• Uncategorized
  • 0

মুড়িমুড়কি -তে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়

অনুবাদ সংস্কৃতি ৪ 

কথা হচ্ছিল তর্জমা সহ্য করার। ছাত্রাবস্থায় কলেজ ক্যাম্পাসের কাছে শ্যামদার ভাতের হোটেলে খেতে গেলে শ্যামদার মারাত্মক ইংরাজি তর্জমা সহ্য করতে হত, তার একমাত্র কারণ শ্যামদার হোটেলের অসাধারণ মেনু। চালটা একটু মোটা হলেও তার সাথে ঘি, ঝুরিঝুরি আলুভাজা, শাকভাজা, ফুলকপির ডালনা থেকে শুরু করে একটা ফাটাফাটি মাছের ঝোলে রুইমাছের দুটি দাগা। কিন্ত  আসল ঝোলটা মানে ব্যপারটা রয়েছে ওই ঝোলে। শ্যামদার তর্জমায় যা হয়ে যেত ফিশ জুষ। ইউ ওয়ান্ট ফিশ জুষ? দ্বিতীয় বার ঝোল চাইলে বলতো, সাম মোর ফিশ জুষ? বলার সময় ঝোলের বাটিটা ঠক করে রাখা হত।তর্জমা এবং ইনটোনেশনেই প্রকাশ পেত যে বারবার এরকম মোর এন্ড মোর চাইলে নো মোর হয়ে যাবার প্রবল সম্ভাবনা।
তবে শ্যামদার ইংরেজিকে যদি জলবসন্তের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তা হলে বুলবুলদির ঠাকুরদার  হিন্দি তর্জমা অবশ্যই গুটি বসন্তের পদমর্যাদার দাবিদার হতে পারে। ওদের একটা শরীকি বাড়ি ছিল পুরী শহরে।প্রতি বছর কিছুদিন সপরিবারে ওঁরা গিয়ে পুরীতে কাটিয়ে আসতেন। সাশ্রয়ের জন্য বাড়িতেই রান্নাবান্না করা হত তোলা উনুনে। (এতে করে মা কাকিমাদের ছুটির কোন ব্যপার থাকতো না যদিও) বস্তায় ভরা চাল মুটের মাথায় চাপিয়ে দোকান থেকে নিয়ে আসতেন ঠাকুরদা। রাস্তায় আসতে আসতে মুটের সঙ্গে তাঁর নিম্নরূপ কথপোকথন বুলবুলিদির স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত-
এ চালেবালা, তুম দেখতা নহি পাতা হ্যায়, পিson থিক্যা ফুটা দিয়া চাউল ঝুরঝুরাইয়া পইরা যাতা হ্যায়।
এমত স্পষ্ট সতর্কীকরণের ফলেই সম্ভবত মুটে মাথা ঘুরে গিয়ে পাশের চলন্ত রিক্সার উপর ঢলে পড়েছিল।রিক্সার আরোহী তরুণ বাঙালি পর্যটকের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে মুটের চালে এবং রিক্সার চালে অপ্রীতিকর চালাচালি এড়ানো সম্ভব হয়। সেই তরুণ পর্যটক কালক্রমে বুলবুলিদির পাণিপ্রার্থী ও অনতিপরে পতিত্বে অধিষ্ঠিত হয়। ঠাকুরদা বাঙালি, সঙ্গের মুটে ওড্রদেশীয়, তবু কেন যে তাঁকে হিন্দিতে কথা বলতে হয়েছিল ব্যপারটা আমার কাছে আজও স্পষ্ট নয়। একমাত্র যদি প্রজাপতির প্ররোচনা বলে একে মানা যায়। যাই হোক, এক কথায় ভারি অসরদার সেই ছিল সেই তর্জমা।
কিন্তু ছেলেবেলায় একটু সহ্য করলে তার সুফল পাওয়া যায় সারা জীবনের জন্য।যেমন ধরুন ওয়ার্ডসওয়ার্থের পেত্রার্কীয় সনেটের বিন্যাসে “ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজের ওপর রচিত” আমাদের ইসকুল জীবনে বিস্তর হাড়-জ্বালানো একটি কবিতা। Earth has not anything to show more fair, all that mighty heart জাতীয় বাক্যবন্ধের লাইনের পর লাইন ব্যাখ্যা লিখে লিখে পরিশ্রান্ত আমরা এর আশ্চর্য সারল্যের দিকে ভাল করে তাকাতে পেরেছি অনেক বড়ো বয়সে।
আমাদের পরের প্রজন্মের একজন কাব্যরসিককে তার প্রিয় ওয়ার্ডসওয়ার্থের পাঁচটি, এমনকি তিনটি কবিতার কথা জিজ্ঞেস করতেই উঠে এল এই কবিতাটির নাম। সে আমাকে একটি চমৎকার অনুবাদও পাঠালো প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।কিন্তু সেটি আক্ষরিক অনুবাদই।
“এই বসুন্ধরায় এর চেয়ে সুন্দর কিছু দেখার কিছু নেই
