শিকড়ের সন্ধানেতে আজ “সর্বমঙ্গলা মন্দির” – লিখেছেন দেবেশ মজুমদার

লৌকিক দুর্গা হিসেবেই পুজো পেত বর্ধমানের দেবী “সর্বমঙ্গলা”
বর্ধমান জেলাতেও অসংখ্য লৌকিক দুর্গা আছে যাঁরা ঠিক দুর্গাপুজোর দিনে কিংবা অন্য কোন সময়ে মা দুর্গা হিসাবে পূজিত হন। বর্ধমান শহরেই আছেন এমনই এক লোক-দুর্গা। তার নাম ‘সর্বমঙ্গলা’। দক্ষিণডিহির ‘অট্টহাস’, কাঁদড়ার ‘বহুলক্ষ্মী’। ক্ষীরগ্রামের ‘যোগাদ্যা’, মাজিগ্রামের ‘শাখম্ভরী’, শুশুনা গ্রামের ‘তারিক্ষা’, হালাড়া গ্রমের ‘বিপদভঞ্জরী’, ছোটবৈনানের ‘দিদিঠাকুরণ’, আসানসোলের ‘ঘাগরবুড়ি’, আস্তাই গ্রামের ‘শুভমা’, সুয়াতা গ্রামের ‘শিবাক্ষ্যা’, দাঁইহাটের ‘সিদ্ধেশ্বরী’, সিয়ারশোল (রাণিগঞ্জ) অঞ্চলের বুড়ি আন্তিক দেবীগুলি-যেমন ‘খাঞ্জিবুড়ি’, ‘খুদারবুড়ি’, ‘হারাবুড়ি’ প্রভৃতি।
প্রাচীন বর্ধমানের আদি গ্রামদেবী ‘সর্বমঙ্গলা’। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত লোককাহিনিগুলি জানান দেয় যে, একসময় তিনি ছিলেন বাগদিদের দেবতা। তখন তাঁর নাম ছিল ‘মঙ্গলা’। আদিকালে তিনি পুজো পেয়েছিলেন শিলাখন্ডে, যে শিলাটির ওপর এক সময় বাগদিরা শামুক ভাঙতেন। উত্তর বর্ধমানের বাহির সর্বমঙ্গলা পল্লীতে এক বাগদি বাড়ি থেকে দেবীমূর্তিটিকে উদ্ধার করেন রাজা চিত্রসেন রায় (১৭৪১-১৭৪৪) এবং বর্তমান মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। মূর্তিটি অষ্টাদশভূজা কৃষ্ণ বর্ণ কষ্টি পাথরের সিংহবাহিনী ও মহিষমর্দিনী দেবীমূর্তি, আকৃতি ১২ ইঞ্চি X৮ ইঞ্চি। ১৮ টি হাতে অস্ত্র কিংবা বিভিন্ন মুদ্রার ভঙ্গি। দেবী শূলাঘাতে মহিষাসুরের বক্ষ বিদীর্ণ করছে। এই মূর্তিকে মন্বন্তরা মূর্তি বলে। রাজা চিত্রাসেন রূপার সিংহাসনে দেবীকে অধিষ্ঠিত করেন। মূর্তির নিম্নে অস্পষ্ট কি লেখা আছে তা পাঠোদ্ধার করা যায়নি। মহারাজ মহতাব চাঁদ ঐ লেখার ছাঁচ নিয়ে পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোন ভাষায় লিখিত তা কেউই বুঝতে সক্ষম হন নি। মূর্তিতে পৈশাচী ভাষায় লেখা- অনার্য দেবী ও বৌদ্ধ ভাস্কর্যের প্রভাব দেখা যায়। এখন তিনি পৌরাণিক দুর্গার আদলে পুজো পান। শারদীয় মহাসপ্তমী থেকে মহাদশমী পর্যন্ত তো তাঁর মহা-উৎসব। এছাড়াও বাসন্তী পুজোর চারদিনেও তাঁর বিশেষ পুজো হয়।
দেব সর্বমঙ্গলা মন্দির বর্ধমান শহরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মন্দিরটি যে বেশ প্রাচীন তার প্রমান পাওয়া যায় ষষ্ঠ শতকের অনুলিখিত কুব্জিকা তন্ত্র গ্রন্থে শ্রী বর্ধমান মঙ্গলাদেবীর পীঠের কথা উল্লেখ আছে। পরবর্তীকালে,আদি চণ্ডীমঙ্গল রচনাকার মানিক দত্ত এই নূতন বর্ধমানকেই দেবী পীঠ ‘বড় বর্ধমান’ বলেছেন। এ ছাড়া রামানন্দ যতির চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে, মানিক গাঙ্গুলীর ধর্মমঙ্গল ও ভরতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর কাব্যে সর্বমঙ্গলা দেবীর উল্লেখ আছে। সর্বমঙ্গলার প্রাচীনত্বের নিদর্শন পাওয়া যায় রূপ রাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে। বর্ধমানে বান্দোদেবী সর্বমঙ্গলা।/ অধিষ্ঠান হন দেবী ঠিক দুপুর বেলা।
বর্ধমানের আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ নীরদবরণ সরকারের সাথে কথা বলে জানা গেল অন্যএকটি কাহিনী। প্রাচীন বর্ধমানের বাহির সর্বমঙ্গলা পাড়া তখন ধানক্ষেত, পুকুর, খাল বিল পূর্ণ একটি জলাভূমি। ওই এলাকায় বেশীর ভাগ মানুষ ছিল বর্গক্ষত্রীয় সম্প্রদায়ের। পুকুর গুলি থেকে ছাক্নি দিয়ে জিওল মাছ, গুগলী, শামুক, কাঁকড়া ধরে বিক্রি করাই ছিল তাদের পেশা। একদিন একজনের জালে একটি শিলার মত পাথর পাওয়া যায়। তারপর ওরা ঐ পাথরের উপর গুগলী, শামুক থেঁতো করতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য্যের কথা প্রতিদিনের আঘাতেও ঐ শিলামূর্তির কোন বিকৃতি ঘটে নি। শামুকের খোলার সাথে ঐ শিলাটি একদিন দামোদরের তীরের চুন ভাটায় বিক্রি হয়ে যায়। কারণ তখন ঐ সব জলজ প্রাণীর দেহবাশেষ পুড়িয়ে চুন উৎপন্ন হতো। গুগলী, শামুকের সঙ্গে দেবীমূর্তিও অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত করা হয়। কিন্তু আগুনেও ঐ শিলার কোন রূপ বিকৃতি হয় নাই। সেই রাত্রেই বর্ধমান মহারাজ স্বপ্নাদৃষ্ট হন। স্বপ্নে রাজা আদেশ পান দেবী-সর্বমঙ্গলার কাছে, আমি দামোদরের তীর চুনের ভাটায় শিলারূপে আছি, আমায় তুমি উদ্ধার করে, রাজবাড়ীর পাশে মন্দির তৈরী করে,প্রতিষ্ঠা করে, আমার পুজো করো। ভোর হতে না হতেই মহারাজা ঐ চুন ভাটায় যান । গিয়ে জানতে পারেন, তিন ব্রাহ্মণ ঐ শিলাটি পূজা করার জন্য নিয়ে গেছেন। ঐ খবর জানা মাত্রই রাজা ঐ ব্রাহ্মণদের সন্ধানে গিয়ে তাঁদের সাথে দেখা করে মায়ের ঐ আদেশের কথা শোনান। কিন্তু ব্রাহ্মণগণ দেবী বিগ্রহকে রাজার নিকট দিতে অস্বীকার করেন। মহারাজা অনেক অনুরোধ করলেও ব্রাহ্মণেরা দেবী বিগ্রহ রাজাকে দিতে সম্মত হন না। তখন রাজা প্রস্তাব করেন দেবীর অধিকারী ব্রাহ্মণেরাই হবেন। মহারাজা শুধু পূজার ব্যয় নির্বাহ করবেন। সে ব্যবস্থা অনুসারে আনুমানিক তিনশ বছর পূর্বে বর্তমান বর্ধমানের পূর্ব দক্ষিণ অংশে সর্বমঙ্গলা মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজ অবধি পূজা পেয়ে আসছেন এবং বর্ধমান রাজ ও সেই প্রাচীন ব্যবস্থানুযায়ী দেবীর যাবতীয় নিত্য ও নৈমিত্তিক পূজার ব্যয় বহন করে আসছিলেন। সেই মত মহারাজা রাজবাড়ীর কাছে মন্দির নির্মাণ করে দেবীর শিলামূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এই তিন জন ব্রাহ্মণই ছিলেন বেগুট গ্রামের। একবার শোনা গেল কালাপাহাড় আসছে মন্দির ধ্বংস করতে। এই সংবাদ শুনেই মন্দির তালা লাগিয়ে ওই তিন ব্রাহ্মণ পালিয়ে যান। দেবীর বহু দিন পূজা হচ্ছে না দেখে বর্ধমান মহারাজ বাঁকা নদীর সংলগ্ন এক তান্ত্রিক সাধককে পূজা করার জন্য নিয়ে আসেন। কিছু দিন পুজা করার পর সাধক আর পূজার ভার নিতে ইচ্ছুক হলেন না। তখন ঐ সাধক বর্ধমান নিকটবর্তী রায়ান গ্রামের ব্রাহ্মণদের সাথে মহারাজের পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর রায়ান গ্রামের ব্রাহ্মণেরাই দেবীর পুজার ভার নেয়। এরপর সেই আগেকার তিন ব্রাহ্মণ ফিরে এসে ঐ রায়ান গ্রামের ব্রাহ্মণদের চলে যেতে বলেন। তখন মহারাজা বগুট এবং রায়ান উভয় গ্রামের ব্রাহ্মণদের পালা করে ক্রমে পুজা করার ব্যবস্থা করে দেন। এইভাবেই ঐ দুই গ্রামের ব্রাহ্মণেরাই পালা ক্রমে পুজা করছেন। সর্বমঙ্গলা দেবীর জনশ্রুতি যা হোক না কেন সর্বমঙ্গলা দেবী বর্ধমান শহরে কয়েকশ বছর ধরে অধিষ্ঠিতা আছেন। বর্ধমানের রাজারা দেবীকে প্রতিষ্ঠা করনে নাই তাঁরা বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন মাত্র।
মন্দিরের পূর্বদিকে সদর বা প্রবেশ দ্বার। বিরাট দরজা লাগান প্রবেশ দ্বার। প্রবেশদ্বার সংলগ্ন দোতলা প্রাসাদ আছে। এগুলি ছিল অতিথি শালা, কর্মচারীদের থাকার ঘর এবং পূজারীদের থাকার ঘর। এখন এখানে একতি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পোষ্ট অফিস এবং সংগীত বিদ্যালয় হয়েছে। দক্ষিণের প্রবেশ পথে ঢুকতেই সামনে পথের দু’ধারে দুটি শিব মন্দির, ডান দিকের শিব লিঙ্গের নাম চন্দ্রেশ্বর এবং বাঁ দিকের শিব লিঙ্গের নাম ইন্দ্রেশ্বর।
শিবমন্দির দুটির ঠিক সামনে অর্থাৎ উপরের আদি মন্দির নাট মন্দির সমেত। আগে ১লা বৈশাখ এবং বিজয়াদশমীর দিন জনতার ভিড় সামাল দেওয়ার জন্য এবং খাতা পুজার জন্য ওই আদি মন্দিরে বিগ্রহ নিয়ে এসে পুজা হতো। এখন আর সেই সমস্যা মিটে গেছে। এই শিব মন্দির দুটি পার হয়ে বাঁ দিকে গেলেই আর একটি প্রবেশ পথ। ঐ প্রবেশ পথে প্রবেশ করেই বাঁ দিকে তিনটি পর পর শিব মন্দির। প্রথম ও তৃতীয় মন্দিরের শিব লিঙ্গ সাদা পাথরের। নাম ‘রামেশ্বর’ ও ‘কমলেশ্বর’। আর মাঝখানের মন্দিরের শিব লিঙ্গ কালো পাথরের। নাম ‘মিত্রেশ্বর’। এক মাঝখানের মন্দিরটি বাকি দুটি মন্দির থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। অনেকটা বিষ্ণু মন্দিরের ধাঁচে। রাজ বাংশানুচরিতঃ –রাখাল দাস মুখোপাধ্যায়ের লিখিত ১১৫ প্রষ্ঠায় উল্লেখিত আছে। এই দুটি মন্দির রাজা তেজচাঁদ ১৮১৩ খ্রিষ্টব্দে নির্মাণ করেছিলেন।
শিব মন্দির তিনটির সামনে বলির জন্য হাড় কাঠ আছে। এখানেই বলি হয়। এরই উত্তরে নাটমঞ্চ এবং গর্ভগৃহ অর্থাৎ মূল মন্দির। মূল মন্দির দক্ষিণমুখী। মন্দিরের ছাদের দুতি স্তর আছে। প্রথম স্তরে চারকোণে চারটি রথ। দ্বিতীয় স্তরে পাঁচটি রথ। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে খোলা বারান্দা। বারান্দায় গায়ে কিছু টেরাকোটার কাজ আজও অবশিষ্ট্য আছে।