• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবহ -তে প্রভাত মণ্ডল (পর্ব – ৭)

ইছামতীর সন্তান  – ৭

দ্রুততার সাথে বিশু এসে হাজির—
এই তুমরা সব বেরিয়ে এসো,যে যার ঘরের থেকে বেরিয়ে এসো।
বিশু মণ্ডল,নিজেকে সে বড়ই বিজ্ঞ মনে করে।পড়াশুনা করেছে ক্লাস এইট পর্যন্ত কিন্তু তা হলে কি হবে,পাড়ার মোরে চায়ের দোকানে যেসব সর্বজ্ঞ পণ্ডিতদের পরিচয় মেলে,এ বিশু তাদেরই হেডমাস্টার।খবরের কাগজে যে খবর গুলো থাকে, সেগুলো বোধ হয় বিশুর থেকেই সংবাদদাতারা শুনে শুনে লিখেছেন।এমন কোনো বিষয় নেই যা এই মানুষটা জানে না।আসল কথা কিছু জানুক আর না জানুক ভাবটা সর্বজ্ঞানী।তবে বিজ্ঞ হোক আর নাই হোক,মানুষটি একটু সরল সাদাসিধা,তর্কে পটু না হলেও হারতে রাজি নয়।ঘোষ বাবুদের গুণগান করতে সর্বদাই ব‍্যস্ত।কেউ যদি বাবুদের সম্পর্কে কিছু বলেছে,সাথে সাথে গিয়ে নালিশ। কখনো বেশ রঙ চড়িয়ে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে সাধারণ বিষয়টিকে একেবারে বৃহৎ আকৃতি দান করে।নিজের ব‍্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক কোনো বিষয় নিয়ে সে যতটা গর্ববোধ না করে,বাবুদের যে কোনো বিষয় নিয়ে তার থেকে শতগুণ গর্বিত সে।বাঙালির রাজত্বে এমন চরিত্র প্রতিটি এলাকায় কম-বেশি দেখা যায়।
বিশুর গলার আওয়াজ শুনে অনেকেই যে যার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।সুলতাও বেরিয়ে আসে বাইরে —
কি হলো ঠাহুরপো,কিচু হলো নাই?ক‍্যামন য‍্যান লাগতিচে তুমার মুকখান।অবিশ‍্যি তুমাগের ভাবখানই তো এই রহম।
মহানন্দ এগিয়ে আসে —
অঅঅঅ বিশু দাআআআ…কি হইচে নাকি?কতা কও না ক‍্যান?
—- কি আর হবে।তুমাদের ডাকলি তো সব ঘরের থেকে বের হতি চাউ না।কতা কানে লাগেনা নাকি কারুর?
— ভুল হইয়া গ‍্যাচে বিশু দা।তুমি কইয়া ফ‍্যালো।তুমারে তো সগলেই সম্মান করে।
— এইটা সম্মান হলো?এক ডাক দোবো আর সাথে সাথে সব বেরিয়ে আসবি তা না,তোদের হাজার বার ডাকতি হবে নাকি?পরের দিন থেকে যোনো দুবার বলতি না হয়।
সুলতার সাফ সাফ কথাই পছন্দ।যা বলবে মুখের সামনে,লুকোচুরি করে কিছু বলা তার ধাতে সয় না।কারোর হুম্বিতুম্বিও সহ‍্য হয় না তার। —–
যা কইতি আইচো কইয়ে ফ‍্যালো।অত কতার কি হইলো।মুরুব্বী মানুষ তাই সম্মান করতিচি।আর আপনারে অসম্মানই বা করচে ক‍্যাডা,যে এমন সুর চড়াইয়ে কতা কইতেচো।নাকি বেশি বেশি ভাব দেহাইতেচো।
বিশু জানে সুলতার মুখের ধার।তাই আর কথা না বাড়িয়ে বলে —–
বিকেল চারটের সুমায় বড়োবাবু আসবে।সবাই কাঁঠাল বাগানে চলে আসবা।ওকেনেই যা বলার সব বলবে।আর যেন বলতি না হয়।
একথা বলে বিশু পল্লী ত‍্যাগ করে।সে যেতে না যেতেই পল্লীর ছেলে বুড়ো সকলেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে।যে যার মত বলে যায়।জ‍্যোৎস্নার মনটা সন্তানের চিন্তায় এমনিতেই কেমন যেন হয়ে আছে।হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছে।তবে এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যাবে।সন্তানের জন‍্য চিন্তা বলে কথা,সে তো মা’ই বোঝে।কথায় আছে “ব‍্যথা বোঝে গা’য় আর ক্ষিদে বোঝে মা’য়”।কথাটার সত‍্যতা একজন মা ছাড়া আর কেউ হয়তো এ জগতে অনুধাবন করতে সক্ষম নয়।সন্তানের চিন্তায় আচ্ছন্ন জ‍্যোৎস্নার কারো কথাই তেমন সহ‍্য হচ্ছে না,এমন পরিস্থিতিতে বিশুর কথা শুনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সে —
বড়ো আইচে কোতাকার ক‍্যাডা।উনারে সম্মান দ‍্যাতে হইবো।তা কি অসম্মান করচে ওনারে সব শুনি?কেউ কিচু কয় না বইলা বড়ো সব মাতায় উইটা বইচে।বাবুগের পা চাটা কুকুর।লজ্জা শরম নাই,আদদামরা মিনসা।ওনারে সম্মান দ‍্যাতে হইবো।আ হাহাহা।আর মাতায় বসাইচে আমাগে গ‍্যারামের মানুষগুলান।
এমনিতেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নির্দেশ পেয়ে ইছামতীর চরে ক্ষেতে কাজ করতে যেতে পারেনি অনেকেই।কবে কখন নিজের জমিতে যেতে পারবে,ফসলের দেখভাল করবে,তা সম্পূর্ন অনিশ্চিত।যারা পেটের তাগিদে শহরে কাজে যায়,তারাও আজ বাড়িতে ফিরে এসেছে কাজ না করেই,সরকার থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে বলে।সাধারণ পল্লীর এই মানুষগুলো অত শত বোঝে না যে লকডাউন শব্দের অর্থ কি।তারা শুধু পেটের আগুন বোঝে,বোঝে ক্ষুধা।দৈহিক পরিশ্রমে অর্থ উপার্জন করে তা দিয়ে নিত‍্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনে,সাধারণ ভাবে দিনযাপন করে।সুতরাং এমতাবস্থায় অতি সধারণ এই দরিদ্র মানুষগুলোর মাথায় গভীর চিন্তা নেমে আসে।আশ্রয় যাওবা আছে রুটি-রোজগারে এবার আঘাত নেমে আসে।বিশু চলে যায়।যে যার কাজ কর্ম করে নেয় সকাল সকাল,বড়োবাবু আসবে বলে কথা।সামনাসামনি কিছু বলার সাহস আজ পর্যন্ত কেউ করে উঠতে পারেনি এই মানুষটার সামনে তবে পেছনে কটুক্তির বন‍্যা বইয়ে দেয় অনেকেই।বিকাল চারটে বাজতে না বাজতেই পল্লীর সকলেই কাঁঠাল বাগানে একত্রিত হয়।সময় গড়াতে থাকে,বাবু আসে না।প্রায় মিনিট ত্রিশেক বাদে বড়োবাবু এসে হাজির —
সবাই এসেছিস?
মহানন্দ আগে থেকেই কয়েকটা চেয়ার এনে রেখেছে।একটা চেয়ার বড়োবাবুর সামনে এগিয়ে দিয়ে —
হঅঅঅ বাবু আইচে,সগ্গলেই কম-বেশি আইচে।খালি মাস্টার আসে নাই।
—- কেন ও কি বড়ো হুনু হয়ে পড়েছে নাকি।দাঁড়াও না,দেড় টাকার কলমে ঠিক বুঝিয়ে দোবো।দরকার লাগবে না।সেই তো আমার কাছেই যাতি হবে সই করাতে যে কোনো কাগজপত্রে,তখন ঠিক বুঝিয়ে দোবো।যখন ডাকা হয় এলাকার সবাই আসে,ও কি হয়ে পড়েছে এতো?কি মনে করে কি?
চারিদিক পুরো স্তব্ধ।যেমন গলার জোর তেমনি হুঙ্কার।আগে আগে যাত্রাপালা হলে সেখানে রাবণ চরিত্রের কণ্ঠস্বর যেমন থাকতো তার সাথেই অনেকখানিই মিল।বড়োবাবুর কথার মাঝখানে কেউ কথা বলে না।কারণ এর আগে যতবারই কেউ কিছু বলতে গেছে,বড়োবাবু কারো কথাই শোনে না।সে আসে,নিজের কথা নিজে বলে চলে যায়।আদেশ করে,নির্দেশ দেয় নিজের মত।বলতে থাকে —
শোনো,চারিদিকে একরকম ভাইরাস এসেছে।কেউ বাইরি বেরোবা না।যারা বাইরি কাজে যাও সব বন্ধ রাখো কাজে যাওয়া।আমার যেনো আর দ্বিতীয় বার বলতি না হয়।
এই কথাটুকু বলেই চলে গেলেন।আগা-মাথা কেউ কিছুই বুঝলো না।সবাই যে যার বাড়িতে চলে গেল।সন্ধ‍্যা হয় হয়,পল্লীর প্রতিটি বাড়িতেই তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলে।গ্ৰাম-বাংলায় এ পরিবেশ,প্রদীপের আলো এক অন‍্যরকম স্বর্গীয় জগতে নিয়ে যায়।
আকাশটা মেঘলা কয়েকদিন ধরে।বৃষ্টি হয়েও হয় না।কেমন যেন গুমোট পরিবেশ,ঝড় উঠবার পূর্ব মুহুর্তে যেমন থমথমে থাকে,ঠিক তেমনি।সুলতার মনে বড়ই ক্ষোভ স্বামীর বিরূদ্ধে।নিজের সন্তানাদি না হওয়ায় মনের কষ্ট তো আছেই সাথে বীরেশ্বরের সঙ্গও তাকে মাঝে মাঝে মনে প্রবল পীড়া দেয়।সে চায় যে তার স্বামী তাকে বীরেশ্বরের ঘৃণ্য দৃষ্টি থেকে উদ্ধার করুক,তাকে এই কু-কাজে বাধা দিক,শুধু নিজের করে রাখুক,আগলে রাখুক বুকে।প্রতিটি সৎ বিবেকবান নারীই তো চায় শুধু তার স্বামীর বাহুডোরে বেঁচে থাকতে,কিন্তু সুলতার সে সাধ অধরা।তার মনটা ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে বারবার,হারিয়ে যেতে চায় কোনো এক অদৃশ্য জগতে।সেই ছোটোবেলায় মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা আর একটা বিয়ে করে সংসার পেতেছে,বাপের বাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য তার কপালে জোটেনি।আর এদিকে লোভী,অলস গোলকের হাতে পড়ে আজ জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তার।
সন্ধ‍্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে সুলতা বারান্দায় এসে খেজুর পাতায় বোনা পাটিতে বসে আছে।চারিদিকে ঘুঘরো পোকার ডাক।মানুষের গলার আওয়াজ কম-বেশি আছে।অদূরেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চেকপোস্টে বিদ‍্যুতের আলো জ্বলছে।প্রায় দিনের মত আজও বীরেশ্বরের আবির্ভাব সুলতার কাছে।হাতে একটা ছোটো ঠোঙা ——
কি রে,কি করছিস ও সুলতা?এই নে ধর।
—- আইচো,আসো দ‍্যাহি কি আনচো।
সুলতার গলার স্বরে কেমন একটা কম্পিত ভাব।আসলে বাবুদের কু-দৃষ্টিতে পড়ে আর অল্প বয়সের যৌবনের তেজে ভুল করে বীরেশ্বরের পাল্লায় পড়লেও পরে নিজের ভুল সে বুঝতে পেরেছে।বারবার বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে এই পথ থেকে কিন্তু পারেনি।অনুতপ্ত হয়েছে বারবার।বাবুদের এই পথ থেকে বেরিয়ে এলে,তাদের মন যুগিয়ে না চললে যে অনেক ক্ষোভের মুখে পরতে হবে সে ভালো করেই জানে সুলতা।আর এটাও জানে যে পল্লীর এই মানুষগুলোর অধিকার ফিরিয়ে আনার জন‍্য তাকে বাবুদের রক্ষিতা হয়েই থাকতে হবে।তাই মন না চাইলেও সবকিছু মানিয়ে নেয়,সহ‍্য করে।
গোলক মানুষটা সারা জীবনই পর খেকো স্বভাবের।আর যে মানুষটা অর্থের জন‍্য নিজের বউকে পরের সাথে শুতে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না,সেই মানুষ যে সম্পূর্ণ মেরুদন্ডহীন তা বলাতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।বীরেশ্বরের গলার স্বর শুনেই গোলক —
কি আনচে আইজক‍্যা দেহি।
—- মিনসার ভাব দ‍্যাহো।বউ শরীল পাইতা দে এনকাম করতিচে আর উনি সেই এনকামের ট‍্যাহা দে ফুত্তি মারতিচে,লজ্জাও নাই।
গোলক চুপচাপ শুনে যায়,কোনো উত্তর করে না।সুলতা একটা ছোটো টুল দিয়ে —
বইসো।বড়োবাবু আইচেলো,কি কইলো কিচুই কেউ বোজে নাই।তুমি যদি এট্টু বুজায়ে সুজায়ে আমারে কউ তা হইলে আমি সগলরে কইতে পারি।
বীরেশ্বর নিজেও তেমন কিছু জানে না।ফুলো মাতব্বরি দেখাতে ব‍্যস্ত।সমাজে এমন বীরেশ্বরের অভাব নেই।কূট চরিত্র থেকে শুরু করে অর্থ ও প্রতিপত্তির জোরে,সমাজের সাধারণ মানুষ এদের না মানলেও এরা নিজেকে খুব বড়ো মনে করে।এদের সামনে কেউ কিছু বলার সাহস না পেলেও পিছনে কটুক্তির ঝড় বইয়ে দেয়।সময় এলে সাধারণ মানুষ যখন এদের মুখের উপর এদেরই কু-কর্মের জবাব দিয়ে দেয়।তখন খসে পড়ে এদের অহংকার।
— আমি কি ওইসব তেমন জানি নাকি।বড়োবাবু এসেছিল,তোরা তার কাছ থেকেই শুনতে পারতিস।
— তিনি কত কতা যে কন,সে তো সগলেই জানে।সে আর কইতে।
— তা অবশ‍্য ঠিকই বলেছিস।
—- তা আমাগে মাঠ-ঘাটে যাওয়া বন্দ হইয়া গেল, কিচু তো করতে পারো।মুহে এত চ‍্যাটাম চ‍্যাটাম কতা কও আর কাজের বেলায় লবডঙ্কা।
— অমন করিস কেন।চল ঘরে চল।দুদিন হল তোর কাছে আসিনি।
— আর আইতে হইবো না তুমারে।আইজক‍্যা এতোডা বচ্চর হইলো,সরকারের খাস জমিনে ঘর বাইদা আচি,আমাগে নামে এই খাস জমি লিকা দিবা,ঘর দিবা– এমনি কত ভরসা দেচো,এহন দেওনের বেলায় খালি বাঁশ দিতেচো।আর ভুটার কাডও তো অনেকের হয় নাই,খালি ভরসা দ‍্যাও আর ট‍্যাহা চাও,লজ্জা করে না?
