালাতন করছিল।সেই সময় পাবলিকের মার থেকে তাকে উদ্ধার করে আনে বাবা।তার দিনে কাজ জোটে স্থানীয় স্কুলে, বাবারই তদারকিতে আর রাতে সে পাড়া পাহাড়া দিতে শুরু করে।
এ হেন সাহসী বীর বাহাদুর বাবাকে যমের মতো ভয় পেত।আবার বাবার জন্য জান কবুল করতেও রাজি ছিল।আর বাবার মেয়ে হওয়ায় আমাদের উপরেও তার নজরদারি চলত।
বাহাদুরদার বাড়ি নেপালে।পশুপতিনাথ মন্দির যেখানে তার পাশেই কোনো পাহাড়ের কোলে।তার বাবা মা কেউ নেই। বাবা যুদ্ধে গিয়ে আর ফেরেনি।মা হরকা বানে ডুবে গেছিল।সেই থেকে সে একা।
মাঝে মাঝে সে তার গ্রামের কথা বলত আর আমাকে সে গ্রামে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখাতো। আমি তখনো পাহাড় দেখিনি।আমার কাছে পাহাড় মানে মামা ভাগনে পাহাড়।তার থেকেও উঁচু পাহাড় কেবল পড়ার বইয়ে দেখা আর পড়া।আমি ভাবতাম বেশ হয় যদি বাহাদুরদা তার গাঁয়ে নিয়ে যায়।
গোলগাল চেহারার ফর্সা বেঁটে বাহাদুরদার নেপালি গানের ভাষা না বুঝলেও বুঝতে পারতাম সে বেশ খোসমেজাজে থাকে রাতে পাহাড়া দেবার সময়।
আমার প্রায় প্রতি রাতেই ঘুম হত না টারজান অমনিবাস কিংবা শরৎরচনাবলী পড়ার কারনে।তখন টারজান আমার জীবনের নায়ক।আর পথের দাবীর সব্যসাচীর মতো বীর আমার চোখে দুটো নেই। সবচেয়ে ঘেন্নার পাত্র দেবদাস।অমন করে কেউ মদ খায়!মা বলত,বাজে অসভ্য লোকেরাই একমাত্র মদ খায়,নেশা করে।সেই অর্থে দেবদাসের মতো বাজে লোক দুটো ছিল না আমার দেখা।
রাতে পড়তে পড়তে দেখতাম ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হাতের লাঠিটা মারতে মারতে একটা নির্দিষ্ট সুর করে বাহাদুর দা হেঁটে চলেছে।আমি পড়া থামিয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে তার চলে যাওয়া দেখতাম। গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে টিমটিম বাতির আলোয় দূরে মিলিয়ে যেত সে।কেবল হুইসেল টা থেকে থেকে বেজে উঠত।
আমার ভীষণ ইচ্ছে করত বাহাদুরদার সঙ্গে ঠিক অমনি ভাবেই শো যাও,ম্যায় হুঁ বলতে বলতে বহুদূর চলে যাই,সেটা টারজানের খোঁজে অথবা বাহাদুরদার গাঁ ও হতে পারে।কিন্তু এখানে কিছুতেই নয়।
আমার যাওয়া হল না বাড়ি ছেড়ে,হল না নাইট গার্ড হওয়া।কিন্তু এখনো নিশুতি রাতে হঠাৎ করেই চমকে যাই.. কে যেন বলে ওঠে শো যাও, কিংবা ভোরের আলো ফোটার আগে শুনতে পাই জাগো,সুবা হো গেয়ি….।আর তখনি মনের মধ্যে গুনগুন করে উঠি সেই অজানা নেপালি গানের সুর যার একটি শব্দেরও উচ্চারণ কিংবা মানে বুঝতে পারিনি আজও।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।