সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে পূর্বা দাস (পর্ব – ৫)
অমরত্বের আগে
পর্ব – ৫
মাস গড়িয়েছে। আবার শয্যাশায়ী থারো। এবারই তার অন্তিম শয্যা, থারোর শিরায় শিরায় ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে এই উপলব্ধি। বীরার মৃত্যুর পর গ্রামের সমস্ত পরিবারগুলি নিজেদের সুরক্ষিত করেছে । প্রত্যেকের বাড়ির সামনে তারা সারারাত মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখে। দিনের বেলায় বাতাবিলেবু বা ন্যাসপাতি গাছের ডালে বসে থাকে সাদা পোশাক পরা ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরা। ওকে দেখলেই তারা হাত নেড়ে হিসহিসিয়ে ওঠে, ” যা- চলে যা – চলে যা এখান থেকে ডাইনী বুড়ি।” থারো শিশুর মত কাঁদে আর হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ায় মধ্য রাতের শুনশান গ্রামের পথে।
আর কিছু করার নেই। সে প্রস্তুত থাকে তার সঙ্গী, তার নিয়ন্তা যে অত্যাচার বরাদ্দ রেখেছে, সব সহ্য করার জন্য। সব সময় কেউ যেন তার শরীরের অশক্ত হাড়গুলোকে হিংস্র দাঁতে গুড়ো করে চলেছে। অদৃশ্য কোন হাত তার চুল খিমচে টেনে ছিড়ে ফেলতে চাইছে। যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যায় সে। তার জাগতিক চেতনা শুধু কিছু সময়ের জন্য ফিরে আসে যখন তার ঘরের সামনের ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে তামোর বৌয়ের ভীরু হেঁটে আসার আওয়াজ কানে আসে। এখন আর ঘরেও ঢোকে না বৌটি। থারো কোনো রকমে নিজেকে মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে দরজার কাছে এসে দেখে খাবার থালা দরজার বাইরে রাখা। আগের মতোই পরিপাটি গোছানো। খুব সামান্যই খেতে পারে এখন সে। দাঁতহীন মাড়ি আর লালাহীন শুকনো মুখগহ্বর কোন ভাবেই তাকে সাহায্য করে না খাবারের সদ্ব্যবহারে।
কিছুদিন পর। থারো এখন সম্পূর্ণ চলচ্ছক্তিরহিত। এবার তার উপায়হীন মনোভাবে শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা। তার নির্দয় প্রভু এবার তাকে নিশ্চয়ই ছেড়ে যাবে অবশেষে। প্রতিনিয়ত এই অমানুষিক অত্যাচার থেকে তাকে মুক্তি দেবে। কেননা তার কাছে এখন এটা পরিষ্কার যে এবার সে সত্যিই অক্ষম প্রভুর কাজ করতে। গত এক সপ্তাহ কোন খাবার স্পর্শ করেনি থারো। শরীরের মধ্যে ছিল মাত্র তার হাড় কখানি, খুব ধীরে ধুকপুক করা একটা দুর্বল হৃদপিণ্ড আর পাতলা চামড়ার আবরণ। এটুকুই চিহ্ন তার বেঁচে থাকার। থারো সেই সৌভাগ্যখচিত দিনটির জন্য উদগ্রীব ছিল কবে তার সঙ্গী ক্লান্ত হবে, প্রতিদিনের অত্যাচারের অবসান হবে। সে জানতো, সে জয়ী হবেই। অবশেষে মৃত্যুর দরজা খুলবেই। হায়রে ভাগ্য! মৃত্যু ও কখনো এতো কাম্য হয়, মধুর হয়!
মৃত্যুর মনোমোহন আলো যেদিন থারোর প্রায় শিয়রে এসে দাঁড়ালো সেদিন সে একদম নতুন এক পায়ের আওয়াজে জেগে উঠলো। বিস্ময়ে সে তার হালকা হয়ে যাওয়া মাথা দরজার দিকে ঘোরায়। দরজায় দুটো আবছা অবয়ব। তার দুচোখ ছাপিয়ে জল নেমে আসে। কিন্তু তার ভীত, উদ্বিগ্ন হৃদয়ের আর্তরব শুনতে পায়না কেউই। সেই অশুভ আত্মা আবার আশ্রয় পেলো ওর নাভিমূলে।
” বৌদি, তোমার কর্তাটি কিন্তু একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। সব বাড়িতেই তো বয়স্ক মানুষেরা থাকে, তাই না? আমাদের থারোর না আরেকটু বেশি বয়সই হয়েছে। তোমরা যে কেন এত কুসংস্কারগ্রস্ত!” একটি যৌবনদীপ্ত কন্ঠ প্রাণ খুলে হাসতে হাসতে কথা বলছে তরুণী বৌটির সাথে। থারো তার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট চেটে নেয় অন্যমনস্কভাবে। কিন্তু তার চোখের জল সে রোধ করতে পারে না। অসহায় আবেগে বিছানার প্রান্ত খামচে ধরে সে।
” দ্যাখো থোইবা,” তামোর বৌয়ের নম্রস্বর। “তুমি অবশ্যই একজন উচ্চশিক্ষিত ডাক্তার, কিন্তু কিছু জিনিস খুবই আশ্চর্যের; এটা তুমি মানো আর নাই মানো। ব্যাপারটা এখন শুধু তামোর স্পর্শকাতরতার মধ্যেই নেই। গ্রামের সব মানুষই এখন জানে। আমি, আমিও দেখেছি … নিজের চোখে দেখেছি।” ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছিল তামোর বৌ। “ঠিক কি দেখেছ, সেটা আমায় বলবে?” থোইবা প্রশ্ন করল। কিন্তু ততক্ষনে সে অ্যাবক থারোর প্রায়ান্ধকার ঘরে ঢুকে পড়েছে। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সে দেখল, ঘরটি সম্পূর্ন আলো-বাতাসহীন। বিছানার কাছে রাখা একটি ছোট কাঠের টুল। ব্যস। আসবাব বলতে শুধু এই। কোন জানালা নেই। এমনকি হাওয়া চলাচলের ছোট খুপরি ও না। একটিমাত্র দরজা ছাড়া সামান্য ফাটল ও নেই ঘরটাতে। তামোর বৌ একদম চুপ। যেন আশ্রয় খুঁজছে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল থোইবার পেছনে। থারোর ভারী নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছিল মুখ দিয়ে। সাথে দুর্গন্ধ।
” থারো, চিনতে পারছ? থোইবা বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছে। থারোর কোঁচকানো চামড়ায় সামান্য আলোড়ন দেখা গেল। মাথাটা সামান্য নড়ল, আর সাথে সাথে তার চোখ থেকে অজস্র জল গড়িয়ে পড়ল।