শিকড়ের সন্ধানেতে আজ “লোথাল” – লিখেছেন প্রাপ্তি সেনগুপ্ত

১. গুজরাটি ভাষায় ‘লোথ’ শব্দের অর্থ মৃতের স্তূপ।মৃত মানুষের ইতিহাস ছুঁয়ে দেখা যায় এই প্রত্নক্ষেত্রে। মহেঞ্জোদারোর নামের অর্থের সাথে মিল রয়েছে লোথাল নামটির।
২. আমেদাবাদ থেকে ৯৫ কি.মি. দূরে সবরমতি ও ভাগবা নদীর মাঝে ভাল প্রদেশের ধোলকা তালুকের সারগওয়ালা গ্রামের কাছে আবিষ্কৃত হয়েছে হরপ্পা সভ্যতার বিখ্যাত বন্দর নগর লোথাল।
৩. স্কুলে পড়ার সময় ভারতীয় উপমহাদেশের তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগের হরপ্পা সভ্যতার শহরের প্ল্যানিং মুগ্ধ করে নি এমন ছাত্রকে খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। সেই ৩৭০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের হরপ্পা সভ্যতারই একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-শহর ছিল লোথাল।
৪. ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের পর হরপ্পা সভ্যতার বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ শহর পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। তারপর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার খোঁজের পর ১৯৫৩ – ৫৪ সালে এস.আর.রাও, বি.বি.লাল, এস.এস.বৎস প্রমুখের প্রচেষ্টায় মহেঞ্জোদারো থেকে ৬৭০ কি.মি. দূরে ভারতের পশ্চিমাংশে আবিষ্কৃত হয় এই প্রত্নক্ষেত্র।
৫. এই প্রত্নক্ষেত্রের চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। অনেকেই এই প্রত্নক্ষেত্রকে হরপ্পা সভ্যতার নিতান্তই একটা ছোট শহর আর সেচের জলাধার বলে অভিহিত করেছেন।
৬. ১৯৫৮ সালের মধ্যে কচ্ছ মানে ধোলাভিরা ও সৌরাষ্ট্র উপকূল জুড়ে আবিষ্কৃত হয় বিস্তীর্ণ প্রত্নক্ষেত্র। ১৯৬১ সালে পুনরায় খননকার্য শুরু করে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং সবরমতি নদীর উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমদিকে নদী থেকে ডকের সাথে সংযোগকারী ইনলেট চ্যানেল খুঁজে পান। লোথাল থেকে প্রাপ্ত পোতাশ্রয়, বাজার এবং বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেকটাই সহমত হন ঐতিহাসিকরা।
৭. লোথাল পৃথিবীর প্রাচীনতম কৃত্রিম বন্দর ও পোতাশ্রয়। সবরমতি নদী দিয়ে এই বন্দর মারফত আরবসাগরের উপকূলবর্তী ধোলাভিরার যোগাযোগ ছিল। এই বন্দর দিয়ে নদীপথ হয়ে আরবসাগর দিয়ে হরপ্পা সভ্যতার মানুষ সুমের, মিশর, মেসোপোটেমিয়া র সাথে ব্যবসা করত। সুমের, মেসোপোটেমিয়া অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত হরপ্পা সভ্যতার ষাঁড়ের ছাপের সিলমোহর, যার অকাট্য প্রমাণ। আবার সুমেরিয় লিপিতে উল্লেখিত ‘মেলুকা’ অঞ্চলকে ঐতিহাসিকরা অনেকেই সিন্ধু অববাহিকা বলে মনে করেন।
৮. স্থানীয় লোককথাতেও এই অঞ্চলে প্রাচীন মানুষের বসবাসের প্রমাণ মেলে। ১৮৫০ সালেও এখান থেকে নদী পথে পণ্য পরিবহণ হওয়ার প্রমাণ মেলে।
৯. এই বন্দর দিয়ে আমদানি হত,
তামা – দক্ষিণ ভারত, বালুচিস্তান, আরব, খেতরি (রাজস্থান)।
সোনা – কর্ণাটক, আফগানিস্তান ও পারস্য (ইরান) থেকে।
রুপো – আফগানিস্তান ও পারস্য থেকে।
টিন – পশ্চিম ভারত।
সীসা – রাজস্থান, দক্ষিণ ভারত, আফগানিস্তান, পারস্য।
লাপিস লাজুলি – উত্তর – পূর্ব আফগানিস্তানের বাদাকশান, কাশ্মীর।
নীলকান্তমণি (টারকোয়াজ) – মধ্য এশিয়া, পারস্য।
যসম (জেড) – মধ্য এশিয়া।
পান্না (অ্যামেথিস্ট) – মহারাষ্ট্র থেকে।
অকীক (অ্যাজেট) – পশ্চিম ভারত।
ক্যালসেড্যানি ও কার্নেলিয়ান – সৌরাষ্ট্র ।
আর রপ্তানিজাত দ্রব্যের মধ্যে প্রধান ছিল – তুলো, পশম, তেল, বার্লি ইত্যাদি।
১০. লোথালে একটি নকশাসহ গোলাকার মেঝে আবিষ্কার হয়েছে। টেরাকোটার ঘোড়ামূর্তি, খেলনা নৌকা আবিষ্কার হয়েছে।
১১. হরপ্পার অন্যান্য শহরের পাকা বাড়িগুলির সদর দরজা চওড়া বড় রাস্তার দিকে নয়। লোথাল এর ব্যতিক্রম, এখানকার বাড়িগুলির সদর দরজার মুখ বড় রাস্তার দিকে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এই শহরে বাইরের লোকের আনাগোনা বেশি ছিল বলেই এমন ব্যতিক্রম।
১২. লোথাল থেকে প্রাপ্ত আধুনিক কম্পাসের মত দিকনির্ণয় যন্ত্র, এর বন্দর – শহর হওয়ার প্রমাণকে আরোও সুদৃঢ় করে।লোথাল থেকে যুগ্ম সমাধি আর অগ্নিবেদিও পাওয়া গেছে।
১৩. হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র থেকে বিভিন্ন পশু, পাখি এমনকি জাহাজের ছাপ দেওয়া সিলমোহর পাওয়া গেছে। তবে লোথাল বা অন্য কোনো অঞ্চল থেকেই কোনো মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় নি। তাই ঐতিহাসিকরা মনে করেন তখন ব্যবসা হত প্রধানত বিনিময় প্রথায়।
১৪. লোথালকে UNESCO -এর কাছে বিশ্ব ঐতিহ্যপূর্ণ অঞ্চল হিসাবে মান্যতা দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে এবং তা বর্তমানে তা UNESCO এর বিচারাধীন।
১৫. লোথাল এবং লোথালের মতই বাকি প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল, যেমন ধোলাভিরা, কালিবঙ্গান, রুপার ভারতে আজও হরপ্পা সভ্যতার ইতিহাসকে জীবন্ত করে রেখেছে।
ছবি সংগৃহীত