এক ভুতুড়ে শহর আমার বাসভূমি। এখানে দূরে যত দূরে তাকাই শুধু বাড়ি। মাল্টিস্টোরেড কমপ্লেক্স, ডেকোরেটিভ গাছপালা। কোথাও কোনো মানুষ চোখে পড়ে না। অথচ এখানে বাতাস আছে, ঝকঝকে আকাশ। মসৃণ পিচঢালা পথ, জেব্রা ক্রসিং। তবু ট্রাফিকের ভিড় নেই কোথাও। মাঝে মাঝে দু একটি দ্রুতগামী গাড়ি কালো কাচ নামিয়ে উড়ালপুলের দিকে উড়ে যায়। কাওকে দেখি না, দেখতে পাই না!
আমি সারাদিন ব্যালকনিতে অপেক্ষায় থাকি। কথা বলার মানুষ খুঁজি, কেউ কথা বলে না। নিজের সাথে কথা হয় শুধু, বকবক করি একা। দিন ফুরিয়ে আসে, আদি অকৃত্রিম ডিউস বলের মতো সূর্য ড্রপ খায় সীমানার বাইরে। আমি অপেক্ষা করি। চোখের সামনে নাইট কুইন ফুটে ওঠে। আকাশে ঝলকায় চাঁদ। আমি অবাক হয়ে ভাবি। একদিন কত বন্ধু ছিলো আমার। পরিজন। হাটুরে আলাপ। চায়ের দোকানে ঝগড়াঝাটি। আমরা যেন সব ফেলে এসেছি বিগত জীবনে। এক এক করে ঝরে গেছে সংসার। শুধু রয়ে গেছে অপেক্ষার অন্তহীন বিকেল।
এই পৃথিবীর তাবৎ রক-বারান্দা যেদিন থেকে নিরুপদ্রব ব্যালকনি হয়েছে, তখনি তার বুকে জমেছে দুঃখ। আমরা সেই বেদনাকে আপন করেছি। বুকে জড়িয়ে ভেবেছি যাদুপাথর। প্রতিমুহূর্তে মনে করেছি এবার সব বদলে যাবে নিমেষে। আবার ডিম-ভাতের পিকনিক হবে। পাড়ার দিদিরা রান্না চাপাবে। সেঁকা পাঁপড়ের গন্ধ ম ম করবে চারপাশে। কিন্তু ঝুটাপাথর শুধু দুঃখ দিয়েছে। আমরা ব্যালকনি জুড়ে জমিয়েছি রঙিন নুড়ি, পাতাবাহার গাছ আর টেরাকোটা টব। পৃথিবীর তাবৎ ব্যালকনি আরও সুদৃশ্য হয়েছে, আরও একা হয়েছে। ব্যালকনি থেকে হাত বাড়িয়ে সবাই বন্ধুকে খুঁজেছি, কথা বলার মানুষ। শূন্য হাতে ফিরেছি অবশেষে।
যারা মহাকাশে গেছে তাদের মুখে শুনেছি, সেখান থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে চোখে পড়ে শুধুই সার সার ব্যালকনি। আর প্রতিটিতে বিষণ্ণ বিপন্ন মানুষের মুখ।