সমাজ আয়নায় পায়েল চ্যাটার্জী

অনুচ্ছেদ নম্বর ১৫ এবং ইউটোপিয়া…একটি কাল্পনিক কথোপকথন..
-ভারী! বড্ড ভারী হাটুঁদুটো! সাঁড়াশির মতো চাপ।দম বন্ধ লাগছিলো! অবশেষে মুক্তি।
-আমারও কষ্ট হতো! দমবন্ধ লাগতো।লোকজনের কটু কথা। বিদ্রুপ! ব্যঙ্গ! ঘেন্না ,ঘেন্না! নিজের জন্মের উপরেই ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। এখন এই “তারাদের দেশে” ভালোই আছি। তুমিও ভালো থাকবে এখানে। তবে তোমার দেশে তুমি এখন হিরো। আগুন জ্বলছে তোমায় নিয়ে।
-সে তো তোমায় নিয়েও লেখালিখি, প্রতিবাদ কিছু কম হয়নি।
-আসলে আমারটাতো আত্মহত্যা ছিল! আত্মহত্যার খবর লোকে খায় ভালো!
-সত্যি? আত্মহত্যাই ছিল?
-চার বছর আগের জানুয়ারি মাসের ওই দিনটা। কোন অভিযোগ ছিল না আমার কারোর প্রতি। শুধু শূন্যতা। একটুওকান্না পাচ্ছিল না তখন। কেমন একটা শান্তি। দলিত মায়ের ছেলে।গায়ের রং কালো। স্বপ্নের রঙ ধূসর। ভালবাসতে বড় ভালো লাগতো। প্রকৃতি ,মানুষ। মানুষকেও ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়। পড়াশোনা করতে এসে নিজেকেই ভালবাসতে ভুলে গেলাম। রোজ কাঁদতাম। তাই শেষ দিনে আর কাঁদিনি। স্টাইপেন্ড বন্ধ ছিল ৭ মাস। অনেক টাকা দেনা। বারবার সাসপেনশন। আর পারছিলাম না। বাবা-মায়ের মুখগুলো খুব মনে পড়েছিল।
-অনেকদিন খবরের কাগজ জুড়ে হেডলাইন হয়ে ছিলে তুমি! রোহিত চক্রবর্তী ভেমুলা।
-যেমন এখন তুমি। জর্জ ফ্লয়েড। দেওয়াল জুড়ে প্রতিবাদ। ভার্চুয়াল। তোমার দেশজুড়ে আগুন জ্বলছে। রোষানল। তবে আস্তে আস্তে সব ফিকে হয়ে যাবে দেখো।
-আমার দেশ? প্রথম সারির, উন্নত। কিন্তু আদৌ আমার দেশ? আমি বড় ভালবাসতাম আমার দেশকে। শুধু গায়ের রংটাই….! দেশ ভালোবাসেনি আমায়। তাই আমার মৃত্যুর ভিডিও করেছে। বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি।
-এখন কাটাছেঁড়া হবে। ক্ষমা-টমা। প্রতিবাদ। আমিতো মরেও শান্তি পাইনি। আমার কাস্ট নিয়ে তখনও বিস্তর কাটাছেঁড়া।
-প্রতিবাদের আয়ু বড়ই সীমিত। তোমার থেকে ভালো তা আর কে জানে! আন্দোলনগুলো বার্স্ট আউট করে ঠিকই! ,তারপর দপ করে নিভে যায়!
-“….মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়” । এই লাইনটাই আগে খোঁজা হয় মৃত্যুর চিঠিতে। শেষটা আগে পড়া হয়।যেমনটা আমার চিঠিতে হয়েছিল!
-দায় এড়ানোর উপায়! কিন্তু ভেতরের দায়? ওটা এড়ানো যায়?আমি তো চিঠি লেখার সময়ই পেলাম না!
-তুমি সুধাকর এর কথা জানো? ও কয়েকদিন আগেই এসেছে এখানে। চেন্নাইয়ের তিরুভান্নামালাই এর ছেলে। ভালোবাসা, বিয়ে। উঁচু জাত। কতটা উঁচু? মাপতে পারেনি বোধহয়! পিটিয়ে খুন! বৌটা আজও পাথর!
-আমি ট্রেইভর মার্টিনকে চিনি। ফ্লোরিডার স্কুলছাত্র।২০১২। চারটে গুলি। শরীর এফোঁড় ওফোঁড়। বন্দুকের রংটা ওর গায়ের রঙের মতই ।ডার্ক। এখানে নিশ্চয়ই ওর দেখাও পাবো।
-আমি দেখতে পাই এখান থেকে। বাপুরাও তাজনে। বিদর্ভের দলিত শ্রমিক। ২০১৬।জল তেষ্টা। স্ত্রী জল চাইতে গিয়েছিল। কিন্তু ওরা উচ্চবর্ণের। তাই অপমান, লাঞ্ছনা জুটেছিল। বাপুরাও প্রতিজ্ঞা নিল। একটা কুয়ো। ৪০ দিন। দিন প্রতি ৬ ঘন্টা। পরিশ্রম ‘জলে’ যায়নি। অবশেষে তেষ্টা মিটল।খাবার জল।কিন্তু ওদের কাছে এসব ঐকিক নিয়ম। ওদের ছেলেমেয়েদের অংকের বইতে থাকে।
-সান্ড্রাও তোমার মত আত্মহত্যা করেছিল। ২০১৫। টেক্সাস। কৃষ্ণাঙ্গ যুবতী। একটা জ্বলন্ত সিগারেট। অপরাধ।। মানতে পারেনি অপমানটা। Asphyxia!
-অশিক্ষার পাথর গুলো এখনো আছে। হায়দ্রাবাদ। ১৪ বছরের লাভণ্যা। স্কুলের সহপাঠীরা গায়ের রং নিয়ে মজা করত। বলতো পোড়া রং। মেয়েটা একেবারে পুড়িয়ে দিয়েছিল নিজেকে। আগুনে।
-সমাজের নিঃশ্বাসে রেসিজম। So,we can’t breathe!
-আমাদের সংবিধান। আর্টিকেল ফিফটিন। বৈষম্যহীনতা। সাম্যের অধিকার। শুধু কথায়।
-ফেয়ারিটেল!
-সোনাঝরিয়া মিনজকে দেখে আমি খুশি । আশার আলো। ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী। বর্ণবিদ্বেষ, লাঞ্ছনা, হেনস্থা। রেহাই দেয়নি স্কুলের শিক্ষকরাও। সংস্কৃতের রেকর্ড নম্বর। তবুও কটু কথা। “আর্যদের এই ভাষা”। থেমে যায়নি যদিও আমার মত। পরেরটা ইতিহাস। স্বাধীনতার পর এই প্রথম। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
-নিশ্বাস নিতে পেরেছিল তাহলে।
-জানো খুব স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে আজও। সুধাকর ভালোবাসছে ইচ্ছেমত। কোন বাধা নেই। মার্টিনকে কেউ ব্যঙ্গ করছে না। বাপুরাও এর বউ জল আনতে গেছে। তেষ্টা মিটেছে। অনেকটা জল। কোন বিভেদ নেই। লাভণ্যা স্কুলে গেছে। ওর প্রিয় সহপাঠীর পাশে বসেছে। সহপাঠীর ধর্ম-বর্ণ-জাতি কি? কেউ জানে না। জানতে চায়ও না। এমনকি হবে কখনো?
-“I want to find a happy ending even if it isn’t mine”.