• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক T3 অরিজিনাল মিনি সিরিজে নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী (পর্ব – ৩)

ইংরেজ কখনও এদেশে আসেনি – ৩

বয়স্ক মানুষদের তো বটেই এমনকি আমার মত যাদের বয়স বছর চল্লিশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে তাদের মনে থাকবে প্রায় বছর কুড়ি আগেকার একটি রাজনৈতিক ঘটনা।
সে বছর সবে ভোট শেষ হয়েছে। কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে এমন একটি দল যার তৎকালীন প্রধান নেত্রী জন্মসূত্রে ভারতীয় নন। বৈবাহিক সম্পর্কে তার এদেশে আগমন এবং তারপর একের পর এক পারিবারিক বিপর্যয়ের পর পরিবার তন্ত্রে বিশ্বাসী একটি একদা সর্বভারতীয় দলের হাল ধরার সুযোগ আসা। শেষ পর্যন্ত তা তাঁর সামনে এনে দেয় এক পরম সুযোগ, যা যে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ক্যারিয়ারের চরম এক মাহেন্দ্রক্ষণ। দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ!
কিন্তু সেবার সেই জন্মসূত্রে বিদেশিনী নেত্রী তার প্রখর রাজনৈতিক চাতুর্য দিয়ে একটা সহজ সরল কথা বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতের মানুষ জন্মসূত্রে একজন ‘দেশের মানুষ’ না হলে তাঁর শাসন মেনে নেবে না। তারপর তিনি কী করেছিলেন তা সকলেরই জানা। সেই ‘ঐতিহাসিক ভুলের’ সুফল বা কুফল আমরা দীর্ঘ কয়েক বছর যথাসম্ভব ভোগ করেছি। সে কথা এখানে ফেনিয়ে আর লাভ নেই।
শুধুমাত্র ভারত নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের প্রায় একই রকম স্বভাব, বিদেশি শাসকের ‘মধু’র থেকে দেশি শাসকের ‘চাবুক’ খেতেও তাদের আপত্তি নেই। বাঙালিও তার ব্যতিক্রম নয়। একজন বাঙালি কি নির্বাচিত প্রশাসনিক প্রধানের পোস্টে, এক বাঙালিকে ছাড়া অন্য কারোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে?
অথচ ‘নিজের দেশের মানুষের শাসন ছাড়া আমরা পরাধীন’, এই বোধ কিন্তু স্বভাবদাস বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সব সময় ছিল না।
একথা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই মধ্যযুগের হিন্দু সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষদের সামাজিক আচার, প্রথা, কৌলিন্যের দাপটে ভারতের অন্যান্য প্রান্তের মতোই, সমাজের এক বিরাট অংশ ছিল অবহেলিত, বিরক্ত।
কিন্তু একথা মনে করারও কোন কারণ নেই যে সেই সুদূর তুর্কি, আফগান বা পারস্য থেকে একদল শাসক এল এবং তারা বাংলার নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষজনকে দেখল আর তাদের বুকে টেনে নিল। তারপর সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে রাজ্য শাসন করতে শুরু করে দিল।

কোন বাঙালির যদি এমন কোন ইউটোপিয়া থেকে থাকে তবে বিজাতীয় শাসন যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা বোঝানোর জন্য আমি তাদের মাত্র কয়েক দশক আগেকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিকে একবারটি কষ্ট করে তাকাতে বলব।

ধর্মের যে জিগির তুলে ‘বেরাদার হামি আর তুমি একই, তাই হামার কাছে এস’ বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যাওয়া একদল বিজাতীয় শাসক যদি এই বিংশ শতাব্দীতে বসবাস করেও হাজার উনিশশো পঞ্চাশ থেকে একাত্তরের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে বিনা প্রভোকেশন হাসতে হাসতে পচিয়ে গলিয়ে খুন করে ফেলতে পারে, শুধুমাত্র তাদের সংস্কৃতি আলাদা বলে, ভাষা আলাদা বলে, তবে আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে একদল আগ্রাসী স্বৈরাচারী একনায়ক (রাজা, সুলতান বা নবাব – দিনের শেষে সকলেই একনায়ক, তাই না?) বিজিত জাতির সঙ্গে কী ব্যবহার করেছিল তা সহজেই অনুমেয়। সে যুগে তো আর অ্যান্টেনি মাস্কারেনহাস ছিলেন না যে ‘রেপ অফ বাংলাদেশ’ লিখে ডকুমেন্টশন করে রাখবেন।