এমন মহিমান্বিত অন্তরস্পর্শী দৃশ্যকে যে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে তার হৃদয় বলতে কিছু নেই: এই শহর কেমন সুন্দর সেজেছে দেখো
সকালের সৌন্দর্য নীরব, অনাবৃত
জাহাজ, মিনার, গম্বুজ, নাট্যশালা এবং মন্দিরগুলি কেমন
সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে মাটির পর উন্মুক্ত আকাশের নীচে |
দূষণমুক্ত মলয় বাতাসে,
সব কিছুই কেমন উজ্জ্বল আর চকচক করছে!
সুর্যকে কখনো এত সুন্দরভাবে উদিত হতে দেখি নি এই পাহাড়ি,  আদিম উপত্যকায় |
কখনো অন্তর থেকে এত শান্তি অনুভব করি নি |
নদী যেমন আপন গতিতে নিজেকে বহন করে নিয়ে যায়:
হায় ঈশ্বর!  সব বাড়িগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বাসিন্দারাও এখনো কেমন কালঘুমে মগ্ন !”
-যা পড়ে মূল কবিতাটি পড়ার তৃষ্ণা জাগে। পড়ার পর নিজের মত করে আবার বলতে ইচ্ছে করে।প্রেমিকাকে নানা ভাবে জেনেও যেমন কৌতূহল ফুরায় না, ব্যপারটা খানিকটা সেরকম।
এমন  সুন্দর আর কিছু নেই এই পৃথিবীতে
নিতান্ত কঠিন তুমি, মুগ্ধ যদি না হও দর্শনে
স্পর্শ না করে প্রাণ ,অপরূপ প্রভাতী বসনে
জড়ানো শহর যেন, সুসজ্জিতা জ্যোতির কিরীটে।
নিঃশব্দ সরলতায়, সুন্দর উষার আলোতে
গম্বুজ, প্রাসাদশীর্ষ, নাট্যগৃহ, মন্দির, জাহাজ
সুসজ্জিত, প্রান্তরের, আকাশের পানে চেয়ে আজ।
ঝকঝকে উজ্জ্বল, ধোঁওয়াহীন বাতাসের স্রোতে ।
সূর্য কখনো আগে এরকম প্রথম কিরণে
সাজিয়ে তুলেছে কোনো উপত্যকা, শৈলশিখর
দেখিনি কখনো আমি, পাইনি এমন  শান্তি মনে।
আপন খেয়ালে বয়ে চলে নদীস্রোত নিরন্তর ।
মানুষের বাসাগুলি পড়ে আছে নিদ্রার গহনে
বিশাল হৃদয় ক’টি, হা ঈশ্বর, শায়িত নিথর।
কিন্তু তাও কোনো অনুবাদই কি আসলে কবিতার হৃদয় পুরোপুরি ছুঁতে পারে? যত ভাল অনুবাদই হোক, দিনের শেষে মূল কবিতা যদি মহানায়িকা হন, নানা তর্জমা এধার ওধার থেকে তোলা তাঁর নানা ছবির মত, কিংবা ট্যাঁকখালির জমিদারের দোকানের শো-উইনডোতে হাপিত্যেসে হাত বোলানোর মত।
খোদ ওয়ার্ডসওয়ার্থ সমগ্র ভার্জিল অনুবাদ করার স্বপ্ন দেখলেও, ভার্জিলের ঈনীড ৪র্থ খন্ড অবধি অনুবাদ করে মধ্যবয়সে পৌঁছে ক্ষান্ত দেন। ৪র্থ খন্ড তাঁর জীবদ্দশায় ছাপাও হয় নি।তর্জমা করে সময় নষ্ট করার জন্য কোলরিজের তরফ থেকে প্রাপ্ত ভর্ৎসনাই এর একমাত্র কারণ, এমনটা জোর দিয়ে বলা যাবে না।
কবি কি অনুভব করছিলেন যে এক ভাষার একটি শব্দের মত অন্য ভাষায় ঠিক আরেকটি শব্দ সবসময় পাওয়া যায় না।কবিতা বিবৃতিমূলক না হয়ে যত সরে যাবে ভাবের বহুস্তরীয় বিন্যাসের দিকে, হয়ত ততই এই অনুবাদের অপূর্ণতা পীড়া দেবে।
তাই বলে সব তর্জমা যে এরকম অপূর্ণতার বেদনায় বিদ্ধ করে তা কিন্তু না ওই যে কবি কয়েছেন মাথায় পড়িলে তবে বলে বজ্র বটে, সেরকম কিছু অনুবাদ, যাই হোক, যেমন হোক একদম সঠিক নিশানায় গিয়ে লাগে।
আমার কন্নড় কলীগ আমাকে তাদের গ্রামের ইসকুলের গেমস টীচারের কথা শুনিয়েছে, যিনি নাকি ইসকুলে ছেলেদের উদ্দেশ্যহীন ভ্যাবলার মত গাছের ছায়ায় বসে গুলতানি করতে দেখলেই খেপে যেতেন স্বীয় দেশীয় ভাষা থেকে ইংরাজিতে তর্জমা করে বলতেন, হোয়াই ইউ আন্ডারস্ট্যান্ডিং ট্রিজ? ইট ক্যান্টিন, রীড লাইব্রেরী।
এই তর্জমার কোনো বিকল্প হয় না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *