মেহেফিল -এ- কিসসা তাপস রায় (রম্যগদ্য)

সাম বাংলা কিছু ইংলিশ

বন্ধু উত্তমের ইংরেজিপ্রীতি প্রবল। এতটাই প্রবল যে, কথায় কথায় মুখে ইংরেজির খৈ ফোটে! ওদিকে উত্তমের উদ্ভট ইংরেজি শুনে আমাদের আক্কেল গুড়ুম! একবার জরুরি কাজে উত্তমদের বাড়ি যেতে হলো। বাইরে দাঁড়িয়ে নাম ধরে ডাকতেই উত্তম গলা উঁচিয়ে জানান দিলো- ওয়েট ম্যান, আই অ্যাম সুইমিং।

বাড়ির ভেতর সুইমিং! উত্তমদের বাড়িতে তো কোনো পুকুর নেই- তাহলে ও সাঁতার কাটছে কোথায়? কৌতূহল মেটাতে ভেতরে ঢুকেই পড়লাম। দেখি উঠোনের পাশে চাপকল। সেখানে দাঁড়িয়ে উত্তম হাতে-পায়ে, মুখে সাবান ডলছে আর বলছে, আই অ্যাম সুইমিং। জাস্ট ওয়েট ম্যান।

এই হলো আমাদের উত্তম কুমার। সংক্ষেপে ইউকে। আমরা যতোই ওকে বলি, দোস্ত, ভুল-শুদ্ধ বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে এভাবে বাংরেজি বলার দরকার কী?

ও তখন চোখ পাকিয়ে জানতে চায়, বাট হোয়াই? কিন্তু ক্যারে?

আমি মনে করিয়ে দেই- হোয়াই মানে ‘ক্যারে’ নয়, কেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। উল্টো উত্তম আমাকে গল্প শোনায়।

এক লোক ডিভি পেয়ে চলে গেল আমেরিকা। অথচ ইংরেজিতে তার জ্ঞান ক অক্ষর গোমাংস। বছর তিনেক পর বেচারা দেশে ফিরতেই বন্ধুদের মধ্যে একজন জানতে চাইল- হ্যারে ক্যালা (বাবা-মা কলিম রেখেছিল। বিদেশ ঘুরে এসে তিনি ক্যালা হয়েছেন। ওই নামে না ডাকায় দু’একজনকে কেলিয়েছেন এমনও শোনা যায়), তুই তো ইংরেজি জানিস না, তাহলে ওখানে কথা বলতে তোর অসুবিধা হয় নি?

ক্যালা এখন আমেরিকান নাগরিক। আগের চেয়ে আরো আধুনিক, আরো স্মার্ট। সে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ওহ্ নো নো ডোস্ত! আমি কেন্নো অসুবিঢায় পড়ব? অসুবিধায় পড়েছে ওরা।

মানে?

আমি তো ইংরেজি ফ্লুয়েন্টলি সার্ভিস দিছি। মাগার ওরা বুঝটে পেরেছে কিনা বলতে পারব না।

আমাদের উত্তমও তাই। তার ইংরেজি কে বুঝল, কে বুঝল না এতে তার কিছুই আসে যায় না। একবার স্কুল থেকে সিদ্ধান্ত হলো বনভোজনে যাওয়ার। সিদ্ধান্ত শুনে আমাদের ‘পথ হারিয়ে কোন বনে যাই, কোন মাঠেতে ছুটে বেড়াই’ অবস্থা!

উত্তম মামার দেওয়া ইয়া বড় নাকঅলা (লেন্স) ইয়াসাকি ক্যামেরা বগলে ঝুলিয়ে মহামুডে আমাদের সঙ্গী হলো। সারা দিন হৈ চৈ আনন্দে কেটে গেল। এবার ফেরার পালা। কিন্তু উত্তম কোথায়? শোনা গেল সে নাকি গ্রাম্যজীবন ও প্রকৃতির ছবি তুলতে গ্রামের দিকে গেছে, এখনও ফেরে নি। আমরা এগিয়ে গেলাম উত্তমকে খুঁজতে। বেশি দূর যেতে হলো না। দেখি উত্তম ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আমাদের দিকেই আসছে। পেছনে কাস্তে হাতে হা রে রে করে তেড়ে আসছে কৃষকায় এক কৃষক। ব্যাপার দেখে পারলে আমরাও দৌড় দেই আর কী!

এমন সময় হেল্পিং ভার্ব হিসেবে সেখানে আবির্ভূত হলেন আমাদের হরিপদ স্যার। স্যার দুজনকে থামিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দৌড়ের উদ্দেশ্য ও কারণ জানতে চেয়ে হুংকার দিয়ে উঠলেন। হঠাৎ হরিপদ স্যারের হাইড্রোলিক হর্নের মতো কণ্ঠ শুনেই হয়তো লোকটির ‘আইজ খাইছি তোরে’ মনোভাব কিছুটা শান্ত হলো। এবার হাঁফাতে হাঁফাতে উত্তম যা বলল তার সারমর্ম মোটামুটি এ রকম।

উত্তম কৃষকের একটা ছবি তুলতে চেয়েছিল। ক্যামেরার শাটার টেপার আগে যতবারই লোকটিকে সে ‘রেডি ইসমাইল (স্মাইল)’ বলেছে ততবারই নাকি লোকটি খেপে উঠেছে। ইসমাইল মানে যে হাসি সে কথা লোকটিকে বোঝানোই যাচ্ছে না। কাঁহাতক আর সহ্য হয়- শেষে জোর করে বোঝাতে গিয়ে এই বিপত্তি।

শুনে আমি বললাম, ঠিকই তো ‘স্মাইল’ মানে হাসি। এ কথা শুনে লোকটি দপ করে উঠে বলল, হাসি হইব ক্যান? ইসমাইল তো আমার নাম।

এবার টনক নড়ল আমাদের। স্যার ঠাস করে উত্তমের গালে পাঁচ সিকা থাবড়া বসিয়ে বললেন, সাম বাংলা কিছু ইংলিশ, মাদার মাদার ট্যাংরা ফিশ! কাল ক্লাসেই আমি তোকে স্মাইল আর ইসমাইলের পার্থক্য বোঝাব স্টুপিড!

বহুদিন পর একদিন আড্ডায় এ প্রসঙ্গ উঠতেই আমি উত্তমকে বললাম, স্যার সেদিন তোকে সবার সামনে গালি দিল তবুও তুই বাংরেজি ছাড়তে পারলি না!

শুনে উত্তম মুচকি হেসে বলল, এ জন্য আমিও তো স্যারকে কত দিন গধফৎধং ঈধষপঁঃঃধ বলেছি।

এর সঙ্গে মাদ্রাজ, কলকাতার সম্পর্ক কী? আমার এন্টিনায় কিছুতেই ধরা পড়ে না। আমার অবাক চেহারা দেখে উত্তম মোনালিসা হাসি দিয়ে বলল, সম্পর্ক একটা আছে। বল দেখি, তুই তো অনেক লেখাপড়া করেছিস।

আমি কোঁৎ কোঁৎ করি। বলতে পারি না।

শেষে উত্তমই উদ্ধার করে আমাকে-  গধফৎধং ঈধষপঁঃঃধ ভেঙে উচ্চারণ করলে গধফ-জধংপধষ-ঈঁঃঃধ এই তিনটি শব্দ পাওয়া যায়।

এই প্রথম উত্তমের ইংরেজি জ্ঞান দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম! বললাম, দোস্ত একটু চেষ্টা করলেই তুই কিন্তু ভালো ইংরেজি বলতে পারবি।

সে তো আমি এখনও পারি। উত্তম হাসতে হাসতে আমার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে পাল্টা জানতে চায়- বল তো ভিআইপি মানে কী?

ভেরি ইম্পর্টেন্ট পার্সন।

উঁহু, হলো না। ভি মানে ভোট, আই মানে ইহাদের, পি মানে পাই। অর্থাৎ ভিআইপি মানে যাদের ভোটের সময়ই পাওয়া যায়।

উত্তমের যুক্তি শুনে আমি ট্যাপ খেয়ে গেলাম। তবুও নাছোড়বান্দার মতো বললাম, মাতৃভাষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তারপরও কি এভাবে কথায় কথায় আমাদের বাংরেজি বলা উচিত?

উত্তমকে এবার চিন্তিত মনে হলো। ওষুধে কাজ হয়েছে ভেবে আমি আগ্রহ নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও হঠাৎ আমার কাঁধে ঝাকুনি দিয়ে বলে উঠল, যাহ্, আজ থেকে আর বাংরেজি বলব না! ওকে?

‘ওকে’ বললি যে! আমি ধরিয়ে দেই।

এবার উত্তম আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বিদায় নিতে নিতে বলল, স্যরি হইছে দোছ! আর হবে না। গুড বাই।

নিজের ভুল নিজেই বুঝতে পেরে উত্তম জিভে কামড় দিলো। তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, আমার বিদ্যার দৌড় তো ম্যারাথন টাইপের না। তাই বলে যেটুকু শিখেছি সেটুকু তো আর ভুলে যেতে পারি না। তা ছাড়া ইংরেজ তাড়ালেও যে ইংরেজি শব্দগুলো বেশুমার বায়ুপ্রবাহের মতো আমাদের বাংলা ভাষায় মিশে গেছে সেগুলোকে তাড়াবি কীভাবে? ইয়েস, নো, ভেরি গুড ভুলে গেলে শেষ পর্যন্ত লোকে না আবার মনে করে বসে উত্তম মূর্খ, ইংরেজি জানে না। তাই একটু-আধটু বাংরেজি চলুক।

শুনে আমি ধমকে উঠলাম। ধমক খেয়ে উত্তম ওকে, ওকে, কুল ম্যান, কুল! বলতে বলতে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।