সোজা কথা হল তুর্কি আক্রমণে সমগ্র বাংলা বিপর্যস্ত হয়েছিল। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ভেঙে পড়েছিল। পারস্য উপসাগরীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালির কোনরকম পরিচয় ছিল না। সেই বিদেশী বিজাতীয় সংস্কৃতি প্রতিটি স্তরের বাঙালিকে বিপর্যস্ত করেছিল। তুর্কি শাসকদের সঙ্গেই এসেছিলেন দরবেশ, উলেমা, আওলিয়ারা। এই উলেমা দরবেশদের তৎকালীন রাজনীতিতে প্রভাব ছিল অপরিসীম। দিল্লির সুলতানি আমলের তকত ই তাউস হোক বা মুঘল আমলের দিওয়ান- এ- খাস বা দিওয়ান -এ -আম, এই তুর্কি দরবেশ আউলিয়ারা রাজনীতিতে ক্ষমতার সমীকরণে এক প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
গত সপ্তাহে লিখেছিলাম ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস আমাদের কাছে মাত্র ইংরেজ শাসনের দুশো বছরের নয়। বরং সেই গজনীর মেহমুদের আক্রমণের সময় থেকেই বৃহত্তর ভারতবর্ষ তুর্কিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। সেই দরবেশ আর উলেমারা ছিলেন হিন্দুস্তান উপনিবেশে তুর্কিস্তানের শাসকদের চোখ আর কান। আর অবশ্যম্ভাবীভাবে সেই উপনিবেশের সীমানা থেকে বাঙ্গালা প্রদেশ বাদ পড়েনি, বরং তা ক্ষমতার সম্প্রসারণের, মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার এক মূল কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
বাংলায় যখন বিজাতীয় তুর্কি সুলতান রাজত্ব করতে শুরু করেন তখন বাংলার বিভিন্ন প্রাচীন রাজশক্তিগুলি গৌড়ের থেকে দূরের ভূখণ্ডের জমিদারে পরিণত হয়। এমনই এক রাজবংশ ছিল দিনাজপুরের ভাদুরিয়া অঞ্চলের জমিদারেরা। বাংলার সুলতান এই ভাদুরিয়া অঞ্চলের স্বাধীন জমিদারদের স্পর্শ করতে পারেননি। এরা সরাসরি দিল্লির রাজ শক্তিকে প্রতীকী মান্যতা দিয়ে চলতেন। সেই প্রতীকী বশ্যতার মূল্য ছিল বার্ষিক এক টাকা। মাত্র এক টাকা।
আর এই জমিদারদের একজন ছিলেন রাজা গণেশ নারায়ন। বাংলায় মধ্যযুগের প্রথম যথার্থ অর্থে ‘স্বাধীন’ নৃপতি। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাঙালি এই অসাধারণ বর্ণময় চরিত্রটির ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানে না। তিনি ইতিহাসে অবহেলিত। যেটুকু তাঁর ব্যাপারে পাওয়া যায় তা তৎকালীন গোয়েবলীয় সুলভ মিডিয়ার প্রোপাগান্ডার মতো শোনায়।
মধ্যযুগের বাংলার ঐতিহাসিকরা তাঁকে এড়িয়ে গিয়েছেন। ইনবাউলগুমর ও রিয়াজ-উস-সালাতীন নামে দুটো ফারসি বইতে তাঁর ব্যাপারে ধর্মীয় রং মাখানো কিছু বিকৃত ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই নেই। ব্যাপারটা একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। কে বলতে পারে বাঙালি হয়তো মধ্যযুগের অন্ধকারের মধ্যে একজন স্বাধীনচেতা মেরুদন্ড থাকা মানুষকে খুঁজে পেতে পারে।
অন্য অনেক রাজা নবাব সুলতানের মতোই রাজনীতির পঙ্কিল পথে গণেশনারায়ন রাজা হয়েছিলেন যাকে সরিয়ে, তিনি হলেন শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ। অপদার্থ, প্রমোদপ্রিয় শাসক বায়াজিদ। গণেশের এক মন্ত্রী ছিলেন নরসিংহ নাড়িয়াল। নরসিংহ নাড়িয়াল ছিলেন অদ্বৈতাচার্যের পূর্বপুরুষ। অদ্বৈতাচার্যকে সবসময় যে গৌড়ের সুলতানদের ‘রাডারে’ রাখা হতো তার মূল কারণ ছিল তাঁর এই রাজকীয় বংশপরিচয়। হোসেন শাহের প্রতিনিয়ত শঙ্কার কারণ ছিল, অদ্বৈতাচার্য যেন নিজের পূর্বপুরুষের অতীত মনে করে মাথাচাড়া দিয়ে নবদ্বীপ শান্তিপুরের রাজা না হয়ে বসেন।
ফিরে আসি রাজা গণেশের কথায়। রাজা গণেশ অতি দক্ষ রাজা ছিলেন। সিংহাসন দখলের অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি গৌড়বঙ্গ থেকে চন্দ্রদ্বীপ এবং বিহারের কিছু অংশের নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
বলা হয় প্রথমবার জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বাঙালির ভূমিপুত্র রাজা গণেশের সঙ্গেই মধ্যযুগের বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সুদূর চীন দেশ থেকে রাজ প্রতিনিধিরা এসেছিলেন তার সভায় সিং – চান – শেন নামে একটি বইতে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। তারপর যা হয়। দৃঢ় চরিত্র ও কঠোর ব্যক্তিত্বের স্বাধীনচেতা মানুষটির সঙ্গে তৎকালীন তুর্কি আফগান অভিজাত দরবেশদের সঙ্গে সঙ্গত কারণেই বিরোধ লেগে যায়। তারা এমন মানুষকে সিংহাসনের সহ্য করবেন কেন? তার ধমনীতে তো আর মধ্যপ্রাচ্যের রক্ত বইছে না। তাই রাজা গণেশের উত্থানকে তারা ভালো চোখে দেখেননি। তারা সাধারণ প্রজাদের সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে মিশিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলেন। রাজা গণেশ উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব ব্যর্থ হল। গণেশের মৃত্যুর পর সিংহাসনে প্রথমে বসলেন তার কনিষ্ঠপুত্র মহেন্দ্র দেব, তারপর গণেশের জ্যেষ্ঠ্যপুত্র যদু বা জালালউদ্দিন। জালালউদ্দিন সারা বাংলা অধিকার করতে সমর্থ হন ও মধ্যপ্রাচ্যের তুর্কি শাসকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শামসুদ্দিন সিংহাসনে বসার পর সভার আমিররা তাকে হত্যা করেন। শেষ হয় বাংলায় মধ্যযুগের একমাত্র স্বাধীন শাসকদের আমল। সিংহাসন ফিরে যায় ইরানি শাসক ইলিয়াস শাহীদের কাছে।
এর অনেকদিন পরে অবশ্য আর এক স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঙালির আগমন হয়। তিনি রাজা ছিলেন না তিনি ছিলেন রাজার রাজা। এখানে এত ছোট পরিসরে তাকে নিয়ে কিছু লেখার মত ধৃষ্টতা আমি দেখাব না। তাঁর নাম মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। একটি দাসত্বে অবিকার থাকা জাতিকে ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তির যে মহামন্ত্র তিনি শেখাতে চেয়েছিলেন তাকে যদি কেউ শুধুমাত্র ধর্মের গন্ডিতে আবদ্ধ রাখেন, তাকে যদি কেউ ইসকন আর গৌড়ীয় দের দ্বন্দ্ব দিয়ে বিচার করতে চান তবে তা হবে এক শাশ্বত প্রতিভার ভয়াবহ অবমূল্যায়ন।
আচার্য যদুনাথ সরকারের কথা ধার করে বলাই যায় বাঙালির দাসত্ব মুক্তির যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মধ্যাহ্ন সূর্য ব্রিটিশ আমলে এসে প্রকাশ পেয়েছিল, সেই নবজাগরণের ছোট্ট একটা প্রদীপ প্রথম জ্বালিয়েছিলেন নিমাই পণ্ডিত ও তার দলবল।
একটি দুঃখ থেকে যাবে। ছোট্ট একটা দুঃখ। ইংরেজ আমলে বাংলার মানুষ, শিবাজীর মতো একটি মোটিভেশনাল চরিত্রকে খুঁজতে গিয়ে পৌঁছেছিল প্রতাপাদিত্য অবধি। কিন্তু মুঘল আমলেরও অনেক আগে বাংলায় এক স্বাধীন নৃপতি ছিলেন। তার প্রতি শুধু তখন কেন আজও বাঙালি কোন আগ্রহ দেখায় না। সম্ভবত কোনদিন দেখাবেও না। স্বভাবদাস একটি জাতি ব্যতিক্রমী বিদ্রোহীকে সবসময় অমর করে না। ট্রাজিক করে, মাঝেমধ্যে খলনায়ক বানায়, বিস্মৃত হয়। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়। যেমন দিয়েছে, তাইহোকু বিমান ধ্বংসের পর থেকে, বহুবার।
তথ্যসূত্র:
রাজা গণেশ – শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বাংলাদেশের ইতিহাস – রমেশচন্দ্র মজুমদার ভারতের ইতিহাস – অতুলচন্দ্র রায়, প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।