প্রবন্ধ – কেশব মেট্যা
বিদ্যাসাগর২০০/বিশেষ সংখ্যা
বিদ্যাসাগর
এই তো সবুজ শিউলি গাছ সাদা নাকছাবি পরে হাসছে। কাশ দুলছে এদিক ওদিক। প্যাণ্ডেলে কাপড়দোকানে কুমোর পাড়ায় ব্যস্ততা। তারই ফাঁকে ঢুকে পড়লেন আপনি, বিদ্যাসাগর। কতদিন দ্যাখা সাক্ষাৎ নেই বলুন তো! যাক গে , এসেই যখন পড়েছেন আপনার কোনো চিন্তা নেই। আপনি ভাবতেই পারবেন না কত্তো ধুমধামে আপনার হ্যাপি বার্থডে পালন করবো আমরা। জাস্ট চমকে যাবেন! দুশো বছর কিনা। আমরা ভুলিনি কিন্তু, যেমন সক্কলে মনে রেখেছে ইংরেজরা দুশো বছর আমাদের অত্যাচার করেছিল। তবে ইংরেজের দুশোটা অনেক পুরানো হয়ে গেছে। এই আপনার জন্মদিন দুশো বছর এবার, একদম টাটকা। ভাবতেই পারছিনা, কী যে মজা হবে!
স্কুলে স্কুলে এসে গিয়েছে সরকারি অর্ডার। ঢুকে গেছে অ্যাকাউন্টে টাকা। ওইদিন আপনার ছবি দিয়ে শোভাযাত্রা হবে সকাল সকাল। থাকবে শ্লোগান –’বিদ্যাসাগর আমরা তোমায় ভুলছি না ভুলবো না’। বিশ্বাস করুন, এরকমই অনেক অনেক শ্লোগান, যাতে ওই বস্তি অঞ্চল আর আদিবাসী পাড়ার ছেলেমেয়েরাও সহজে বুঝতে পারে আজ কারও জন্মদিন। এই ‘কারও জন্মদিন’ কথাটা শুনে রাগ করলেন তো? আপনারই যে জন্মদিন সেটা ওরা বুঝবে কেমন করে! ওরা তো স্কুলেই আসে না। পড়বে কী করে? খাতায় নাম আছে ওদের। প্রতিবছরই ওরা স্কুলে না এসেও পরের ক্লাসে উঠে যায়। প্লিজ রাগবেন না! জন্মদিনে রাগতে নেই। চুপিচুপি বলছি শুনুন – ‘ড্রপ আউট’ ওসব মুখে বলা হয়। আসলে খাতায় সব ইন। প্রধান শিক্ষক এস আই অফিসে গিয়ে বলেন–নো ড্রপ আউট। এস আই স্কুলে যদি ভিজিট করেন একদিন, তো সই করেন চারদিনের। আবার ডি আই রা তো স্কুল ভিজিট করেন উৎসব-মেজাজে। রাজ্যে রিপোর্ট করেন–’অল ইজ ওয়েল’ । এদের সবার সম্পর্কের ভেতর দারুণ একটা কেমিস্ট্রি চলে, চালু কথায় বলে ‘অয়েলিং’। এমনকি আপনার জন্মস্থান বীরসিংহ গ্রামে আপনারই প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোতে নাকি আজকাল পড়াশোনা ভালো হয় না। শুধু রাজনীতি। এলাকার উন্নয়নও তেমন হয়নি। এসব গ্রামবাসীরদেরই কথা। কিন্তু ওই এলাকার শিক্ষক আর জননেতারা বলছেন না না সবই ঠিকঠাক। অল ইজ ওয়েল। তবে হ্যাঁ এই যে আপনার বার্থডে, এটা কিন্তু কয়েকদিন ধরেই চলবে। আপনার গলায় মালা পরিয়ে নাচ গান আবৃত্তি আর বক্তৃতা আর বক্তৃতা আর বক্তৃতা। কেননা ফাঁকিবাজি আমাদের ভিত্তি, বক্তৃতা আমাদের ভবিষ্যৎ। আপনার কাজকর্মের দলিল মুখস্থ করে শোনাবেন মহান মানুষরা! এইকদিন কিছু কিছু শিক্ষক আর হোমড়াচোমড়া জননেতা খুব বিজি থাকবেন। নাওয়া খাওয়া ভুলে শুধুই আপনি আপনিই। কারণ এ সুযোগ সবসময় কি আসে!
বীরসিংহ গ্রামের ছেলে নবকুমারকে আপনি নিজখরচে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়িয়ে আপনারই প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয়ে চিকিৎসক করেছিলেন। সেই নবকুমার অর্থের লোভে ওই কাজ ছেড়ে দিয়ে নাড়াজোল রাজস্টেটের ডাক্তার হলেন। আবার আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নবকুমার নাড়াজোল রাজার হাতি নিয়ে এসে আপনার ঠাকুমার প্রতিষ্ঠিত অশ্বথ গাছের ডাল ভাঙালেন এবং গাছটিকে দিলেন কেটে। আপনি দুঃখের সাথে বলেছিলেন আপনার নিজের হাত পা কেটে দিলেও এত মানসিক কষ্ট পেতেন না।
এখন এইসব নবকুমারে দেশ ছেয়ে গেছে। এরা সবকিছুতেই উৎসব খোঁজে। এরা উৎসব করে গাছ লাগায়, কিন্তু পরিচর্যা করে না। এরাই এখন দেশ চালায়। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গাছ কাটে। কেউ প্রতিবাদ করলে জোটে উন্নয়ন-বিরোধী তকমা। আর পেছনে লেলিয়ে দেয় পুলিশ।
আপনি আপনার উপার্জিত অর্থের কানাকড়িও খরচ করেননি দেবমন্দির কিংবা দেবসেবায়। আপনার মন্দির–বিদ্যালয়। আপনার দেবতা– মানুষ। মুখে ভাষা আর পেটে খাবার , আর তো কেউ দেয়না। আপনিই প্রকৃত শিক্ষক। আপনাকে নিয়ে কথা বলি কিন্তু উৎসাহিত বোধ করি রামমন্দির-মসজিদ নিয়ে। এমনকি দীঘাতেও করতে চাই জগন্নাথ দর্শন! ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে যখন কোনো শিক্ষক বলেন–আমার বিদ্যালয়ের ভি ই সি কমিটিতে অধিকাংশ মেয়ে, তাই স্কুলের কাজ দেখাশোনায় খুব অসুবিধা। যখন কোনো শিক্ষক স্কুলে না পড়িয়ে টিউশানে সিরিয়াস পাঠদানে ব্যস্ত থাকেন। তখন আপনার কথা মনে হয়। আপনিও কি এসব শুনছেন দেখছেন ! আপনি কি এটাও জানেন আপনার লেখা ‘বর্ণপরিচয়’ ব্যাকডেটেড। প্লিজ রাগ করবেন না। তাহলে এইভাবে শুনুন–আপনি কি জানেন, আপনার বর্ণপরিচয় আর এখন স্কুল সিলেবাসে নেই। তাই কাউকে আর পড়তে হয় না–গোপাল যেমন সুবোধ, রাখাল তেমন নয়!
আজ ২০১৯। দেশ নাকি সবকিছুতে এগিয়ে। আমরা চাঁদ ছুঁতে পারি। আমরা সমুদ্রের তলদেশ এসেছি ছুঁয়ে। অথচ মানুষ ছুঁতে জানিনা! ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে আজও মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া যায়। এখনও মানুষ ধর্মের নামে খুন করে মানুষকেই। এখনও কত গ্রামে ডাইনি ঘুরে বেড়ায়। আর তাদের পুড়িয়ে মারে মানুষ! এখন নাকি সমাজে কোনো কুসংস্কার নেই। সবাই আধুনিক। পরিপাটি। আপনাকে মনে পড়ে খুব। ধর্মীয় গোঁড়ামির মাথায় পা দিয়ে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, লড়াই করছেন মানুষের জন্য। অথচ অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পারেনি সেদিন কোনটা ঠিক কোনটা ভুল! স্বজাতির ক্রোধ আর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন আপনি। কিন্তু সিংহ কি আর শিকার হয়?
সেদিন যখন কলকাতার বুকে আপনার মূর্তি ভাঙা হলো আপনাকে নাকি রক্তাক্ত হতে দেখেছেন কেউ কেউ। এ আমার বিশ্বাস হয় না।
অপমানিত হয়ে যে মানুষ নিজের জন্মস্থানে আর কোনোদিন ফেরেননি, ত্যাগ করেছিলেন আত্মীয়দেরও। যিনি মুক্তসমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন অ আ ক খ- র আলো। কুসংস্কারের কুয়াশা ছিঁড়ে একটা আলোকময় ভোর আনতে আমৃত্যু যিনি লড়েন গোঁড়া অচলায়তনের বিরুদ্ধে। তিনি এই কর্মবিমুখ, হৈ হুল্লোড়ে, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও– সমাজে থাকতে পারেন না। তিনি থাকতে পারেন না সেই দেশে, যে দেশে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও খুন হয়ে যায় মানুষ, ধর্ষিতা হয় নারী।
আপনি তো সারাজীবন নিজের বা সংসারের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিলাসিতার কথা ভাবেননি। আমরা ভাবি। নিজেরটা বুঝে নিই ভালোভাবে। যদিও নিজের ভালোটাও ঠিকঠাক বোঝার বর্ণপরিচয় সত্যিই হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। আমরা এখন সত্যিই ব্যস্ত। আপনার আদর্শ কর্মপন্থা অনুসরণ করবার প্রতিজ্ঞায় আমরা নেই। জন্মদিন পালনের আহ্লাদে আছি স্যার। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। এই কদিন ফেসবুক হোয়াটসআপেও আপনিই থাকবেন আমাদের স্ট্যাটাসে, বিশ্বাস করুন করুণাসাগর। আর হ্যাঁ যেখানেই থাকুন ফেবুতে লাইকটা দিয়ে যাবেন প্লিজ, নইলে সোজা আনফ্রেণ্ড!