রাগে গজগজ করে ওঠে সুলতা।বছরের পর বছর শরীর বিকিয়েছে যে আশায়,যে ভরসায় সবই মিথ‍্যা প্রতিপন্ন হচ্ছে দিন দিন।বয়স বাড়ছে শরীরেও কুলায় না।ঘোষ বাবুরা যে বড়ো বড়ো মিথ‍্যা আশা দেয়,স্বপ্ন দেখায় আর পরিবর্তে নিজের আখের গুছিয়ে দরিদ্র এই পল্লীর মানুষ সহ গোটা এলাকার মানুষকে বঞ্চিত করে,তা সকলেরই গোচরে আসছে,বুঝতে পারছে সকলেই কম-বেশি।সুলতার কথা আর মেজাজ দেখে বীরেশ্বর উঠে দাঁড়িয়ে বলে —-
তোদের বড়ো বাড় বেড়েছে।দিন কয়েক ধরে দেখছি আর পাত্তা দিসনা আমাদের।মাস্টারের সাহসে তোদের সাহস বেড়ে গেছে না?তোদের সব কটার ব‍্যবস্থা হবে।
—– হঅঅঅঅ যাউ যাউ,কি করতি পারো দ‍্যাহা যাবেনে।এই সুলতারেও চ‍্যানো না কইয়ে রাকলুম।প‍্যাটের দায়,আর তুমাগে চালে পইর‍্যা শরীর হান ব‍্যাচে দিচি তো কি হইচে।মাস্টারের সাতে কইয়‍্যা থানায় যামু,কেচ কইর‍্যা আইমু।
—– তোদের এত বড় সাহস আমার নামে থানায় অভিযোগ করবি?আরে ও সব আমার হাতে,থানা পুলিশ সব।আমাদের ক্ষমতা জানিস এখনো?আমাদের কথায় ওরা ওঠে বসে।
মেজাজ নিতে নিতে বীরেশ্বর চলে যায়।সুলতা কান্নায় ভেঙে পড়ে।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।এতক্ষণ হওয়া সুলতা আর বীরেশ্বরের প্রতিটি কথাই গোলক ঘরে বসে শুনছিল কিন্তু বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ সে করেনি।বীরেশ্বর চলে গেলে বারান্দায় বেরিয়ে এসে সুলতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।দুজনেই কাঁদতে থাকে।গোলক বুঝতে পারে নিজের ভুল।যে পাপ সে এতদিন করেছে,নিজের স্ত্রীকে অন‍্যের বিছানায় ঠেলে দিয়েছে তার প্রায়শ্চিত্ত সে কিভাবে করবে খুঁজে পায় না।চোখের জল বুক বেয়ে নামতে থাকে দুজনেরই।
—– বাবুগের এই অত‍্যাচার থেহে আর কবে আমারে মুক্তি দ‍্যাবা কইতে পারো?সেই চোদ্দ বচর বয়সে তুমার ঘরে আইচি,এক দিনের লগেও না দ‍্যাকচি বাপের বাড়ির মুক,না যাইচি কোনোহানে।যহন বাবুরা কু-দেষ্টি দ‍্যাচেলো,ভয় দেহাইতো,ওগে কতা না শুনলা তুমার ক্ষতি করবে কইতো,তহন ভয় পাইয়া আর ভুল কইর‍্যা ওগে ফাঁদে পা দিচি।হঅঅ স্বীকার করতিচি ট‍্যাহার লোভও সামলাইতে পারি নাই,তা তুমি তো একবারের লগে আমারে শাসন করতে পারতা।কউ পারতা না?একবারও কি জানতে চাইচো আমার শরীরহান চলে ক‍্যানা।নিজের মতো নিজে কাজ কইর‍্যা আইচো,খাইয়ে ঘুমায় পড়চো।তুমার সামনে বাবু আহে যায়,আমারে ভোগ করে,খুবল‍্যা খুবল‍্যা খায় শরীরডারে,একবারও কি জানতে চাইচো কেম্বায় আচি আমি?
—- ভুল করচিরে পাগলি,ভুল করচি।ট‍্যাহার লোবে তোর ভালোবাসা বুজবারে পাই নাই।আমারে মাপ কইর‍্যা দে।
হ‍্যাঁ,ভালোবাসা ফিরে আসে নতুন করে,এমনই শতশত সম্পর্কের দোষ-ত্রুটি একে অপরের প্রতি মার্জনায়।ভালোবাসাগুলো নতুন করে জন্ম নেয়।দাম্পত‍্য জীবনের সুখ-দুঃখের মিলন মেলায় বহু সম্পর্ক নতুন করে সৃষ্টি হয় আবার বহু সম্পর্কে জং ধরে ধরে ক্ষয় হয়ে যায়।
কিছু সময় চুপচাপ থাকে দুজনেই।একটু রাত হলে সুলতা —-
চলো,রাত হইলো অনেকটা,খাইয়ে আসি চলো।
—- হঅঅ চল।
খেতে বসে গোলক —-
কি হইবো ক‍্যাডা জানে।আজ চার দিন হইলো,কাম-কাজ কিচু নাই।চরে কেউ তেমন যাইতে পারে না শুনলাম।ভুলোর ছলডারে যে বাবু হাসপাতালে নে যাইচেলো,ওই বাবুরে বইলা কইয়া সগলে এগবেলা কইর‍্যা চরে যাইতে পারতেচে।এগে তবু যা টুকটাক কাজ হইতেচে আমাগে তাও হয় না।শহরে সব কাজ বন্দ।যাওনের আর উপায় নাই।এগে কত অপমান করচি চরে কাজ করে বইলা, আজ বুজতিচি শহরের বাবুগে সাতে কাজের চাইতি ইচামতীর চরে কাজ করা অনেক ভালো।
—- ঠিক কইচো।দ‍্যাহো ভুলোডারে,ও তো এদ্দিন হইলো ইচামতীর বুকি মাচ ধইর‍্যা সংসার চালাইতেচে।বাবুগের কতার মদ্দি নাই।আজ আমিও কইতিচি,ওই হারামখোর বীরে বাবু আইলে ওর মুকে ঝ‍্যাটা দিমু,দেহি ওর কোন বাপ ঠ‍্যাহায়।
—- তাই করবি।ওরে এক্কেরে ধুইয়া ছাড়বি।আমিও মাস্টাররে কবানে।যাবানে সহাল হইলে মাস্টারের বাড়ি।
—দ‍্যাহো অতো চিন্তার কিচু নাই,আমারে দুর্বল ভাববানানে একদম।বাবুগে ভয় পাওনের দিন চইলা গ‍্যাচে।আর সহাল হোক,ভুলোরে কইবানে,ওর সাতে মাচ ধরতি যাইয়েনে কাল থেহে।যা চাড্ডে পয়সা হয়,খাওনের মাচ হয়।
—- বইল‍্যা দেহিস তালে।
খাওয়া-দাওয়া সেরে দুজনে ঘুমাতে যায়।একটা সম্পর্ক নতুন করে গড়ে ওঠে।ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো উপচে পড়ে।মানুষের মন জটিল হলে,সম্পর্কে অবনতি হবেই।আর খোলা মনে নিজেদের ভুল স্বীকার করলে,পরস্পর পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করলে,যে কোনো সম্পর্কের উন্নতি অবশ‍্যম্ভাবী।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *