সাহিত্যিক ড্যানিয়েল ডিফো লিখেছিলেন, ” When flatterers meet, devil goes to dinner “। চাটুকাররা এক জায়গায় জুটলে শয়তানের মহাভোজ জোটে। আবার দার্শনিক ভলতেয়ারের একটি উল্লেখযোগ্য উক্তি হল, ” Coquettes, kings and poets are accustomed to be flattered.” ইংরেজি অভিধানে ‘ ককেট ‘ শব্দের অর্থ দেওয়া আছে ‘ flirting girl ‘ আর ইংরেজি-বাংলা অভিধানে লেখা আছে ‘ পুরুষের মনভোলানো নারী ‘, ‘ ছিনাল ‘ ইত্যাদি। অর্থ যা-ই হোক, এই বিষয়ে এর বেশি কিছু লেখা মুশকিল। আমার কোনও ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাও নেই। বরঞ্চ কবিদের কথা একটু বলি।
যাঁরা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ কুমারসম্ভবের কবি ‘ পড়েছেন তাঁরা জানেন, প্রাচীনকালের রাজারাজড়ারা, এমনকি তাঁদের রূপসী, গুণবতী মহিষীরাও গুণের অকুণ্ঠ কদর করতে জানতেন। রাজা বিক্রমাদিত্য হোন বা সম্রাট আকবর, তাঁদের রাজসভায় কবি,গায়ক, শিল্পীদের যোগ্য সম্মান ও সমাদর ছিল। ছিল পারিতোষিক লাভের অঢেল সুযোগ। সেই সময়ের কবিরাও রাজানুগ্রহ পাবার জন্য চেষ্টার কসুর করতেন না।
শরদিন্দুর উপন্যাসের নায়ক কালিদাস অবশ্য তেমন চেষ্টাটি মোটেই করেননি। তাঁর অসাধারণ কাব্যপ্রতিভায় রানি ভানুমতী সবিশেষ মুগ্ধ অনুরাগিণী হয়ে পড়লেন। রানির সঙ্গে রাজা বিক্রমাদিত্যও ক্রমশ মহাকবির সেই কাব্যসুধার স্বাদ পেলেন। অতঃপর কালিদাস সসম্মানে রাজার নবরত্ন সভায় শামিল হলেন। এই অনুপম, সুখপাঠ্য উপন্যাসটি যাঁরা পড়েননি, একবার পড়ে দেখতে পারেন, যথেষ্ট আনন্দ পাবেন।
কালিদাসের ব্যাপারটা ব্যতিক্রম, অ্যান্টনি কবিয়ালরাও তা-ই। বাকি সব কবি ওঁদের মতো নন। ‘ কবিযশপ্রার্থী ‘ কথাটি এমনি-এমনি আসেনি। ‘ হীরকরাজার দেশে ‘ ছবির সভাকবিকে স্মরণ করুন। রাজরোষ এড়াতে ফরমায়েশি কবিতা লিখতেই হয়। কে আর সুখের চাকরি খোয়াতে চায় ! কাজেই জীবন ও জীবিকার দায়ে তোষামোদ রপ্ত করতে হয়, চাটুকারিতা পাখনা মেলে।
এই কবিতা বিষয়টায় আবেগ যতখানি আছে, বেগ-ও কিছু কম নেই। কবিদের কবিতা পায়। সেই কাব্যবেগ, অন্যান্য জৈবিক বেগের মতনই, একবার এসে গেলে আর চেপে রাখা যায় না। আর সব কাজ ফেলে কবিতা লিখে ফেলতেই হয়। এবং লিখে ফেলার পর লোককে সেই কবিতা শোনাতে না পারলে অন্তরে অনন্ত অতৃপ্তি অধিষ্ঠান করতে থাকে।
সম্প্রতি প্রয়াত কবি ও সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন সরস ভঙ্গিতে শোনালেন তাঁর এক ব্যক্তিগত ‘ করুণ ‘ অভিজ্ঞতার কথা। জনৈক উঠতি কবি নবনীতার সঙ্গে দেখা করতে পকেটে কবিতা নিয়ে সটান তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির। দুর্ভাগ্যবশত নবনীতা সেই সময় বাড়িতে ছিলেন না। একরকম প্রায় জোর করেই সেই আগন্তুক কবি অনিচ্ছুক অমর্ত্য সেনকে গুচ্ছের কবিতা শুনিয়ে আসেন। কী অত্যাচার !
বাংলা রম্যসাহিত্যে কবিদের নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি কম হয়নি। স্থান-কাল-পাত্র তথা পরিমিতিবোধের অভাবহেতু কিছু কবি হয়তো নিজেদের রঙ্গ-তামাশার পাত্র করে তুলেছেন। তা না হলে এই অশ্রদ্ধা বা অসম্মান কবি ও কবিতার প্রাপ্য নয় কোনওভাবেই।
আমার এক বন্ধু সমাজ মাধ্যমে প্রতিদিন রাশি-রাশি কবিতা-পোস্টের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তার বন্ধুতালিকা থেকে বেছে-বেছে কবিদের ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ” কী কুক্ষণেই যে প্রথম-প্রথম কোনও বন্ধুর কবিতা-পোস্টে প্রশংসা, মন্তব্য করতাম ! সেইটেই আমার কাল হল, বুঝলি ? ” বান্ধবীর অকপট স্বীকারোক্তি।
এই পোস্ট-মর্ডান সময়েও অনেক কবিকে জানি যাঁরা নিজস্ব গোষ্ঠী ও গণ্ডিতে থাকতেই বেশি ভালোবাসেন। গোষ্ঠীভুক্ত প্রায় সবাই কবি কিংবা কবিতাবোদ্ধা। তাঁদের মধ্যে স্তাবক বা চাটুকারও কি কেউ নেই ? পারস্পরিক কবিতাচর্চা, কাব্য-আলোচনা, প্রশংসাপানে দিন দিব্য কেটে যায়।
তবে কবিদের কুদরত যতই রঙ্গি-বিরঙ্গি হোক না কেন, কবিরা সকলেই চাটুকারিতায় অভ্যস্ত — এই সরলীকরণ মেনে নেওয়া অসম্ভব।
বাকি রইলেন রাজারা। গণতন্ত্রে কারা রাজা সেটা আর খোলসা করে বলে দিতে হবে না। ” বাবু যত বলে পারিষদদলে বলে তার শত গুণ “– এর যুগ পেরিয়ে এই আধুনিক সময়ে, মহাপরাক্রমশালী রাজনীতির আবহে রাজ-অনুগ্রহ, সুযোগসুবিধাসহ সমাজে নানাবিধ কল্কে পাবার আশায় ক্ষমতার চারপাশে অজস্র স্তাবক-চাটুকারের ভনভনানি, তাঁদের মধ্যে, কিমাশ্চর্যম্ ! কবি-সাহিত্যিকও থাকেন।
ভলতেয়ার মিথ্যে বলেননি। চরাচরের অগণিত ফ্লেক্স,কাট-আউট, ‘ অনুপ্রেরণা ‘-ও মিথ্যে বলে না।